ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর বিচার নিয়ে যখনই সংবাদমাধ্যমে আলোচনা হয়, তখনই তাঁর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিস্ময়কর মিলগুলোর প্রসঙ্গ উঠে আসে। দুজনই অতি ডানপন্থী রাজনীতির প্রতিনিধি, দুজনই হঠাৎ করে রাজনীতিতে আসেন, দুজনই করোনা মহামারির সময় ক্ষমতায় ছিলেন এবং দুজনই প্রকাশ্যে মহামারি মোকাবিলা ও জলবায়ুবিজ্ঞানের গুরুত্ব অস্বীকার করেছিলেন। তাঁরা দুজনেই আগে থেকেই ঘোষণা দিয়েছিলেন—কোনোভাবেই নির্বাচনে হার মানবেন না। আর যখন ভোটে হেরে গেলেন, তখন উভয়েই সমর্থকদের জাতীয় আইনসভা দখলে উসকে দেন, যাতে ফল উল্টে দেওয়া যায়।
কিন্তু আজ পরিস্থিতি ভিন্ন। বলসোনারো এখন আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন। তিনি এখন সুপ্রিম কোর্টে দণ্ডিত হওয়ার মুখে। অন্যদিকে ট্রাম্প আবার যুক্তরাষ্ট্র শাসন করছেন। প্রশ্ন হলো, কীভাবে এমন হলো? এ উত্তর খুঁজলেই বোঝা যাবে, আজকের গণতন্ত্রের মূল সংকট কোথায়?
বলসোনারো রাজনীতিতে আসেন ১৯৮৮ সালের সেই সংবিধান চূড়ান্ত হওয়ার পর, যা ব্রাজিলে দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছিল। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এসে শুরু থেকেই তাঁর ভাবনা ছিল কর্তৃত্ববাদী। তিনি বলেছিলেন, সামরিক একনায়কতন্ত্র যথেষ্টসংখ্যক বামপন্থীকে হত্যা করতে পারেনি। তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট ফার্নান্দো হেনরিক কার্দোসোকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার দাবি পর্যন্ত করেছিলেন। এমনকি তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় এলে পার্লামেন্ট বন্ধ করে দেবেন।
২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফকে অভিশংসনের সময় বলসোনারো তাঁর ভোটটি উৎসর্গ করেছিলেন সেই সেনা কর্মকর্তাকে, যিনি রুসেফকে নির্যাতন করেছিলেন। এমন অসংখ্য ঘটনায় প্রমাণ মেলে, বলসোনারো গণতন্ত্রের ভেতর দিয়েই উঠে এলেও সারা জীবন গণতন্ত্রকেই আক্রমণ করেছেন।
ট্রাম্পের উত্থান ভিন্নভাবে। ১৯৮০-এর দশকে নিউইয়র্কে পাঁচজন কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিনো কিশোরের বিরুদ্ধে মিথ্যা ধর্ষণ মামলা হলে তিনি প্রকাশ্যে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দাবি করে আলোচনায় আসেন। পরে ব্যবসায়ী ও টেলিভিশন তারকার জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে তিনি রাজনৈতিক প্রভাব তৈরি করেন।
ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণা দাঁড়িয়েছিল সেসব মানুষের ক্ষোভের ওপর, যাঁরা মনে করতেন, তাঁরা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়েছেন কিংবা সাংস্কৃতিকভাবে অবহেলিত। তিনি কখনোই উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন না; বরং আদালতের প্রতি তাঁর প্রবল অবিশ্বাস ছিল। ব্যবসায় যেমন তিনি আইনকে অবজ্ঞা করেছেন, রাজনীতিতেও তা–ই করেছেন। এখন তিনি আবার প্রেসিডেন্ট হয়ে সংবিধান দুর্বল করা, ফেডারেল রিজার্ভের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া, ভোটের নিয়ম নিজের মতো করে পাল্টানো এবং নাগরিকত্বের সংজ্ঞা বদলে দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন।
ট্রাম্প ও বলসোনারো—দুজনই প্রথমবার পুনর্নির্বাচনে ব্যর্থ হন। তবে এখানেই তাঁদের পথ আলাদা হয়ে যায়।
ব্রাজিলের নির্বাচনী ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী ও কেন্দ্রীয়। ফেডারেল বিচার বিভাগের অধীন সারা দেশে একই দিনে ভোট হয়। আমাজনের আদিবাসী গ্রাম থেকে শুরু করে দক্ষিণের কৃষক পর্যন্ত সবার জন্য সমান সুযোগ থাকে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফলাফল ঘোষণা হয়। কিন্তু কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবার বলসোনারো এ ব্যবস্থার স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। তিনি জাতির আস্থার জায়গাটিকে দুর্বল করার চেষ্টা করেন।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের খণ্ডিত নির্বাচনী ব্যবস্থা ট্রাম্প নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেন। তিনি গণতন্ত্রের প্রতি সন্দেহ ঢুকিয়ে দেন, অঙ্গরাজ্যগুলোর কর্মকর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন এবং ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারির দাঙ্গার পথ তৈরি করেন।
বলসোনারো কিন্তু আরও এক ধাপ এগিয়ে ছিলেন। তদন্তে দেখা গেছে, তিনি ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা একটি খসড়া আদেশ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন, যাতে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভার শপথ আটকে দেওয়া যায়। সেনাবাহিনীর ভেতর দ্বিধার কারণে সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। এমনকি লুলা, ভাইস প্রেসিডেন্ট জেরালদো আল্কমিন ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আলেক্সান্দ্রে দে মোরায়েসকে হত্যার পরিকল্পনাও হয়েছিল। তবে সেনাবাহিনীর অস্বস্তির কারণে সেটিও শেষ মুহূর্তে ভেস্তে যায়।
ট্রাম্প ও বলসোনারো দুজনেই আজকের নতুন ধরনের কর্তৃত্ববাদের প্রতীক। তাঁরা ভুয়া তথ্য ছড়িয়েছেন, বিজ্ঞানের বিরোধিতা করেছেন, মানবাধিকারকে অগ্রাহ্য করেছেন এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে অবজ্ঞা করেছেন। তবে বলসোনারোকে আলাদা করে চেনা যায় তাঁর বিংশ শতাব্দীর সামরিক একনায়কতান্ত্রিক আদর্শের কারণে।
নির্বাচনের পর বলসোনারোর সমর্থকেরা সেনাশিবিরের বাইরে অবস্থান নিয়ে সামরিক হস্তক্ষেপ দাবি করেন। সরকারি কর্মকর্তারাও পরিস্থিতি উত্তপ্ত করেন। লুলার শপথ গ্রহণের এক সপ্তাহ পর তাঁরা সহিংসভাবে সরকারের তিন শাখার কার্যালয় আক্রমণ করেন।
২০২১ সালের ক্যাপিটল হিলে হামলার পর ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলা হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট প্রেসিডেন্টদের প্রায় পূর্ণ দায়মুক্তি দিয়ে দেন। এ কারণে তাঁর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগগুলো কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। আর ২০২৪ সালের নির্বাচনে তাঁর বিজয় সব ধরনের জবাবদিহির পথ বন্ধ করে দিয়েছে।
ব্রাজিলে চিত্র আলাদা। বলসোনারো ক্ষমতায় থাকতেই সুপ্রিম কোর্টকে প্রধান শত্রু বানিয়েছিলেন। অথচ অ্যাটর্নি জেনারেল (যিনি যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীন) যখন তাঁর বিরুদ্ধে মামলা আনেন, সেটা ছিল ব্রাজিলের দীর্ঘদিনের শাস্তিহীনতার ধারা ভাঙার ঘটনা।
বলসোনারো এখন গণতান্ত্রিক আইনের শাসন উচ্ছেদের চেষ্টা করার অভিযোগে আদালতে। ব্রাজিলের আইনে এটি স্পষ্ট অপরাধ। কারণ, অভ্যুত্থান সফল হলে জবাবদিহি ভেঙে পড়বে। বলসোনারো বলছেন, তিনি অভ্যুত্থানের কথা শুধু ভাবছিলেন, কাজ করেননি। আদালত এখন তাঁর কথার সত্যতা যাচাই করছেন।
ট্রাম্প ও বলসোনারো দুজনেই আজকের নতুন ধরনের কর্তৃত্ববাদের প্রতীক। তাঁরা ভুয়া তথ্য ছড়িয়েছেন, বিজ্ঞানের বিরোধিতা করেছেন, মানবাধিকারকে অগ্রাহ্য করেছেন এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে অবজ্ঞা করেছেন। তবে বলসোনারোকে আলাদা করে চেনা যায় তাঁর বিংশ শতাব্দীর সামরিক একনায়কতান্ত্রিক আদর্শের কারণে।
যদিও কোনো দেশই গণতন্ত্র ধ্বংসের হুমকি থেকে পুরোপুরি নিরাপদ নয়, তবে ব্রাজিলের স্বৈরাচারী শাসনপরবর্তী সংবিধান গণতন্ত্রের শক্ত সুরক্ষা তৈরি করেছে। বলসোনারো আজ শাস্তির মুখে, কারণ তিনি ধীরে ধীরে গণতন্ত্র ভাঙেননি, বরং সরাসরি অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন।
আমি একজন ব্রাজিলীয়। আমার পরিবারের অনেকে সামরিক শাসনামলে গ্রেপ্তার বা নির্বাসিত হয়েছিলেন। তাই বলসোনারোকে বিচারের মুখে দেখা আমার কাছে স্বস্তির বিষয়। কারণ, কোনো সামরিক শাসকই কখনো তাঁদের অপরাধের শাস্তি পাননি।
কিন্তু আজকের সবচেয়ে বড় হুমকি সরাসরি সামরিক অভ্যুত্থান নয়, বরং প্রতিযোগিতামূলক কর্তৃত্ববাদ—যেখানে ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শেষ হয়ে যায়। ব্রাজিলে, যুক্তরাষ্ট্রে এবং অন্যত্র—আমাদের এখনই প্রতিরোধ গড়তে হবে। কারণ, গণতন্ত্রের এই ক্ষয়ই শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প ও বলসোনারোর মতো নেতাদের ক্ষমতায় বসার পথ তৈরি করে।
Publisher & Editor