জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও ভিসি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন প্রতিবাদী প্ল্যাকার্ড ও ‘চুপ’ লিখা কাগজে মুখ ঢেকে কর্মসূচিতে অংশ নেন শিক্ষার্থীরা। এর আগে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে কুমিল্লায় গ্রামের বাড়িতে আত্মহত্যা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী। ওই ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়টির আইন বিভাগের ১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। গত ১৫ মার্চ রাত ১০টার দিকে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ফাইরুজ অবন্তিকা রশিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেন।
অবন্তিকার কয়েকজন বন্ধু জানিয়েছেন, তিনি ফেসবুক পোস্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহপাঠীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের নিপীড়নের অভিযোগ করেন। ওই পোস্টে একজন সহকারী প্রক্টরের বিরুদ্ধে নানা হয়রানিসহ নিপীড়নের অভিযোগ করেন। ফাইরুজ ওই পোস্টে সহকারী প্রক্টরকে নিপীড়নের কাজে শিক্ষার্থীর অন্যায় আচরণে সহযোগিতার অভিযোগ করেন। ভুক্তভোগী মেয়েটি দৃশ্যত এ অবস্থায় চুপ থাকতে বাধ্য হন। সাধারণভাবেই বোঝা যায়, চরম অসহায়ত্বের মুখে তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন।
অথচ চার মাস আগে প্রক্টরকে লিখিতিভাবে অভিযোগ জানান ফাইরুজ। গত বছরের ১৪ নভেম্বর তৎকালীন প্রক্টরের কাছে ওই অভিযোগ করা হয়। তবে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আইন বিভাগের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে করা ওই আবেদনের একটি অনুলিপির প্রমাণ রয়েছে পরিবারের হাতে। ফাইরুজ তার আবেদনে অভিযোগ করেছিলেন, প্রথম বর্ষে পড়ার সময় তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেন শিক্ষার্থী রায়হান। তাতে তিনি রাজি হননি। এরপর থেকেই রায়হান উত্ত্যক্ত ও হয়রানি শুরু করে। তৎকালীন প্রক্টরের কাছে ফাইরুজ আরো অভিযোগ করেন, রায়হান তাকে দেখে অশ্লীল মন্তব্য করত। প্রতিবাদ করলে হুমকি ও নিপীড়ন আরো বাড়াত। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ফাইরুজের বাবা মারা যায়, তার অসহায়ত্ব আরো বাড়ে। ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললে রায়হান প্রক্টর ও প্রশাসনে ক্ষমতার সংশ্লিষ্টতা দেখিয়ে ভয় দেখাত। এ পরিস্থিতিতে ফাইরুজ কিছুদিন ক্লাস করেননি। কুমিল্লার বাড়িতে চলে যান। সে সময়ে নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়ে তৎকালীন প্রক্টরকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন। তথ্য-প্রমাণ বলে, ওই সময়ও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সব কিছু মিলে এটি দিবালকের মতো সত্য যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা, গাফিলতি ও দলতন্ত্রের কারণে একটি মেয়েকে নির্মমভাবে জীবন দিতে হলো। ঘটনা ঘটার পর ক্ষোভ প্রশমনের জন্য লোকদেখানো ব্যবস্থা নেয়া হয়।
ফাইরুজের ওই পোস্টের পরপরই জানা যায়, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। পরিবারের সদস্যরা জানান, কুমিল্লায় অবস্থানরত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। দায়িত্বরত চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ফাইরুজের আত্মহত্যার খবর বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছালে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ফাইরুজের আত্মহত্যার খবর তাদেরকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। অভিযোগ ওঠা ছাত্র ও শিক্ষককে দায়ী করা মামলায় তাৎক্ষণিকভাবে সাময়িক বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সহকারী প্রক্টরকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ঘটনা তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়ের করা মামলায় অভিযুক্ত সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মানকে দু’দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত, শিক্ষককে এক দিনের। ঘটনার প্রতিবাদে আইন বিভাগ দু’দিনের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করেছে। এদিকে নিপীড়নের বিরুদ্ধে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা অবস্থান ধর্মঘট শুরু করেন। এর পর থেকে ফাইরুজের আত্মহত্যার ঘটনায় নানা কর্মসূচি পালন করে চলেছেন শিক্ষার্থীরা। সারা দেশে বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন ও হত্যা-ধর্ষণের অগণিত ঘটনা ঘটলেও কোথাও দৃশ্যমান কঠোর বিচার হয়নি। ভুক্তভোগীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চুপ থাকতে বাধ্য হয়েছেন। কেউবা ফাইরুজের মতো আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। সমাজ থেকেছে নির্বিকার। প্রশাসন ক্ষমতাসীনদের দাপটে চুপ থেকেছে। তার মানে হলো- এ ধরনের বিষয়ে নিষ্ক্রিয় হয়েছে গোটা কাঠামো। ‘চুপ’ সংস্কৃতি আমাদের পেয়ে বসেছে। কোথাও কোনো অপরাধীর শাস্তি নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অভিযোগগুলো ক্ষমতাধারীদের বিরুদ্ধে। সুতরাং ‘চুপ!’
বিগত বছরগুলোতে এ ধরনের ঘটনা এতই ঘটেছে যে, লিখতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। ফাইরুজের ঘটনার পরপরই ওই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী অভিযোগ করেছেন, তাকে হত্যাসহ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের হুমকি দেয়া হয়েছে। জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ১৮ মার্চ তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় নিজ বিভাগের এক শিক্ষক ও বিভাগের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন। ওই শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, ২০২১ সালে তার বিভাগের এক শিক্ষক তাকে যৌন হয়রানি করেন। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যের কাছে অভিযোগ করেন তিনি। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা উপাচার্য নেননি। ওই উপাচার্যের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে দলতন্ত্রের অভিযোগ ছিল। ওই বিভাগের চেয়ারম্যান ও অভিযুক্ত শিক্ষক উল্টো তাকে অভিযোগ তুলে নিতে নানাভাবে চাপ দিয়ে আসছেন। তারা তাকে হাত-পা কেটে হত্যা করাসহ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের হুমকিও দিয়েছেন। ওই শিক্ষার্থী আরো অভিযোগ করেন, পরীক্ষায় শূন্য নম্বর দিয়ে ফেল করানো হয়েছে তাকে। এমনকি স্নাতকের চূড়ান্ত মৌখিক পরীক্ষায় তাকে অকৃতকার্য করানো হয়। এসবের ফলে অবশেষে ফাইরুজকে আত্মহত্যা করতে হয়।
আত্মহত্যা কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়। আমাদের ধর্ম, সমাজ ও নৈতিকতা আত্মহত্যাকে অনুমোদন করে না। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ফাইরুজ আত্মহত্যার বিপরীতে ব্যক্তি, সমাজ ও তার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেঁচে থাকার কোনো অনুপ্রেরণা পাননি। সম্ভবত ফাইরুজের পিতৃবিয়োগ ও সামাজিক অসহযোগিতা তাকে তিলে তিলে দিনে দিনে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। আমাদের সমাজে মেয়েদের অবস্থান এখনো এত শক্ত নয় যে, একজন ফাইরুজ একা একা কঠিন কঠিন সময় অতিক্রম করবেন। একটি বিশ্লেষণে এসেছে, ‘পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র তো এখন বিষাদগ্রস্ততা সরবরাহের পাইপলাইন। যার কারণে আদর্শবাদী রাজনীতি আত্মহত্যার জন্য যতটা না ব্যক্তিকে দায়ী করে, তার চেয়ে বেশি পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের দিকেই আঙুল তোলে বেশি। এসবই কোনো না কোনোভাবে ব্যক্তিকে বাধ্য করে আত্মহত্যা করতে। আত্মহত্যা অবশ্যই হত্যা। সেই হত্যা ব্যক্তি নিজেকে নিজেই করে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যার কারণে দেশের আইনে আত্মহত্যা একটি অপরাধ। আত্মহত্যা চেষ্টাকারীর বিরুদ্ধে মামলা হওয়ারও বিধান আছে। এর বাইরেও আত্মহত্যা কেন হত্যা, এ নিয়েও সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে আলোচনা আছে।
এ অবস্থা শুধু ফাইরুজের নয়, দেশের সর্বত্রই একই দৃশ্য। প্রতিদিন গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবর পত্রিকার পাতায় পাতায় প্রকাশিত হয়। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা যদি বলেন, তাহলে গত এক-দুই মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং অবশেষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। অবাক হওয়ার মতো বিষয়, স্কুলগুলোও এই অভিশাপ থেকে মুক্ত নয়। ভিকারুননিসা স্কুলের ঘটনাগুলো আপনাদের মনে থাকার কথা। নোয়াখালীতে গত নির্বাচন এবং এবারের তথাকথিত নির্বাচনের আগে-পরে যে ঘটনাবলি ঘটেছে তা রাজনৈতিক ধর্ষণ ব্যতীত অন্য কিছু নয়। প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতায় এ ধরনের খবর আসছে। এই সেদিন রাজধানীর রায়েরবাজার এলাকায় কিশোর গ্যাং এক নারীকে কুপিয়েছে এই অপরাধে যে, সে পুলিশকে তথ্য দিয়েছে। শুধু নারীর শ্লীলতাহানিই নয়, ক্ষমতাসীন প্রশাসন নির্বাচনকে যেভাবে বোগাস করে ফেলেছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যায় না। এসব যেন সবার গা সওয়া হয়ে গেছে। সুতরাং ‘চুপ’। বিচারব্যবস্থা যখন তারা নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত করেছে, কথা বললেই মামলা আর সাজা। সুতরাং ‘চুপ’। দলতন্ত্রে আমলাতন্ত্রের অবস্থা যখন বেহাল, তাদের বিশ্বস্ততা অর্জন না করতে পারলেই হেনস্তা। সুতরাং ‘চুপ’।
গণমাধ্যমে যারা প্রতিবাদ করেন তাদের জন্য রয়েছে ডিজিটাল মামলা। হামলা ও চাকরিচ্যুতিও ঘটছে। যারা এখনো বিবেকের তাড়না বোধ করেন তাদের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দেয়া হয়। সুতরাং ‘চুপ’। ফাইরুজের এই অপমৃত্যু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, আমাদের গোটা শিক্ষকসমাজ, প্রশাসন ও সিভিল সোসাইটি সম্পর্কে একটি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার চিত্র উদ্ঘাটন করেছে। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তথা সাধারণ শিক্ষক সম্পর্কে আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। এ দেশে শিক্ষকতার একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা আছে। নিকট অতীতে আমাদের মহৎ বুদ্ধিজীবীরা অন্য পেশায় পারঙ্গমতা সত্ত্বেও শিক্ষকতার মতো মহৎ পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন সম্মানের জন্য, স্বকীয়তার জন্য ও স্বতন্ত্র মর্যাদার জন্য। সম্ভবত সেই মর্যাদার প্রশ্নটি প্রান্তিক পর্যায় অতিক্রম করছে। আমার বিবেক বলছে, অন্তত শিক্ষকসমাজের আর চুপ থাকার সময় নেই। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম, চুপ থাকার জন্য নয়। নিজেদেরকে প্রকাশ করার জন্য। একটি নৈতিক উন্নত জাতির জন্য। ‘এইসব দিনরাত্রী’র পর ছড়াকার আবু সালেহের মতো বলতে ইচ্ছা করে- ‘ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, বলা যাবে না কথা/ রক্ত দিয়ে পেলাম শালার এমন স্বাধীনতা!’
Publisher & Editor