শেষ পর্যন্ত জুলাই সনদ কতটুকু বাস্তবায়ন হবে কিংবা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে সেটা নিশ্চিত নয়, কিন্তু এটা নিশ্চিত—সংস্কার, জুলাই সনদ, গণপরিষদ, গণভোট এই শব্দগুলো রাজনীতিসচেতন মানুষের কাছে আটপৌরে শব্দে পরিণত হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশন এবং বিশেষ করে ঐকমত্য কমিশনকে কেন্দ্র করে মূলধারার সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যথেষ্ট পরিমাণ আলোচনা, বিতর্ক এই প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে।
শেখ হাসিনার পতন এবং পলায়ন-পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার প্রশ্নে তাদের মতো করে আন্তরিক, এটা স্পষ্ট। কিন্তু এটাও আমরা খেয়াল করছি, সংস্কারের পরিমাণ, ব্যাপ্তি এবং সেটার বাস্তবায়নের সময় ও পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলো তীব্র বিতর্কে জড়িয়েছে।
এই বিতর্ক যে শুধু ঐকমত্য কমিশনে হয়েছে তা নয়, এই বিতর্ক ছড়িয়েছে মাঠে–ময়দানেও। এমনকি চলছে রাজনৈতিক কর্মসূচিও। এবারই সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট অনুষ্ঠান করার দাবিতে জামায়াতে ইসলামী এবং কিছু ইসলামি দল মাঠে জনসমাবেশ, মিছিল, মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি পালন করছে।
মোটাদাগে বলা যায় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত সংস্কারগুলোতে অপরাপর দলগুলোর তুলনায় বেশি দ্বিমত প্রকাশ করেছে বিএনপি। এবং এই দ্বিমত প্রকাশকে কেন্দ্র করে নানাভাবে বিএনপিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো। আকার-ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করা হয়েছে কম সংস্কার চাওয়ার মাধ্যমে বিএনপি নতুন করে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার মানসিকতার প্রমাণ দিয়েছে। অর্থাৎ এটাকে রাজনীতির লাভালাভের বিষয় বানিয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশন প্রাথমিক প্রস্তাবে বলেছিল প্রস্তাবগুলো পরবর্তী সংসদ প্রথম দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে। এই প্রস্তাবের সঙ্গে বিএনপি একমত হলেও জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ আরও বেশ কিছু দল প্রস্তাবটি মেনে নেয়নি। তারা চেয়েছে নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করতে হবে। এর মাধ্যমে অন্য দলগুলো বিএনপির ওপরে অনাস্থা জনগণের সামনে প্রকাশ করেছে। এখানেও আছে রাজনৈতিক লাভালাভের প্রশ্ন।
ঐকমত্য কমিশনে বিএনপি যেভাবে আলোচনা করেছে, তাতে যৌক্তিকভাবেই মনে হয় যতটুকু সংস্কারের সঙ্গে বিএনপি একমত হয়েছে, সেটুকু তারা নিশ্চয়ই বাস্তবায়ন করবে। বাস্তবায়নের সদিচ্ছা না থাকলে দলটি একমত হয়নি, এমন অনেক ব্যাপারে আপাত–মতৈক্য দেখিয়ে সমালোচনা এড়াতে পারত। কিন্তু সেটা না করে বিএনপি তার অবস্থানে শক্ত থেকেছে। এর ফলে দীর্ঘদিন নাগরিক সমাজে আলোচিত কিছু মৌলিক কাঠামোগত সংস্কারের সঙ্গে দ্বিমত হওয়ায় বিএনপি সমালোচিত হয়েছে।
সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আলাপে জামায়াতে ইসলামী বেশ আগে থেকেই ছিল। শেখ হাসিনার পতনের পর তারা এটার কথা বললেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রাথমিক প্রস্তাবের পর আলোচনায় জামায়াতে ইসলামী এই দাবি তোলেনি। কিন্তু তিন মাস আগে ঢাকায় মহাসমাবেশ করে জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী আন্দোলন সংসদ নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পক্ষে বেশ কঠোর অবস্থান নেয়। শুধু তাই না, পরবর্তী সময়ে জামায়াতে ইসলামী বিভাগ, জেলা এমনকি উপজেলা পর্যায়েও এই দাবিতে মিছিল, সমাবেশ করেছে।
জামায়াতে ইসলামী এই সংসদ নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে করাতে ব্যর্থ হওয়া তার নির্বাচনের ফলে প্রভাব পড়তে পারে ভেবে নিশ্চয়ই শঙ্কিত। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের অবর্তমানে জামায়াত যখন বিএনপির বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলা এমনকি তাকে পরাজিত করার স্বপ্ন দেখছে, তখন এটা তাদের জন্য বড় রাজনৈতিক মূল্য চোকানোর কারণ হতে পারে। অর্থাৎ জামায়াতকে একটা বিজয় নিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এখানেই আছে গণভোট নিয়ে রাজনীতির প্রশ্ন।
সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে জামায়াতকে বেশ প্রাসঙ্গিক রেখেছে লম্বা সময়। মূলধারার সংবাদমাধ্যমের খবরে, টক শোতে সামাজিক মাধ্যমে তুমুল আলোচনা-বিতর্ক হয়েছে এমন একটি ইস্যুতে, যেটা আলোচনায় আসার কথাই ছিল না। কারণ, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (উচ্চকক্ষ চালু হলে যা হবে নিম্নকক্ষ) সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নির্বাচন আমাদের মতো অত্যন্ত অবিকশিত গণতন্ত্রের (গত দেড় দশক সেটাও ছিল না) দেশে মোটেও উপযোগী নয় তো বটেই, এটা সরকারের স্থায়িত্ব নষ্ট করে রাষ্ট্রকে মারাত্মকভাবে অস্থিতিশীল করে তুলবে, এটা মোটামুটি একটা সেটেল্ড ইস্যু ছিল।
রাজনৈতিক দলগুলো যা যা বলে সব সময় সেটা যে আন্তরিকভাবে ধারণ করে, সেটা না–ও হতে পারে। দলগুলোর মুখে অনেক সময় অনেক বক্তব্য থাকে, যেটা কারও প্রতি কোনো বার্তা বা চাপ প্রয়োগের জন্য হয়।
আমি বিশ্বাস করি, নিম্নকক্ষে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নির্বাচন এবারই নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে জামায়াতে ইসলামী নিজেও সম্ভবত এটা নিয়ে আশাবাদী ছিল না; বিভিন্ন সংসদীয় এলাকায় জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীরা বিদ্যমান পদ্ধতি মাথায় রেখেই তুমুল নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন অনেক দিন থেকেই। এটা নিয়ে কর্মসূচি মূলত চাপ প্রয়োগ বা শক্তি প্রদর্শনের (সরকার বা বিএনপিকে) উদ্দেশ্যেই ছিল। কিন্তু ইস্যুটিকে কেন্দ্র করে অনেক মনোযোগ পাওয়া এবং আলোচনার কেন্দ্রে থাকা জামায়াতকে অনেক বেশি দীর্ঘ সময় ইস্যুটি নিয়ে পড়ে থাকতে প্রলুব্ধ করেছে। ফলে একটা আন্দোলন করে জামায়াত পরাজিত হয়েছে, এমন একটা বোধ জনগণের মধ্যে তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচনের আগে কোনো রাজনৈতিক দল একটা আন্দোলনের বিজয় নিয়ে নির্বাচনে যেতে চায়। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে এমন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনে ভালো করার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। জামায়াতে ইসলামী এই সংসদ নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে করাতে ব্যর্থ হওয়া তার নির্বাচনের ফলে প্রভাব পড়তে পারে ভেবে নিশ্চয়ই শঙ্কিত। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের অবর্তমানে জামায়াত যখন বিএনপির বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলা এমনকি তাকে পরাজিত করার স্বপ্ন দেখছে, তখন এটা তাদের জন্য বড় রাজনৈতিক মূল্য চোকানোর কারণ হতে পারে। অর্থাৎ জামায়াতকে একটা বিজয় নিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এখানেই আছে গণভোট নিয়ে রাজনীতির প্রশ্ন।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট নিয়ে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল মতৈক্যে পৌঁছেছিল। কিন্তু সেই নির্বাচন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে, নাকি আগেই হবে, সেটা নিয়ে আবার মতদ্বৈধতা তৈরি হয়েছে। সত্যি বলতে যে গণভোটে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে, সেই গণভোট জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করে ফেলবে না, সেটা বরং আগামী সংসদে বাস্তবায়ন করা হবে নাকি হবে না সেই প্রশ্নে। অর্থাৎ এই গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগে বা একই দিন করার ক্ষেত্রে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় সুবিধা–অসুবিধার বেশি কোনো সমস্যা আসলে নেই। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট আয়োজন করা নিয়ে জামায়াত এবং তার সহযোগী কয়েকটি দল এটা নিয়ে মাঠে চাপ জারি রাখছে।
একবার সংসদ নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে করা নিয়ে, আবার গণভোট আয়োজনের সময় নিয়ে মাঠে কর্মসূচি দিয়ে জামায়াত নিজের শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে সরকার ও বিএনপিকে চাপ প্রয়োগ যেমন করতে চায়, তেমনি আরও কয়েকটি ইসলামি দলকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনী মোর্চা তৈরির ক্ষেত্রেও সেটাকে কাজে লাগাতে চায়। কিন্তু গণভোট নিয়ে তাদের আন্দোলন আসলে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দাবিতে কর্মসূচির ‘পরাজয়কে’ ভুলিয়ে ‘জয়’ নিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার চেষ্টার অংশ বলে মনে করার যৌক্তিক কারণ আছে।
একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্রিয়াশীল সব রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র এবং জনগণের কল্যাণে সব বিষয়ে একমত হবে, এটা আশা করতে দোষ নেই, কিন্তু বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর পথপরিক্রমার ইতিহাস দেখলে দেখা যায়, ব্যবস্থাটা এভাবে কাজ করে না। রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণের কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে করা হবে, সেটা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর যেমন দর্শনগত পার্থক্য আছে, তেমনি আছে যেকোনো পদক্ষেপ নেবার ক্ষেত্রে নিজ দলের লাভ–ক্ষতির হিসাব। জনগণ, রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দলসহ সব অংশীজনের মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জনগণ এবং রাষ্ট্রের কল্যাণ নিশ্চিত করে। রাতারাতি সব সমস্যার সমাধান না হয়ে গেলেও এই ব্যবস্থা ক্রিয়াশীল রাখার মাধ্যমে জনগণের কল্যাণ এবং চাওয়াকে ক্রমে কার্যকর করা যায়।
Publisher & Editor