আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ ঐকমত্য কমিশনের সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, সেটা নাগরিক পরিসরে এখন একটা প্রধান আলাপ। বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্যে না আসতে পারাটা রাজনৈতিক দলগুলোকে বিভক্ত করে রাখছে বলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দেওয়াটাও কঠিন হয়ে পড়ছে।
বাস্তবায়নের বাগ্বিতণ্ডায় সবাই ভুলে যাচ্ছে যে ঐকমত্য কমিশন যে সংস্কার প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে তৈরি করেছে সেখানে ৮৪টি প্রস্তাবের মধ্যে ৭৫টি সংস্কার প্রস্তাবেই সব কটি রাজনৈতিক দলের পূর্ণ সমর্থন আছে। মাত্র ৯টা বিষয়ে আংশিক বা পূর্ণ আপত্তি আছে, ৩২টা দল বা জোটের ভেতর মাত্র ২ থেকে ৫টা দলের। এর মানে রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্যের খুবই কাছাকাছি পর্যায়ে আছে।
যেসব বিষয়ে আপত্তি আছে সেগুলো হলো—
১. সংবিধানের মূলনীতিতে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি যুক্ত হবে (আপত্তি সিপিবি, বাসদ, বাংলাদেশ জাসদ, বাসদ মার্ক্সবাদী, গণফোরাম গররাজি)।
২. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি (আপত্তি ইসলামী আন্দোলন)।
৩. রাষ্ট্রপতির বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষমতা (বাংলাদেশ ব্যাংক আর এনার্জি রেগুলেটরি কমিটি নিয়োগ নিয়ে আপত্তি বিএনপি, এলডিপি, বিএনপিপন্থী দল ও জোট, যেমন এনডিএম, ১২–দলীয় জোট, লেবার পার্টি, জামায়াতে উলেমায়ে ইসলাম)।
৪. প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় দলীয় প্রধান থাকতে পারবেন না (আপত্তি বিএনপি এবং বিএনপিপন্থী দল ও জোট)।
৫. তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কিছু বিধান নিয়ে দ্বিমত বিএনপি, লেবার পার্টি এবং এনডিএম।
৬. ক) দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ (আপত্তি সিপিবি, বাসদ)।
খ) উচ্চকক্ষ ভোটের অনুপাতে বা পিআর পদ্ধতিতে (আপত্তি বিএনপি, এনডিএম এবং বিএনপিপন্থীরা)।
গ) নির্বাচনের আগে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ এবং ১০ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন (আপত্তি বিএনপি, এনডিএম)।
ঘ) সংবিধান পরিবর্তন করতে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুমোদন লাগবে (আপত্তি সিপিবি, বাসদ, বিএনপি এবং বিএনপিপন্থী দল ও জোট)।
৭. নারী প্রার্থী মনোনয়নের ৫ শতাংশ (আপত্তি আমজনতা দল, সিপিবি, বাসদ)।
৮. ন্যায়পাল, সরকারি কর্ম কমিশন, মহা হিসাবরক্ষক, দুর্নীতি দমন কমিশন স্বতন্ত্র বাছাই কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ পাবে (আপত্তি বিএনপি এবং বিএনপিপন্থী দল ও জোট)।
৯. বাংলাদেশ ওপেন গভর্নমেন্ট পার্টনারশিপের পক্ষভুক্ত হবে (আপত্তি জাকের পার্টি, জাসদ, জেএসডি, বিএসপি, জামায়াতে ইসলামী, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য)।
বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে আছে দুটি পক্ষ। বিএনপি ও তার অনুসারীরা বলতে চায় যে বর্তমান সংবিধান মোতাবেক একমাত্র নির্বাচিত সংসদের এখতিয়ার আছে সংবিধান সংস্কার করার। তা ছাড়া যদি কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি সুযোগ পায় তাহলে সংবিধান নতুন করে লেখার আলাপ উঠবে এবং দেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে।
অন্যদিকে এনসিপি ও গণতন্ত্র মঞ্চ চায় আগামী নির্বাচনে সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে সেই সংসদ পূর্বঘোষণার মাধ্যমে একটি কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি অথবা সংবিধান সংস্কারেরও দায়িত্বপ্রাপ্ত হবে। যার ফলে তাদের পাস করা সংস্কার পরবর্তী সময়ে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মতো আদালত দিয়ে বাতিল করা যাবে না। সংস্কারগুলো টেকসই হবে। দুই পক্ষের যুক্তিই ফেলে দেওয়ার মতো নয়। বাস্তবায়নের বিষয়ে প্রকাশ্যে সব দল মিলে আলাপ হয়নি বলে কোন দলের অবস্থান কোন দিকে, সেটা জানা যায়নি।
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে তারা আরেকটা পদ্ধতির আলাপ তুলেছেন। তাঁরা বলছেন, আগামী নির্বাচনের দিন সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে যে ৯টা বিষয়ে হাতে গোনা কিছু দলের আপত্তি আছে, সেই প্রস্তাবগুলোর প্রতিটি নিয়ে নাগরিকদের মতামত জানতে গণভোট করা যায়।
এই ৯টা বিষয়ে যেসব বিধানে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক হ্যাঁ ভোট দেবেন সেগুলোর সঙ্গে আগের আপত্তি ছাড়া ৭৫টা প্রস্তাব যোগ করলে আমরা একটা পরিষ্কার সংস্কার প্রস্তাব পেয়ে যাব। জুলাই সনদ এই প্রক্রিয়াকে আগে থেকেই বৈধতা দিয়ে রাখবে বিধায় পরবর্তী সংসদ কোনো আলাপ–আলোচনা না করেই সম্পূর্ণ সংস্কার প্রস্তাব কোনো সংযোজন–বিয়োজন না করেই পাস করতে বাধ্য থাকবে।
এই প্রক্রিয়ায় সংস্কারের সীমা খুব পরিষ্কারভাবে নির্দিষ্ট হয়ে যাচ্ছে বিধায় পরবর্তী সংসদ কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি হিসেবে দায়িত্ব পেলে অনেক রাজনৈতিক দল যে নতুন সংবিধানের আলাপ নিয়ে সম্ভাব্য অরাজকতার ভয় পান সেই ভয় আর থাকছে না। দেশের স্বার্থকে সামনে রাখলে ঐক্যে পৌঁছানো কোনো সময়ই তেমন বড় পরীক্ষা নয়। আমরা আশা করি, আলী রীয়াজ কমিশন ১০ মাস ধরে যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, দ্রুত আমরা সেটার একটা সর্বসম্মত সমাধান পেয়ে যাব।
Publisher & Editor