শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৫

দীর্ঘ সংস্কার আলোচনায় অর্জন কতখানি

প্রকাশিত: ১২:৩২, ২৩ অক্টোবর ২০২৫ |

জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতি এড়ানো যেত বলেই মনে হয়। সংস্কার উদ্যোগের শুরুতে কিন্তু বলা হয়েছিল, রাজনৈতিক দলগুলো একমত না হলে কোনো সুপারিশ নিয়ে সরকার এগোবে না।

পরে দেখা গেল, ঐকমত্য না হওয়া ইস্যুগুলোতেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বারবার বৈঠক করছে আপত্তি জানানো দলের সঙ্গে। ঐকমত্য কমিশন সাংবিধানিক সংস্কারেও উৎসাহী। এগুলো ‘মৌলিক সংস্কার’ বলে বর্ণিত হচ্ছে। এতে মাঠে থাকা দলগুলোর কোনোটারই তীব্র আপত্তি ছিল না। তবে মৌলিক সংস্কারের সব ইস্যুতে এখনই একমত হওয়া তো কঠিন।

বেশ কিছু প্রশ্নে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে রেখেছে একটি বড় রাজনৈতিক দল। এর পক্ষে যুক্তিও দিচ্ছে অকুণ্ঠিতভাবে। নোট অব ডিসেন্টসহ গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে জুলাই সনদে। তাতে আবার প্রশ্ন উঠেছে, আপত্তির বিষয়গুলোতেও গণভোট হবে কীভাবে?

বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার, এমনকি রাষ্ট্র সংস্কার প্রয়োজন বৈকি। গণ-অভ্যুত্থানে চরম স্বেচ্ছাচারী সরকারটির পতন ঘটেছে বলেই নয়; সেই সরকার থাকাকালেও রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্ন সামনে এসেছিল। এক-এগারোর সময়, এমনকি প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও সংস্কারের প্রয়াস নেওয়া হয়। দুর্ভাগ্যবশত প্রক্রিয়াটি এগোয়নি। এ ক্ষেত্রে কিছু বিপরীতমুখী ঘটনাও ঘটে।

জাতীয় নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের ঘটনা স্মরণ করা যায়। নতুন করে কালাকানুন চাপিয়ে নাগরিক অধিকার হরণও বহুল আলোচিত। এ অবস্থায় সংস্কারের মাধ্যমে গণতন্ত্র জোরদারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। নজিরবিহীন গণ-অভ্যুত্থানের পর এ কাজে বিপুল উৎসাহও পরিলক্ষিত হয়। এর ভেতর দিয়ে আসা সরকারও স্বভাবতই উৎসাহ দেখায় সংস্কারে।

দুই ধাপে গঠিত হয় ১১টি সংস্কার কমিশন। অর্থনীতি ও শিক্ষা সংস্কারে কমিশন না হওয়ার ঘটনাও কম আলোচিত নয়। তা সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে এর পরবর্তী ঘটনাবলিতে সরকার খুব প্রশংসিত হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ সংস্কার সংলাপে অস্থিরতার মধ্যেও দীর্ঘ সময় ব্যয় হওয়া। তারপরও সংলাপে অংশগ্রহণকারী সব পক্ষ যদি জুলাই সনদে স্বাক্ষর করত!

এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামী সংস্কার প্রশ্নে কাছাকাছি ছিল। সনদ শুধু নয়, এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়েও তাদের বক্তব্যের মিল হচ্ছিল পরিলক্ষিত। ধারণা ছিল, উভয় পক্ষই সনদে স্বাক্ষর থেকে বিরত থাকবে। যে বিবেচনাতেই হোক, জামায়াত শেষ মুহূর্তে এতে স্বাক্ষর করে সনদের মর্যাদা অটুট রেখেছে। এতে হাঁফ ছেড়েছে সরকার; বিএনপিও আশ্বস্ত হয়েছে। মাঝখান দিয়ে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে।
সংস্কারসংক্রান্ত জুলাই সনদ নিয়ে সবচেয়ে বেশি উৎসাহী দলটিই এতে স্বাক্ষর করেনি। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র-তরুণদের ভেতর থেকে গঠিত এ দলের স্বাক্ষর আদায়েই সম্ভবত ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত।

এর আগে দুই দফায় দুই মাস এর মেয়াদ বাড়ানো হয় মৌলিক সংস্কারে দলগুলোকে নিকটবর্তী করতে। অতিরিক্ত সময় ব্যয় হলেও এ ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত অগ্রগতি কিন্তু আসেনি। এর মধ্যে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে না থাকা বিষয় অর্থাৎ নিম্নকক্ষেও পিআর চালুর দাবিতে আন্দোলনে নামে কিছু দল। দ্রুতই আবার বিভক্তি আসে তাদের মধ্যে। এর মধ্যেও সংস্কার আলোচনা অব্যাহত থাকা অবশ্য ইতিবাচক।

জুলাই সনদে মাঠে থাকা প্রধান দুই দল স্বাক্ষর করাটাও ইতিবাচক ঘটনা। কেননা আসছে নির্বাচনে তারা প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হবে বলেই ধারণা সবার। তারা নির্বাচনে থাকলে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতেও প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভাব হবে না।

জুলাই সনদের সঙ্গে নির্বাচনে অংশগ্রহণ অবশ্য সরাসরি সম্পর্কিত নয়। এতে স্বাক্ষর না করেও এনসিপি ও অন্যান্য দল নির্বাচনে যেতে পারবে। দলীয় প্রতীক ঘিরে ইসির সঙ্গে এনসিপির সম্পর্কের অবনতি অবশ্য স্পষ্ট। জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার ঘটনায় বোঝা যাচ্ছে, সরকারের সঙ্গেও আগেকার সুসম্পর্ক তার নেই।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈঠকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। ২২ জুন রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈঠকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। ২২ জুন রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতেফাইল ছবি
এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামী সংস্কার প্রশ্নে কাছাকাছি ছিল। সনদ শুধু নয়, এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়েও তাদের বক্তব্যের মিল হচ্ছিল পরিলক্ষিত। ধারণা ছিল, উভয় পক্ষই সনদে স্বাক্ষর থেকে বিরত থাকবে। যে বিবেচনাতেই হোক, জামায়াত শেষ মুহূর্তে এতে স্বাক্ষর করে সনদের মর্যাদা অটুট রেখেছে। এতে হাঁফ ছেড়েছে সরকার; বিএনপিও আশ্বস্ত হয়েছে। মাঝখান দিয়ে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে।

‘জুলাই যোদ্ধা’সহ কিছু রাজনৈতিক দলকে সন্তুষ্ট করতে একেবারে শেষ মুহূর্তেও সনদে কিছু বদল আনে ঐকমত্য কমিশন। সনদে স্বাক্ষরকারীরা এতে বাদ সাধেনি বলে রক্ষা। এখন এনসিপিসহ বামপন্থী দলগুলোর আপত্তি দূরীকরণের প্রয়াস সম্ভবত জোরদার করা হবে। এরই মধ্যে সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতির বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। সেটা নিয়ে নতুন করে জটিলতা সৃষ্টির শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

গণভোটের সময় আর আগামী সংসদের ধরন নিয়ে মতপার্থক্য দূরীকরণও সহজ নয়। ভোটের সঙ্গে গণভোট নাকি, ভোটের আগে গণভোট—এ প্রশ্নের নিষ্পত্তিও কম জরুরি নয়। ভোটের আগে গণভোট হলে এতে প্রাপ্ত রায় অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকার কতখানি এগোবে, তারও নিষ্পত্তি হতে হবে।

সংস্কারের এমন কিছু সুপারিশে ‘রাজনৈতিক ঐকমত্য’ রয়েছে, যেগুলো বিধিবিধান সংশোধন করেই বাস্তবায়ন করা যায়। জুলাই সনদে স্থান দেওয়ার আগেই এগুলোর বাস্তবায়ন শুরু হয়ে যেতে পারত। এতে সরকারের বাস্তবায়ন দক্ষতাও বিচার করে দেখা যেত।

পরিস্থিতি দেখে প্রশ্ন জাগছে, ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ এসব সংস্কারও কি নির্বাচিত সরকার সম্পন্ন করবে? এর বাইরে সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে সম্পর্কিত সংস্কারের বাস্তবায়ন অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সংগত কি না, এ বিতর্ক রয়েই গেছে। আগেভাগে গণভোট হয়ে এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বৈধতা মিললেও মৌলিক সংস্কারে যাওয়ার সময়ও সম্ভবত পাচ্ছে না সরকার।

এরই মধ্যে ইসিকে সক্রিয় হয়ে উঠতে হয়েছে; কেননা ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন। নির্বাচনব্যবস্থা–সংক্রান্ত কিছু সংস্কার আবার অসম্পন্ন। অনেকে এমনটিও বলছিলেন, শুধু নির্বাচন–সংক্রান্ত সংস্কার সেরে দ্রুত নির্বাচনে যাওয়াটাই সংগত। এতে গণ-অভ্যুত্থানে বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে শৃঙ্খলায় এনে তাতে গতি সঞ্চার করাটাও সহজ হতো। এমনটিও বলা হয়েছিল, সুনির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন আয়োজনের দিকে যেতে থাকার সময় সংস্কার সংলাপ চালিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু সরকার শুরু থেকে সে ধারায় এগোয়নি। এগিয়েছে অনেক পরে। এতে চূড়ান্ত লক্ষ্য তথা নির্বাচন ঘিরে অস্পষ্টতা আর অবিশ্বাসও বেড়ে উঠেছিল।

দীর্ঘ সংস্কার আলোচনায় অবশ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য আবশ্যক করণীয়গুলো স্পষ্ট হয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও বেড়েছে এ–সংক্রান্ত উপলব্ধি। এটা নতুন অভিজ্ঞতা। তবে নিকটেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে রয়েছে নির্বাচন। জুলাই সনদের সিংহভাগ বাস্তবায়িত না হলেও নির্বাচনটি প্রায় শতভাগ গ্রহণযোগ্য হতে হবে। এর মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটলেও সংস্কার, বিশেষত রাষ্ট্র সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হিসেবেই থাকবে সামনে।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor