সোমবার, ০৪ আগস্ট ২০২৫

গাজা থেকে ইউক্রেন—যে কারণে এত যুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৭:৩২, ২১ জুলাই ২০২৫ | ৩০

বর্তমানে বড় বড় সংঘাত বন্ধ করে শান্তি আনতে যেমন মরিয়া চেষ্টা দেখা যাচ্ছে, তেমনি এসব চেষ্টাকে প্রায় বৃথাও হতে দেখা যাচ্ছে। গাজায় যুদ্ধবিরতি, শান্তি আলোচনা কিংবা সাময়িক বিরতির কথা শেষ পর্যন্ত কান্না আর হতাশায় গড়াচ্ছে।

ইউক্রেনে যুদ্ধ চতুর্থ বছরে পড়েছে। যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্প শান্তির জন্য ৫০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন; তবে এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার তেমন কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না।

ওদিকে সিরিয়ায় আবার নতুন করে আগুন জ্বলছে। সুদানের ভয়াবহতাও থামছে না। রাষ্ট্রভিত্তিক বা গোষ্ঠীভিত্তিক সংঘাত শুধু গত বছরেই ৩৬টি দেশের ৬১টি জায়গাতে পৌঁছেছিল। এই সংখ্যা ১৯৪৬ সালের পর সর্বোচ্চ। অবস্থা যা দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, চলতি বছর পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

যুদ্ধাপরাধ ও সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলের বর্বরতার মাত্রা ও বিস্তৃতি এত বেশি হয়ে উঠেছে যে তা এখন প্রায় স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষদের ইচ্ছাকৃতভাবে টার্গেট করা, শিশুদের হত্যা করা, পঙ্গু করা, অপহরণ করা, না খাইয়ে রাখা, যৌন সহিংসতা চালানো, নির্যাতন ও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি—সবকিছুই এখন যুদ্ধের অস্ত্র হয়ে উঠেছে।

গত সপ্তাহে গাজায় পানি নেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুদের ইসরায়েলি সেনারা গুলি করে মেরেছেন। এটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক একটি ঘটনা। অথচ এমন দৃশ্য এখন জলভাত হয়ে গেছে।

বাইবেলের সেন্ট ম্যাথিউ বলেছিলেন, ‘শান্তি প্রতিষ্ঠাকারীরা ধন্য।’ কিন্তু আজকের দুনিয়ায় নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারীর খুব অভাব। সবাই মনে করে, নিরপরাধ মানুষদের হত্যা বা গণহত্যা অন্যায়। তারপরও এমন ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড কীভাবে ঘটেই চলেছে?

এ প্রশ্নটাই রাফাহ, কিয়েভ ও দারফুরে নিহত ব্যক্তিদের মা–বাবা ও স্বজনেরা জাতিসংঘ, মসজিদ-মন্দির, পাব-পার্লামেন্ট, রাস্তাঘাট কিংবা গ্লাস্টনবারির মঞ্চে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করছেন: কেন? কেন?

এখনো আমাদের কাছে কিছু সর্বজনগ্রাহ্য নীতি আছে। জেনেভা কনভেনশন, আন্তর্জাতিক আইন, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক চুক্তি—এসব আমাদের এখনো পথ দেখাতে পারে। আমাদের উচিত এসবকে সম্মান করা, মজবুত করা। এগুলো কখনো কখনো অস্বস্তিকর সত্য হলেও এদের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
মোরাল রিলেটিভিজম বা নৈতিক আপেক্ষিকতাবাদে এর একটি ব্যাখ্যা রয়েছে।

সত্যি কথা হলো, সবাই আসলে একমত নয়। কোনো একটি কাজ একদলের কাছে সম্পূর্ণ নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য হলেও অন্য দলের কাছে তা কিছুটা গ্রহণযোগ্য বা ব্যাখ্যাযোগ্য হতে পারে। এটি মানবেতিহাসে বহুবার ঘটেছে।

তবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে আগে থেকেই বিভক্ত হয়ে থাকা এই পৃথিবী এখন নৈতিক ও মূল্যবোধের ক্ষেত্রেও মারাত্মকভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। মার্কিন লেখক ডেভিড ব্রুকস নৈতিকতার এই অভাবকে ‘পারমানেন্ট মোরাল অর্ডার’ বা স্থায়ী নৈতিক ব্যবস্থার অভাব বলে আখ্যায়িত করেছেন।

আন্তর্জাতিক আইনকানুনভিত্তিক শৃঙ্খলা যেভাবে ভেঙে পড়ছে, ঠিক সেভাবেই এই নৈতিক ভিত্তিও ভেঙে পড়েছে। কোনো সর্বজনগ্রাহ্য নীতিমালা না থাকায় দেশীয় বা আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান করাটাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

ডেভিড ব্রুকস বলেন, ‘আমরা এখন এমন এক সময়ে আছি, যেখানে কোনো মতকে সঠিক বা ভুল বলে চিহ্নিত করার কোনো নিরপেক্ষ মানদণ্ড নেই। ফলে জনপরিসরে বিতর্ক কখনোই থামে না, বরং তা ক্রমেই আরও রাগী ও বিভাজনমূলক হয়ে ওঠে।’ ফলে যা থাকে, তা হলো বলপ্রয়োগ ও প্রতারণা।

এই বিভ্রান্তিকর নৈতিকতা সবচেয়ে ভালোভাবে যাঁর মধ্যে প্রতিফলিত হয়, তিনি হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি একজন প্রতারণার মাস্টার ও চাপ প্রয়োগের নাটের গুরু। তিনি মনে করেন, তাঁর এ বছরই নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া উচিত। অথচ কিছুদিন আগেই তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে ইরানে বোমাবর্ষণ করেছেন, যার ফলে বহু বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। ট্রাম্পের মতে, যদিও সেটি অবৈধ আগ্রাসন ছিল, তবু সেটি ন্যায্য, কারণ ওই হামলার মাধ্যমেই তিনি সেই ‘শান্তি’ ফিরিয়ে এনেছেন (যা তিনি নিজেই প্রথমে নষ্ট করেছিলেন)।

একটা দুনিয়া যেখানে যুদ্ধই যেন স্বাভাবিক বাস্তবতা, সেখানে আলফ্রেড নোবেলের শান্তি পুরস্কার দিনকে দিন যেন কেবল একটা ঠাট্টামশকরায় পরিণত হচ্ছে। এই পুরস্কার রাজনৈতিক হাতিয়ারেও পরিণত হচ্ছে। কোনো কিছু না করেই ওবামা ২০০৯ সালে এই পুরস্কার পেয়েছিলেন। এখন যদি ট্রাম্প আগামী চার বছর ‘কিছু না করেন’, তা–ও বোধ হয় অনেক বেশি শান্তির হবে।

কিন্তু তার চেয়েও দুঃখজনক, ট্রাম্প মনোনয়ন পেয়েছেন ইসরায়েলের নেতানিয়াহুর কাছ থেকে, যে নেতানিয়াহু নিজেই শান্তি ও ন্যায়ের চরম প্রতিপক্ষ। এসব না করে বরং শান্তি পুরস্কার তুলে দিয়ে একটা ‘সালতানাতের বর্ষসেরা যুদ্ধনেতা’ পুরস্কার চালু করলেই ভালো হয়। বিজয়ীর মাথার ওপর পুরস্কার নয়, বরং পুরস্কারমূল্য রাখলেই হয়।

যেকোনো গির্জা বা মসজিদের নেতাকেই জিজ্ঞাসা করুন, তিনি বলবেন, আজকের দুনিয়ায় শান্তির পক্ষে নৈতিক যুক্তি তুলে ধরা একটা ঝুঁকির কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল মনে হয়, নৈতিকতা শব্দটাই যেন নোংরা কিছু। এ যেন একধরনের ভালো ভাবনার কিছু নয়, বরং নৈতিকতা যেন আবেগ, সুবিধাবাদিতা আর সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। না হলে আমেরিকার এত মানুষ কীভাবে ট্রাম্পের নৈতিক দুর্নীতিগুলো দেখেও কিছু বলে না? সামাজিক দায়িত্ববোধ নয়, এখন সামাজিক পরিচয়ই যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইউক্রেনে পুতিনের চালানো ধ্বংসযজ্ঞের দিকে নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে থাকা রুশ জনগণের একটা বড় অংশও একই রকম নৈতিক শূন্যতায় ভুগছে। যারা সাহস করে প্রশ্ন তুলতে চায়, তাদের চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। অন্যরা সরকার–নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার মিথ্যা গল্পে বিশ্বাস করে। অধিকাংশ মানুষ জানেই না যে তাদের নামেই কী ভয়াবহ অপরাধ ঘটে চলেছে।

একদিন যখন এই যুদ্ধ শেষ হবে, তখন অনেক রুশ নাগরিক হয়তো বলবে, ‘আমরা জানতাম না।’ এই ‘জানতাম না’ ধরনের উদাসীনতা আর মিথ্যার মধ্য দিয়েই নৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়।

ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনে শান্তির সুযোগ নষ্ট করার ফলে ইসরায়েলকে অনেক বড় নৈতিক মূল্য চুকাতে হচ্ছে। দেশটির আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। তাদের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। এর ফলে বিশ্বজুড়ে ইহুদিবিদ্বেষ আবার বেড়ে গেছে। প্রশ্ন হলো, গাজার সেনা অভিযানে যখন ৫৮ হাজার মরদেহ পড়ে থাকে, তখন এত ইসরায়েলি কীভাবে চোখ বুজে থাকে? কেউ কেউ বলেন, যদি শেষ কয়েকজন ইসরায়েলি জিম্মিকে ছেড়ে দেওয়া হতো, তাহলে এ সবকিছুর অবসান হতো। আবার কেউ বলেন, সব ফিলিস্তিনিই হামাস। কেউ কেউ আরও ভয়ংকর কথা বলেন, ‘ফিলিস্তিন বলে কিছু নেই, সব ওদের বানানো।’ কেউ আবার গাজার ২০ লাখ মানুষকে এক বিশাল বন্দিশিবিরে পুরে ফেলার প্রস্তাব দেন।

অবশ্য অনেক ইসরায়েলিও এসবের বিরুদ্ধে। তাঁরা শান্তি চান। কিন্তু সরকারের নীতি বদলাতে না পারার কারণ একদিকে রাজনৈতিক ব্যর্থতা হলেও আরেক দিকে নিঃসন্দেহে নৈতিক ব্যর্থতা। সেই বিবেচনায় যে আমেরিকান, রুশ, ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় জনগণ মুখ খোলে না, ঘটনা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে কিংবা অমানবিকতাকে ‘রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে’ মার্জনা করে, তাদের সবাই এসব বর্বরতার জন্য দায়ী।

কেউ কেউ আবার টমাস আকুইনাসের যুক্তি টেনে বলেন, ‘যদি এটি ন্যায়যুদ্ধ হয়, তাহলে হত্যা ও ধ্বংস নৈতিক দিক থেকে মেনে নেওয়া যায়।’

আধুনিক সময়ের এই ব্যর্থতা, এই নিজস্ব সুবিধামাফিক বানানো নৈতিকতা, এই দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া—এর সবই বিপজ্জনক। কিন্তু এটিকে পাল্টানো সম্ভব।

এখনো আমাদের কাছে কিছু সর্বজনগ্রাহ্য নীতি আছে। জেনেভা কনভেনশন, আন্তর্জাতিক আইন, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক চুক্তি—এসব আমাদের এখনো পথ দেখাতে পারে। আমাদের উচিত এসবকে সম্মান করা, মজবুত করা। এগুলো কখনো কখনো অস্বস্তিকর সত্য হলেও এদের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

প্রতিদিনের সাধারণ জীবনে মানুষ তার নিজের মতো করে নৈতিক অবস্থান ঠিক করতেই পারে। কিন্তু বড় সংঘাত থামানো এবং কোটি কোটি মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করা—এটা নিছক সদিচ্ছার বিষয় নয়, বরং এটি এক নৈতিক দায়িত্ব। আর এ দায়িত্ব পালনে সবাইকে একজোট হয়ে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

এ পথেই আছে শান্তি। এ পথেই আছে মুক্তি।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor