মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ঋণ যেভাবে খেয়ে ফেলছে গোটা দক্ষিণ বিশ্বকে

প্রকাশিত: ১২:৪৬, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ২৬

শ্রীলঙ্কা তার ইতিহাসের সবচেয়ে জটিল অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সময় পার করছে। ২০২২ সালে দেশটির অর্থনীতি ভেঙে পড়েছিল। লাগামহীন ও উচ্চ সুদের ঋণ, দুর্বল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও বাইরের ধাক্কা—এই তিনের বিষাক্ত মিশ্রণেই সেটা ঘটেছিল।

এ সময় ‘আরাগালায়া’ নামে নাগরিক আন্দোলনের ব্যানারে দেশজুড়ে গণবিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। আন্দোলনের মূল দাবি ছিল জবাবদিহি, অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও রাজনৈতিক দুর্নীতির অবসান। এই গণ–আন্দোলনের চাপেই শেষ পর্যন্ত তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তাঁর পদত্যাগের পর রনিল বিক্রমাসিংহে আবার ক্ষমতায় আসেন। নতুন একটা নির্বাচনের দাবি পিছিয়ে দিয়ে তিনি ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নতুন কর্মসূচির আওতায় ৩০০ কোটি ডলারের সহায়তা নেন। একই বছরের শেষে বেইল আউট প্যাকেজের দ্বিতীয় কিস্তি পেতে চীন, ভারত, জাপানসহ একাধিক ঋণদাতা দেশের সঙ্গে ঋণ পুনর্গঠন চুক্তি করেন।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে শ্রীলঙ্কার জনগণ অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকের নেতৃত্বে একটি প্রগতিশীল সরকারকে ঐতিহাসিক ম্যান্ডেট দিয়ে নির্বাচিত করে। কিন্তু শুরু থেকেই তাঁর সরকার আইএমএফের শর্ত আর আগের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের চাপিয়ে দেওয়া বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকা পড়েছে। মূলধারার নব উদারনৈতিকেরা আইএমএফের সঙ্গে করা চুক্তিকে স্থিতিশীলতার চিহ্ন হিসেবে ধারাবাহিকভাবে প্রচার করে আসছেন। ঋণ পুনর্গঠন চুক্তি আর আইএমএফের শর্ত মানাকে তাঁরা সাফল্য বলে মনে করেন। কিন্তু এই অর্থনৈতিক ‘পুনরুদ্ধারের’ মানবিক মূল্য কতটা?

শ্রীলঙ্কায় এখন যে কাঠামোগত সংস্কার চলছে, সেটা জনগণের জন্য শাস্তিমূলক। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারীকরণ করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে আলাদা করা হয়েছে। সরকারের ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাতীয় উন্নয়নকে ঋণদাতাদের স্বার্থের অধীন করা হয়েছে।

অভ্যন্তরীণ ঋণ পুনর্গঠন শ্রমজীবী মানুষের অবসরকালীন সঞ্চয়, বিশেষ করে প্রভিডেন্ট ফান্ডের ওপর চাপ তৈরি করেছে। কর্মজীবীদের আয় ইতিমধ্যেই উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও বাড়তি করের কারণে কমে গেছে। সরকারি খাতে নতুন নিয়োগ বন্ধ। গ্রামীণ সড়ক ও সেচ প্রকল্প স্থগিত বা বাতিল। স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বরাদ্দ স্থবির। এ দুই খাতে জনগণের ব্যয় বেড়েই চলেছে। সুদের হার বৃদ্ধি, কর সমন্বয়, ভর্তুকি প্রত্যাহার, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, শ্রমিকদের অবসর ভাতা কমানো—এসব সংস্কারের চাপ সাধারণ মানুষের ওপর গিয়ে পড়েছে।

উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নিয়মিতভাবেই ধনী দেশগুলোর তুলনায় কয়েক গুণ বেশি সুদ দিতে হয়। এরপরও ঋণমুক্তির ব্যবস্থাগুলো অপ্রতুল, বিভাজিত এবং সেটা মূলত ঋণদাতাদের পক্ষে সুবিধাজনক। বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোর মধ্যে ন্যায়, উন্নয়ন ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে স্থায়ী ও স্বচ্ছ ঋণ সংকট সমাধানের জন্য একটি ব্যবস্থার দাবি ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে।
আইএমএফের কর্মসূচি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জবাবদিহি দুর্বল করেছে। সরকারের আর্থিক সক্ষমতা সীমিত করেছে। জমি, পানি ও বীজের বেসরকারীকরণকে উৎসাহিত করছে। আইএমএফের শর্ত পূরণে ২০২৫ সালের মধ্যে বাজেটে ২ দশমিক ৩ শতাংশ উদ্বৃত্ত অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হয়েছে। সে কারণে সরকারকে কঠোর কৃচ্ছ্রনীতি চালু করতে হয়েছে। যদি গরিব মানুষের পকেট থেকে টাকা না আসে, তাহলে এই উদ্বৃত্ত কোথা থেকে আসবে? ব্যাংকাররা হয়তো এই কৃচ্ছ্রসাধনকে স্বাগত জানাবে, কিন্তু গ্রাম ও উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাস করা মানুষের জন্য এটি দুঃখ-কষ্ট আর ভয়ের বার্তা বয়ে আনে। ঋণ পুনর্গঠন কর্মসূচিতে বিনিয়োগকারীর মুনাফা অগ্রাধিকার পেয়েছে, জরুরি সেবায় বরাদ্দ সংকুচিত হয়েছে।

শ্রীলঙ্কার নাগরিক সমাজ সংস্থাগুলো জানাচ্ছে, অন্তত ৬৩ লাখ মানুষ কম খাবার খাচ্ছে। ৬৫ হাজার ৬০০ মানুষ মারাত্মক খাদ্যঘাটতির মুখোমুখি। নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট অনূঢ়া দিশানায়েকে অর্থ মন্ত্রণালয়কে কৃষি ও মৎস্য খাতে ভর্তুকি পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়েছেন। এটি স্বাগতযোগ্য পদক্ষেপ, কিন্তু সেটা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট না–ও হতে পারে। জেলেরা বলছেন, জ্বালানির দাম এখনো অনেক বেশি, যা তাঁদের আয়ের বড় অংশটি খেয়ে ফেলছে। কৃষকদের অনেকেই কৃষি উৎপাদনের জন্য ভতুর্কি দামে সারের ওপর নির্ভরশীল। সারের মূল্যবৃদ্ধি, জলবায়ু বিপর্যয় এবং রাষ্ট্রীয় সহায়তা কমে যাওয়ায় তাঁদের টিকে থাকার জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে।

২০২৫ সালে শ্রীলঙ্কায় স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মোট জাতীয় আয়ের মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ। এটি সরকারি ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের তুলনায় পাঁচ গুণ কম। এই বৈষম্য শ্রীলঙ্কার সামাজিক সুরক্ষা খাতে বাজেটের সীমাবদ্ধতাকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।

কিন্তু এটি কেবল শ্রীলঙ্কার গল্প নয়। এটি একটি বৈশ্বিক ঋণসংকটের অংশ। এটি গ্লোবাল সাউথ বা বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোর এমন এক বড় ঋণ সংকটের অংশ, যার মধ্য দিয়ে জনগণের অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ, প্যাসিফিক ও মধ্য ইউরোপের অসংখ্য দেশকে বাধ্য করা হয়েছে তাদের জাতীয় নীতিনির্ধারণের স্বাধীনতা আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা, যেমন
আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছে সঁপে দিতে।

জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন কনফারেন্সের (আঙ্কটাড) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের অর্ধেক মানুষ (প্রায় ৩৩০ কোটি) এমন সব দেশে বসবাস করছেন, যেখানে স্বাস্থ্য বা শিক্ষার চেয়ে ঋণের সুদে বেশি খরচ হচ্ছে। শুধু ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলো ঋণের সুদ হিসেবে ৯২১ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে। আফ্রিকার দেশগুলোতে যার প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। আঙ্কটাড সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, বিশ্বব্যাপী সুদ বাড়ার হার এবং অন্যায্য অর্থনৈতিক কাঠামো নির্ভরশীলতা ও অনুন্নয়নের চক্রকে গভীর করছে।

উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নিয়মিতভাবেই ধনী দেশগুলোর তুলনায় কয়েক গুণ বেশি সুদ দিতে হয়। এরপরও ঋণমুক্তির ব্যবস্থাগুলো অপ্রতুল, বিভাজিত এবং সেটা মূলত ঋণদাতাদের পক্ষে সুবিধাজনক। বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোর মধ্যে ন্যায়, উন্নয়ন ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে স্থায়ী ও স্বচ্ছ ঋণ সংকট সমাধানের জন্য একটি ব্যবস্থার দাবি ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor