পাকিস্তানে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দৃশ্যমান সম্পর্কোন্নতি এবং ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে কিছুটা টানাপোড়েনকে ঘিরে বেশ উৎসাহের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সময় এসব কৌশলগত পরিবর্তন নতুন আলোচনা তৈরি করেছে। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, এই সম্পর্কগত পট পরিবর্তন কতটা স্থায়ী এবং গভীর তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
অনেকেই এটিকে ‘জোটের পুনর্বিন্যাস’ বলে ব্যাখ্যা করছেন, যেন পাকিস্তান চীনের প্রভাবমুক্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকছে। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। চীন এখনো পাকিস্তানের অন্যতম নির্ভরযোগ্য অর্থনৈতিক অংশীদার এবং কৌশলগত মিত্র। অবকাঠামো উন্নয়ন এবং অর্থনীতির জন্য পাকিস্তান ক্রমেই বেইজিংয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (BRI) অংশ হিসেবে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (CPEC) গুরুত্ব অপরিসীম।
ভারতের বর্তমান হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার ক্রমাগতভাবে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব উসকে দিচ্ছে, যা ইসলামাবাদের জন্য নিরাপত্তাগত দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। পারমাণবিক শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার পাশাপাশি ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ঠেকাতে সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা পাকিস্তানের সামনে স্পষ্ট।
এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সামনে কিছু কৌশলগত সুযোগ এসেছে, তবে তা জিরো সাম গেম বা পরস্পরবিরোধী লাভ-ক্ষতির সমীকরণ নয়। যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্রনীতিতে ‘আমার পক্ষ না হলে শত্রু’ ধরনের মনোভাব দেখালেও, চীনের অবস্থান তুলনামূলক বাস্তববাদী। বেইজিং উন্নয়ন ও বাণিজ্যকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
চীনের মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো যতই সমালোচনা করুক, দেশটি মাত্র চার দশকে ৮০০ মিলিয়ন মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ঊর্ধ্বে তুলেছে—এই অভাবনীয় অর্জন প্রায়ই উপেক্ষিত। এর বিপরীতে, গাজায় চলমান সংঘাতে পশ্চিমা ‘গণতন্ত্রগুলোর’ ভূমিকা তাদের নৈতিক অবস্থান নিয়েই প্রশ্ন তুলছে।
পাকিস্তান বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের মনোভাব বোঝার ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। ইসলামাবাদ তাকে শান্তির নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে এবং ২০২১ সালের কাবুল বিমানবন্দরে আত্মঘাতী হামলার এক সন্দেহভাজনকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণ করে। এতে ট্রাম্পের ‘শক্ত নেতা’ হিসেবে ভাবমূর্তি জোরদার হয়। ওই হামলায় ১৩ মার্কিন সেনা এবং দুই শতাধিক আফগান নিহত হয়েছিল।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে রুখতে ভারতকে সামনের সারিতে রাখতে চায়। ভারত কোয়াড জোটের সদস্য, যার নেতৃত্বে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং বাকি সদস্য দেশ হলো জাপান ও অস্ট্রেলিয়া। অথচ ভারত একইসঙ্গে ব্রিকস জোটেও সক্রিয়, যেখানে চীন, রাশিয়া, ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে মিলে একটি বিকল্প বাণিজ্যিক কাঠামো গড়ে তুলছে। এই দ্বৈত ভূমিকার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্কে জটিলতা তৈরি হয়েছে।
গত বছর মে মাসে কাশ্মীরে এক সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত পাকিস্তানের দিকে পাল্টা আক্রমণ চালায়। যুক্তরাষ্ট্র উভয় পক্ষকে শান্ত থাকতে বললে পাকিস্তান দ্রুত সাড়া দেয়। ট্রাম্পের অহমবোধ তৃপ্ত করতে ইসলামাবাদ সাময়িকভাবে সংযম দেখায় এবং তাকে একধরনের ‘শান্তির নায়ক’ হিসেবে উপস্থাপনের সুযোগ দেয়। তবে এই প্রক্রিয়ায় ভারতের কিছু পদক্ষেপ ট্রাম্পকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।
বিশেষ করে, মোদির একটি যুক্তরাষ্ট্র সফর বাতিল এবং ওয়াশিংটনের অনুরোধ উপেক্ষা করে পাকিস্তানবিরোধী হামলা চালানো—এই দুটি ঘটনায় ট্রাম্প মনে করেন, ভারত মুখে এক কথা বলে, আর আচরণে অন্য কিছু করে। যুদ্ধবিরতির ডাক দেওয়ার পরও, ভারতের অনমনীয়তা দুই দেশের মধ্যে অস্বস্তিকর সম্পর্ক তৈরি করে।
মূলত, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কে তিক্ততার পেছনে গভীরতর কারণ হলো ভারতের ব্রিকস সদস্যপদ এবং এই জোটের ডলারের বিকল্প মুদ্রা চালুর চিন্তা। এতে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ডলারের আধিপত্য হুমকির মুখে পড়বে, যা ওয়াশিংটনের কাছে মেনে নেওয়া কঠিন।
এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতের প্রতি কটাক্ষ, বাণিজ্য শুল্ক আরোপ এবং রাজনৈতিক চাপ—সবই নয়াদিল্লিকে পশ্চিমা বলয়ে ধরে রাখার কৌশলের অংশ। যদি ভারত এই চাপে সাড়া দেয়, পাকিস্তানের কৌশলগত সাফল্য ক্ষণস্থায়ী হবে। আর যদি না দেয়, তবে ইসলামাবাদ অন্তত এখনকার ভূরাজনৈতিক মঞ্চে একটি কার্যকর অবস্থানে রয়েছে।
সূত্র: দ্য ডন
Publisher & Editor