সোমবার, ০৪ আগস্ট ২০২৫

কার্টুন কি সাংবাদিকতা?

প্রকাশিত: ০৭:৫৮, ২৮ জুলাই ২০২৫ | ১৮

সংবাদপত্রে কার্টুনিস্ট হিসেবে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় নানা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। একবার এক অনুষ্ঠানে আমার এক বন্ধু আমাকে ‘সাংবাদিক’ বলে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। পাশ থেকে একজন বলে উঠলেন, ‘আরে, আমি তো ওনাকে চিনি, উনি তো সাংবাদিক নন, কার্টুনিস্ট।’

আমি দুটি পরিচয়েই গর্বিত বোধ করি। কার্টুনের প্রতি অগাধ ভালোবাসা আছে বলেই তো আমি কার্টুনিস্ট। আর সাংবাদিকতা তো বলার অপেক্ষা  রাখে না, আমাদের সমাজে এটা একটা সম্মানজনক পরিচয়।

তবে কার্টুন আর সাংবাদিকতা কি দুটো আলাদা পেশা? একজন কার্টুনিস্টকে কি সাংবাদিক বলা যায়? আমাদের সমাজের উচ্চশিক্ষিত মানুষের মধ্যেও এ প্রশ্ন রয়ে গেছে।

অভিজ্ঞতা থেকে অনেকটা নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষেরই ধারণা, কার্টুন কোনো সাংবাদিকতা নয়। মজার ব্যাপার হলো, এ ধারণা শুধু সাধারণ মানুষের নয়, আমাদের সংবাদপত্রেরও অনেকেরই।

অথচ কার্টুন অত্যন্ত শক্তিশালী একটি সাংবাদিকতা। তবে অবশ্যই সব কার্টুন সাংবাদিকতা নয়। কার্টুনের অনেক শাখা রয়েছে। যেমন কমিক স্টিপস, গ্রাফিক নোবেল, ক্যারিকেচার, গ্যাগ কার্টুনসহ বিভিন্ন ধরনের কার্টুন রয়েছে।

এসব কার্টুন কি সাংবাদিকতার অংশ? একদমই নয়। তাহলে আধুনিক সংবাদপত্রে কার্টুনের কোন শাখাটি একটি শক্তিশালী সাংবাদিকতা হিসেবে স্বীকৃত?

আমেরিকার প্রেস ইনস্টিটিউট বলছে, সাংবাদিকতার প্রধান চারটি লক্ষ্য হলো—

এক. জনগণকে তথ্য প্রদান।
দুই. ক্ষমতার জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
তিন. গণতান্ত্রিক বিতর্ক সৃষ্টি করা।
চার. জনস্বার্থে কাজ করা।

সাংবাদিকতার প্রধান এই চার লক্ষ্যই থাকে রাজনৈতিক বা সম্পাদকীয় কার্টুনে। এ জন্যই কার্টুনের এই দুটি শাখাই সাংবাদিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত।

একটি রাজনৈতিক বা সম্পাদকীয় কার্টুনে সমসাময়িক বিষয় থাকে, সামাজিক বা রাজনৈতিক ঘটনাবলির বিশ্লেষণ থাকে, ব্যঙ্গবিদ্রূপের মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন ভুলত্রুটির সমালোচনা থাকে। ফলে কার্টুন গণতান্ত্রিক বিতর্ক তৈরি করে, যা সাংবাদিকতারই অংশ।

জন হার্ট কার্টুনিস্ট সম্পর্কে যথার্থ বলেছেন। তাঁর ‘পলিটিক্যাল কার্টুনস অ্যান্ড দ্য প্রেস’ বইয়ে বলেছেন, একজন কার্টুনিস্ট একই সঙ্গে রিপোর্টার, বিশ্লেষক ও সমালোচকের ভূমিকা পালন করেন। তিনি এঁকে বাস্তবতাকে তুলে ধরেন।

কার্টুন নিছক কোনো ব্যঙ্গাত্মক আঁকিবুঁকি নয়; বরং একটি কার্টুনে থাকে ফান, থাকে বার্তা, থাকে একটি ঘটনার বিশ্লেষণ।

একটি কার্টুনে জটিল রাজনৈতিক বিষয়কে এমনভাবে তুলে ধরা যায়, অনেক সময় অনেক পৃষ্ঠা লিখেও যা প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। যেখানে বাকস্বাধীনতা সংকুচিত, সেখানে কার্টুন হয়ে উঠতে পারে সত্য প্রকাশের এক শক্তিশালী মাধ্যম। কেননা, কার্টুনে পরোক্ষভাবে যেকোনো জটিল বিষয়কে তুলে ধরা যায়।

তবে সব কার্টুন যেমন সাংবাদিকতা নয়, তেমনি সব কার্টুন রাজনৈতিক বা সম্পাদকীয় কার্টুন নয়। একটা ভালো মানের ড্রয়িং একটা ভালো শিল্পকর্ম হতে পারে, ভালো ক্যারিকেচার হতে পারে কিংবা ভালো একটা ইলাস্ট্রেশন হতে পারে।

একটা ভালো মানের কার্টুন মানে মোটেই ভালো ড্রয়িং নয়; বরং এতে অবশ্যই একটা বার্তা থাকতে হবে। একঝলকেই পাঠক, দর্শক যেন সেই বার্তাটা পেয়ে যেতে পারেন।

ছোট্ট ফ্রেমে আঁকা একটা কার্টুনই তুলে ধরতে পারে একটি ঘটনা, প্রেক্ষাপট বা রাজনৈতিক অবস্থার পুরো চিত্র। এখানে ড্রয়িং প্রকাশের একটা মাধ্যম মাত্র। কার্টুনে কী বার্তা দেওয়া হচ্ছে, সেটাই মুখ্য।

ধরুন, আপনি একটা কিছু লিখেছেন। হাতের লেখাটা অসাধারণ সুন্দর। দেখে হয়তো চোখ জুড়াবে। কিন্তু কী লিখেছেন, তা কারও বোধগম্য নয়. অর্থাৎ লেখার বক্তব্য অস্পষ্ট, কী বলতে চেয়েছেন, তা পরিষ্কার নয়।

তাহলে এ সুন্দর হাতের লেখাটা অনেকটা মূল্যহীন। তেমনি সুন্দর ড্রয়িং দেখে হয়তো আমরা মুগ্ধ হব, কিন্তু কার্টুনে যদি কোনো বার্তা না থাকে বা কী বলতে চাওয়া হয়েছে, তা যদি বোধগম্য না হয়, তাহলে সেটাকে কোনো রাজনৈতিক বা সম্পাদকীয় কার্টুন হিসেবে বিবেচিত হবে না। সেটাকে বরং একটা শিল্পকর্ম বলা যেতে পারে।

একটা ভাবগম্ভীর শিল্পকর্ম আর কার্টুন মোটেই এক জিনিস নয়। একটা রাজনৈতিক বা সম্পাদকীয় কার্টুনে অবশ্যই একটা বার্তা, একটা বিশ্লেষণ থাকতে হবে এবং তা সাংবাদিকতার রীতিনীতি অনুসরণ করে।

সুতরাং একজন রাজনৈতিক কার্টুনিস্টকে, সাংবাদিকতা, রাজনীতি, অর্থনীতি সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। চলতি ঘটনাপ্রবাহের প্রতি সার্বক্ষণিক নজর রাখতে হবে।


হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নীমান রিপোর্ট ও কলম্বিয়া জার্নালিজম রিভিউয়ে রাজনৈতিক কার্টুনকে সাংবাদিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

পশ্চিমা বিশ্বের সংবাদপত্রে কার্টুন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পশ্চিমা সাংবাদিকতায় রাজনৈতিক বা সম্পাদকীয় কার্টুন বহুদিন ধরেই একটি শক্তিশালী মতপ্রকাশের অনন্য মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

কার্টুন শুধু নিছক কোনো শিল্পকর্ম নয়; বরং শিল্প, ব্যঙ্গ ও সাংবাদিকতার এক দুর্দান্ত মেলবন্ধন, যা জটিল রাজনৈতিক বার্তা মাত্র একঝলকেই পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেসকো বলছে, সম্পাদকীয় কার্টুন হচ্ছে এমন একধরনের সাংবাদিকতা, যেখানে শৈল্পিক দক্ষতা ও ব্যঙ্গ একত্র হয়ে কর্তৃত্বকে প্রশ্ন করে এবং অন্যায় তুলে ধরে।

এ মন্তব্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি দেয় যে সম্পাদকীয় কার্টুন গণতন্ত্রের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ।

পশ্চিমা বিশ্বে সম্পাদকীয় কার্টুন আইনগতভাবে স্বীকৃত। যুক্তরাষ্ট্রে এগুলো সংবিধানের প্রথম সংশোধনী অনুযায়ী মতপ্রকাশের স্বাধীনতার আওতায় পড়ে। আদালত পর্যন্ত স্বীকার করেন, কার্টুন মতপ্রকাশের একটি সৃজনশীল ও সুরক্ষিত মাধ্যম।

আমাদের দেশের ভালো মানের সংবাদপত্রগুলোতে কার্টুন বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। পাঠকও কার্টুন দারুণভাবে উপভোগ করেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তি, সরকার কার্টুনের ব্যাপারে একটু বেশি স্পর্শকাতর।

ফলে কার্টুনিস্ট ও সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে একধরনের সেলফ সেন্সরশিপ কাজ করে। ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের সংবাদপত্রের পাতায় কার্টুন কমে এসেছে, যা হতাশাজনক।

একজন কার্টুনিস্ট হিসেবে আমার প্রত্যাশা থাকবে, আগামী দিনের রাজনীতিক হোক উদার, সরকার হোক কার্টুনবান্ধব। কেননা, কার্টুন সরকারের ভুলত্রুটি তুলে ধরে, যা একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য সহায়ক।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor