বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সহিংসতা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও পৌঁছে গেছে অনেক আগেই। যে–ই বিরোধী পক্ষে থাকে, সে–ই প্রবাসে চেষ্টা করেছে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে ও ক্ষমতায় থাকা মানুষদের প্রবাসে হেনস্তা করতে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখলাম যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপসহ সবখানেই আওয়ামী লীগের (দেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) সমর্থক দাবি করে এমন কিছু মানুষের সহিংস আচরণ।
সাম্প্রতিকতম ঘটনা হলো আমেরিকার নিউইয়র্কে জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেনকে লক্ষ্য করে ডিম ছোড়ার ঘটনা। প্রথম আলোর খবর নিশ্চিত করে যে এই হামলার সঙ্গে প্রবাসী আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরাই জড়িত ছিলেন। আখতার হোসেনের সঙ্গে ছিলেন সফরসঙ্গী হিসেবে আসা বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-সদস্যসচিব তাসনিম জারা।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা এ সময় তাসনিম জারাকে কটূক্তি বা অশ্লীল মন্তব্য করেন। বাংলাদেশের একজন জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ মির্জা ফখরুলও এই অশোভন আচরণ থেকে নিরাপদে ছিলেন না। তাঁরা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান।
এই ঘটনা মোটেই নতুন নয়। আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি, সুইজারল্যান্ডের জেনেভা বিমানবন্দরে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে একদল আওয়ামী লীগ সমর্থক হেনস্তা করেন। সাম্প্রতিক সময়ে লন্ডনে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ওপর হামলার চেষ্টা করেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। ওই সময় হাইকমিশনের গাড়িতে মাহফুজ আছেন, এই সন্দেহে গাড়ির ওপর ডিম নিক্ষেপ করা হয়। কয়েকজন গাড়ির সামনে শুয়ে পড়ার চেষ্টা করেন। তবে পুলিশের হস্তক্ষেপে তাঁদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
প্রথম আলো লন্ডন হাইকমিশনের বরাতে প্রতিবেদন করে, যাতে আমরা জানতে পারি ওই গাড়ির ভেতরে মাহফুজ আলম ছিলেন না। আওয়ামী লীগের ওই নেতা-কর্মীরা যে মাহফুজ আলমকেই টার্গেট করেছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ খুব কমই আছে।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্র সফরেও মাহফুজ আলমকে হেনস্তার চেষ্টা করে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা। নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেট ভবনের কাচের দরজা ভেঙে ফেলেন তাঁরা। এই ঘটনাগুলো আমাদের কয়েকটি প্রশ্নের মুখোমুখি করে। প্রথম প্রশ্ন, এই ঘটনার দায় কাদের? উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা সংগঠিতভাবে জুলাই আন্দোলনে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের ও বিশেষ করে যাঁরা সরকারে আছেন, তাঁদের টার্গেট করে আগ্রাসী বিক্ষোভ করেছেন, অনেক ক্ষেত্রেই সেটি সহিংস হয়েছে।
সরকারপন্থী কারও বিরুদ্ধে প্রবাসে বিক্ষোভ কি নতুন কিছু? যেমন ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে যখনই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রীয় বা ব্যক্তিগত সফর করেছেন, প্রতিবারই তাঁর অবস্থানস্থল, এয়ারপোর্ট ও অনুষ্ঠানস্থলের সামনে বিভিন্ন ধরনের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদী কর্মসূচি পালিত হয়েছে। যুক্তরাজ্যের বিএনপি মূলত এর আয়োজন করে।
বাংলাদেশি রাজনীতিতে প্রবাসে নেতাদের টার্গেট করে বিক্ষোভ বা লাঞ্ছনার ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সেটি আরও চরম পর্যায়ে চলে গেছে।
২০১৪, ২০১৮, ২০২৪–এর বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে অকেজো করে দিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল আওয়ামী লীগ। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। যার প্রেক্ষিতে ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ। এর নেতৃত্বও পালিয়ে গিয়ে বিদেশে আশ্রয় নেয়।
আওয়ামী লীগের বোঝা উচিত, জুলাই-আগস্ট মাসে যে হত্যাযজ্ঞের নেতৃত্ব তারা দিয়েছে, তার স্মৃতি মানুষের মন থেকে সহজে মুছে যাবে না। নিউইয়র্ক বা লন্ডনকে মঞ্চ বানিয়ে ক্ষমতা দেখিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বোঝানো হচ্ছে, তারা এখনো প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। কিন্তু প্রতীকী এই প্রদর্শন জনগণের কাছে উল্টো নেতিবাচক বার্তা দেয়। এই বিষয়ে সন্দেহ নেই যে আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে ফেরত আসতে মরিয়া। তবে তারা যে প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ প্রবাসে নিজেদের একত্রিত করে সরকার ও জুলাই আন্দোলনের জড়িত ব্যক্তিদের প্রতি আক্রমণাত্মক হয়ে রাজনীতিতে ফেরার চেষ্টা করে, তা বরং জনগণকে আরও বেশি ক্ষুব্ধ করে তোলে তাদের প্রতি। যদিও আওয়ামী লীগের বয়ানে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ‘সন্ত্রাসী কার্যক্রম’, কিন্তু সেই বয়ান দেশের মানুষের কাছে এবং আন্তর্জাতিক মহলেও অগ্রহণযোগ্য।
তাই আওয়ামী লীগ যদি মনে করে গায়ের জোরে ও সহিংসতা করে তারা রাজনীতিতে ফিরতে পারবে, তবে ভুল করবে। বিগত কয়েক মাসে তাদের প্রতি যদি কোনো সহানুভূতি তৈরি হয়েও থাকে, তবে এ ধরনের আচরণ মানুষের মধ্যে বিরক্তি ও ঘৃণার উদ্রেক করবে।
আওয়ামী লীগের বোঝা উচিত, জুলাই-আগস্ট মাসে যে হত্যাযজ্ঞের নেতৃত্ব তারা দিয়েছে, তার স্মৃতি মানুষের মন থেকে সহজে মুছে যাবে না। নিউইয়র্ক বা লন্ডনকে মঞ্চ বানিয়ে ক্ষমতা দেখিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বোঝানো হচ্ছে, তারা এখনো প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। কিন্তু প্রতীকী এই প্রদর্শন জনগণের কাছে উল্টো নেতিবাচক বার্তা দেয়।
এখন আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে, প্রবাসে আওয়ামী লীগের এসব সহিংস আচরণে সরকারের দায় কী? বিশেষ করে নিউইয়র্কে যে বিষয়টি ঘটেছে, তার দায় সরকার ও নিউইয়র্কের বাংলাদেশের কনস্যুলেট অফিস এড়াতে পারেন না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া ভিডিওগুলো স্পষ্টভাবে দেখায় যে সেখানে প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী রাজনীতিবিদদের নিরাপত্তার অভাব ছিল। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এমন ধারণা করা ভুল নয় যে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এমন কাজ করতে পারেন, তবে কেন সরকার ও নিউইয়র্ক কনস্যুলেট ঘটনার মোকাবিলার জন্য যথাসম্ভব পূর্বপরিকল্পনা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলো?
অন্যদিকে এই হামলার ঘটনায় যে প্রতিক্রিয়া দেশের অভ্যন্তরে আমরা দেখছি, তা আশঙ্কাজনক। কেউ কেউ হামলাকারীদের ছবি শেয়ার করে তাদের পরিবারের ‘খোঁজ খবর’ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
একজন লিখেছেন, নিউইয়র্কে সরকারি প্রোটোকলের দায়িত্বে থাকা কনস্যুলেট অফিসারদের একটি তালিকা চাই—প্রশ্ন উঠেছে, তাঁরা এই তালিকা নিয়ে কী করবেন; আইন কি নিজেদের হাতে নেবেন? তাঁদের রাগ ও ক্ষোভের উৎস আওয়ামী লীগের কর্মীদের অবিবেচক আচরণ।
সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা যায় পারস্পরিক উগ্রতা (রেসিপ্রোক্যাল র্যাডিকালাইজেশন), যেখানে এক পক্ষের সহিংসতা অপর পক্ষকে আরও উত্তেজিত করে তোলে। কিন্তু এই উত্তেজনা আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে? আমরা কি আরও সহিংসতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি?
যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন কিংবা সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তা শুধু বাংলাদেশি রাজনীতির নোংরামির ধারাবাহিকতা নয়, বরং এগুলো দেখায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতা এখন আর অভ্যন্তরীণ পরিসরে সীমাবদ্ধ নেই, সেটা ট্রান্স-ন্যাশনালাজাইড হয়েছে।
এই মুহূর্তে বিবদমান পক্ষগুলো এই সহিংসতার মাধ্যমে প্রতীকী ক্ষমতার প্রদর্শন করছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ দেখাতে চাচ্ছে যে প্রবাসের মাটিতে তারা রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম রেখেছে। কিন্তু এতে লাভ কি আওয়ামী লীগের?
এতে করে তাদের প্রতি মানুষের ক্ষোভ ও রাগ আর বাড়বে। এ ধরনের আচরণ দেশে থাকা আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতা-কর্মীদের আরও বিপদের মুখে ঠেলে দেবে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বও যাঁরা প্রবাসে থেকে এসব কাজের ইন্ধন দিচ্ছেন, তাঁদের বোঝা উচিত, সহিংসতা করে, মানুষকে হেনস্তা করে জনসমর্থন পাওয়া যায় না।
প্রবাসী সম্প্রদায় প্রায়ই নিজ দেশের রাজনীতির সম্প্রসারণ হিসেবে কাজ করে।সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, ডায়াসপোরা রাজনীতি ‘হোমল্যান্ড পলিটিকস’ ও ‘হোস্টল্যান্ড পলিটিকস’-এর মাঝামাঝি এক অস্বস্তিকর অবস্থানে থাকে। এই অস্বস্তিকর অবস্থানে যদি নেতারা সহিংসতার উসকানি দেন, তবে তার রাজনৈতিক ফলাফল ভালো হয় না।
বাস্তবতা হলো প্রবাসী রাজনৈতিক সহিংসতা শুধু বিদেশে অশান্তি তৈরি করবে না, বরং বাংলাদেশের রাজনীতিকে আরও অস্থিতিশীল করবে। পাশাপাশি সরকার কূটনৈতিক পর্যায়ে নিরাপত্তাসংকট পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিদেশের মাটিতে দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা ব্যর্থতা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সংঘাতকে আরও উসকে দেবে।
Publisher & Editor