বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫

আমার শিক্ষক সন্‌জীদা খাতুন

প্রকাশিত: ০২:১৬, ১৩ এপ্রিল ২০২৫ | ২১

আমাদের কালের একজন বিশিষ্ট ও প্রাতিস্বিক মানুষ, বাঙালি সংস্কৃতির এক অনন্য ঠিকানা সন্‌জীদা খাতুন চলে গেলেন চিরদিনের মতো। চলে গেলেন বটে, কিন্তু রেখে গেলেন অতুলনীয় কিছু বৈভব, অনুপম কিছু সৃষ্টি। সংস্কৃতিসাধক, লেখক, গবেষক, সংগীতশিল্পী, শিক্ষক, সমাজচিন্তক—সর্বোপরি সংবেদনশীল একজন শুদ্ধাচারী মানুষ হিসেবে উভয় বাংলায় তিনি ছিলেন সুপরিচিত। বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল আন্দোলনে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অন্যতম সারথি।

রাবীন্দ্রিক শুদ্ধাচারী এমন একজন গুণী মানুষকে হারিয়ে আমরা বিপন্ন, বিষণ্ন, বিহ্বল। আপা। আমাদের প্রিয় সন্‌জীদা আপা। আমাদের শিক্ষক, আমাদের অভিভাবক, আমাদের ঠিকানা, আমাদের অভয়াশ্রম সন্‌জীদা খাতুন।

ক্ষুদ্র এই জীবনে যেসব মানুষের সান্নিধ্যে এসে কেবলই ঋণগ্রস্ত হয়েছি, যাঁদের কাছ থেকে অনবরত নিয়ে ঋদ্ধ করেছি নিজেকে—সন্‌জীদা খাতুন তাঁদের অন্যতম। আজকের এই বিষণ্ন মুহূর্তে আমার প্রিয় আপাকে জানাই বিনত প্রণাম, অবারিত ভালোবাসা, অনেকান্ত শ্রদ্ধা। কবে থেকে জানি আপাকে? স্কুল-কলেজজীবনে নাম জানলেও আপাকে প্রথম দেখি ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। তারপর কেটে গেছে প্রায় অর্ধশতাব্দী।

এখনো মনে হয়, ‘মানসী’ কি ‘সোনার তরী’ হাতে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের ২০১৭ নম্বর শ্রেণিকক্ষে ঢুকছেন আপা—পড়াচ্ছেন রবীন্দ্রকবিতা—কখনো রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা, কখনো বা বোঝাচ্ছেন রবীন্দ্রকবিতার আঙ্গিক। মুগ্ধ বিস্ময়ে আপার কবিতা বিশ্লেষণ শুনেছি, বুঝেছি শব্দের ধ্বনিগুণ কিভাবে কবিতার গোপন রহস্য উন্মোচনে ভূমিকা পালন করে—সেই তত্ত্ব। সন্‌জীদা আপার ক্লাস করেই রবীন্দ্রকবিতার অন্দরে প্রবেশের সাহস সঞ্চার করেছি। কখনো তাঁকে ক্লাসে দেরিতে আসতে দেখিনি, অন্য কোনো কাজের কথা বলে ক্লাসে তাঁর না আসাও কখনো আমাদের দেখতে হয়নি। অনুশীলনী পরীক্ষার উত্তরপত্র আপা দেখতেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে—ভুল ধরিয়ে দিতেন, বলে বা লিখে দিতেন কী হবে শুদ্ধটা।

এভাবে আপার কাছ থেকে কত কী শিখেছি, তার কি কোনো সীমা আছে?
শ্রেণিকক্ষের বাইরেও আপাকে দেখার সুযোগ ঘটেছে আমার। একবার আমাদের নিয়ে আপা গেলেন রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহে। আপাকে ভিন্নভাবে পাওয়ার সুযোগ ঘটল এবার। আসা-যাওয়ার পথে, শিলাইদহের উন্মুক্ত প্রান্তরে আপাকে নতুন করে আবিষ্কারের সুযোগ পেলাম। কথাটা কি অতিশয়োক্তি হবে? তবু বলি, আপার কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথের কথা শুনতে শুনতে, রবীন্দ্রনাথের সুধারসে ডুবতে ডুবতে আপার মুখাবয়বেই আমার কল্পচোখে ভেসে উঠেছিল সেদিন রবীন্দ্রনাথের অস্পষ্ট আভাস।

আমরা তখন স্নাতক সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আপার কী খেয়াল হলো জানি না—আমাদের গান শেখার জন্য ছায়ানটে যেতে হলো—খাতা কিনলাম, এক দিন ক্লাসেও গেলাম। ওই এক দিনই, তারপর আর যাইনি। আপা বুঝেছেন, আমাদের দিয়ে আর যা-ই হোক, গান হবে না। প্রথম দিকে, পহেলা বৈশাখে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে, কিছু সাংগঠনিক কাজও আমরা করেছি—উত্তরকালে মাঝে মাঝে ছায়ানটে ভাষা ও সাহিত্যের ক্লাসও নিয়েছি। ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনে ঢুকতেই একটা প্রসন্নতা, একটা পবিত্রতার ভাব মনে জাগে। ষাটের দশকের ছায়ানট তো আজ আমাদের সংস্কৃতির অপ্রতিম এক ঠিকানা। এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার জন্য আপার অবদান প্রয়াস প্রযত্নের কথা স্মরণ হলে অবলীলায় তাঁর পায়ের কাছে মাথা নত হয়ে আসে। আপার বই ‘স্বাধীনতার অভিযাত্রা : ভাষা-আন্দোলন নববর্ষ ছায়ানট মুক্তিযুদ্ধ’ পাঠ করলে বোঝা যায়, একজন ব্যক্তি সনিজদা খাতুন কিভাবে ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছেন একটি প্রতিষ্ঠানে।

গানকেই, আরো স্পষ্ট করে বললে রবীন্দ্রনাথের গানকে, তিনি জেনেছেন আত্মপরিচয়ের অফুরান উৎস হিসেবে। এই জানা থেকেই, বোধ করি, তাঁর ছায়ানট-স্বপ্ন। প্রসঙ্গত মনে পড়ে গানের মধ্যে আত্মপরিচয় সন্ধান প্রসঙ্গে শঙ্খ ঘোষের ভাষ্য : ‘সন্‌জীদা খাতুন আরেক রকম মানুষ। গান গাইতেই তাঁর আনন্দ, গান শোনানোতেই তাঁর আনন্দ। কেননা গান তাঁর কাছে কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়, গান তাঁর জীবিকা নয়; গান তাঁর জীবন, চারপাশের মানুষদের সঙ্গে মিশে যাওয়া এক জীবন। ধর্মতলা স্ট্রিটের প্রথম পরিচয়ে জেনেছিলাম যে দেশের আত্মপরিচয় খুঁজছেন তিনি রবীন্দ্রনাথের গানে, আর আজ জানি যে সে গানে তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন নিজেরই আত্মপরিচয়।’

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের আমন্ত্রণে মৌখিক ইতিহাস প্রকল্পের অংশ হিসেবে আপার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলাম আমি। আপার বাসায় সারা দিন ধরে গ্রহণ করা সেই সাক্ষাৎকার থেকে আপাকে নতুন করে জানার সুযোগ ঘটেছে। আপার কথায় সেদিন কেবল আপা কিংবা তাঁর গর্বিত পরিবার নয়—গোটা দেশটাই উঠে এসেছিল। আপার কথা, সেদিন আমার মনে হয়েছে, গোটা বাংলাদেশের কথা—আপার মুখাবয়বে সেদিন ভেসে উঠেছিল দেশমায়ের মুখ। সেই সাক্ষাৎকার থেকে জেনেছি—রাজপথের সংগ্রামের পাশাপাশি আপা কিভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন একটা আত্মিক সম্পর্ক। ঢাকা কি কলকাতা কি শান্তিনিকেতন—সবকিছু আপার কাছে অভিন্ন হয়ে যায়—তাঁর কাছে বড় হয়ে ওঠে দেশ আর মানুষ, মুক্তি আর স্বাধীনতা।

ছায়ানট থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ পত্রিকা সম্পাদন সূত্রে আপাকে আরেকভাবে জানার সুযোগ হলো। পত্রিকার জন্য আপা লেখা চান, লেখা দিই। তবে সব সময় ভয় কাজ করে—কোথায় না ভুল করে বসলাম! আপা যত্ন করে লেখা পড়বেন, ভুল থাকলে শুদ্ধ হয়ে যাবে—এটা থাকে ভেতরের আনন্দ। লেখা পেয়ে ফোনে আপা জানাতেন তাঁর ভালোলাগা মন্দলাগার কথা—কিভাবে লেখাটা আরো ঋদ্ধ করা যাবে, সেটা জানাতেও কখনো ভুল হতো না আপার। আপা, প্রকৃত প্রস্তাবেই, একজন নিষ্ঠ পাঠক। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমি থেকে ‘অতুলপ্রসাদ সেন’ নামে আমার একটা বই প্রকাশিত হয়। বইটা আমি আপাকে দিই। তারপর কেটে গেছে দীর্ঘ ১১ বছর। হঠাৎ ২০০৪ সালের এক শীত-সকালে আপার ফোন। ফোনে আপার কথাগুলো ছিল অবিকল এরকম : “তোমার ‘অতুলপ্রসাদ সেন’ বইটা পড়েছি। ভালো লেগেছে। খুব গোছানো লেখা।” তারপর বললেন : ‘তবে বইতে মোট তিনটা বানান ভুল আছে।’ এরপর কোন পৃষ্ঠায় কোন বানান ভুল আছে, তা-ও বলে দিলেন। এই ছিলেন আমার শিক্ষক সন্‌জীদা আপা।

আপার ক্লাস, আপার গান, আপার উচ্চারণরীতি, আপার প্রজ্ঞা-মনন-রুচি—সবকিছুই আমার কাছে বিশিষ্ট ও ব্যতিক্রমী বলে মনে হতো। সন্‌জীদা আপার বই পড়ে পরীক্ষার বৈতরণী পাড়ি দিয়েছি, তাঁর বক্তৃতা শুনে শিখে নিয়েছি শুদ্ধ উচ্চারণরীতি। ‘কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত’ (১৯৫৮), ‘রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ’ (১৯৮১), ‘ধ্বনি থেকে কবিতা’ (১৯৮৮), ‘তোমারি ঝরনা-তলার নির্জনে’ (১৯৯৪), ‘রবীন্দ্রনাথ : বিবিধ সন্ধান’ (১৯৯৪), ‘রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে’ (২০০০)—এসব বই দিয়ে প্রতিদিন আপা আমাকে শিক্ষা দিয়ে যাবেন।

ভালো সংবাদ থাকলে আপা ফোনে জানাতেন, মন্দ সংবাদও নয় কি? আপা ফোন করলে, কিংবা যদি করি আমি আপাকে—কখনো কখনো তিরিশ মিনিট চলে যেত কথা বলতে বলতে। সুযোগটা আমিই নিই—কেননা যত বেশি কথা, ততই তো বেশি শেখা আমার। একান্ত নিজস্ব কথা হলেও বলি। গবেষণায় ২০১১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার পরের দিন আপার ফোন পেলাম। আপার প্রথম বাক্যটা ছিল এ রকম : ‘অভিনন্দন তোমাকে, ছাত্রের অর্জন শিক্ষককে যে কী আনন্দ দেয়, তা তুমি এখনই বুঝবে না। ভালো থেকো।’ বুঝতে পারি, আপার খুশির মাত্রাটা। অন্য একটা ঘটনা। আপা তখন বিভাগের চেয়ারম্যান। বিভাগের ছাত্র উপদেষ্টা হিসেবে আমাকে নিয়োগ দিলেন আপা। এর ফলে আমার একজন সহকর্মী বেশ মনঃক্ষুণ্ন হলেন। আপাকে নিয়োগটা বাতিল করার জন্য চাপ দিলেন বা এমন কিছু বললেন। আপা তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। কয়েক দিন পর আপা আমাকে বললেন—‘এই হচ্ছে ঘটনা। তুমি কাজ করে যাও।’

আপা—আমাদের সন্‌জীদা আপা। সারাটা জীবন তাঁর সংগ্রামের জীবন, যুদ্ধের জীবন—দুঃখ আর দহনের জীবনও নয় কি? তবু, ওই সবকিছুর চেয়েও যে আরেক বৃহৎ জীবন তাঁর ছিল—জীবনের প্রতিটি ক্ষণকে যে তিনি কাজে লাগিয়েছেন, অনুক্ষণ যে তিনি যাপন করেছেন রাবীন্দ্রিক জীবনাচার—এটাই এখন আমাদের পরম আনন্দ আর অবারিত আশ্বাসের উৎস।

আমার শিক্ষক ডক্টর সন্‌জীদা খাতুন আজ আর আমাদের মাঝে নেই—এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। তবু তা-ই চরম সত্য। আপা নেই, তবে রেখে গেছেন তাঁর সাধনার স্বাক্ষর, রেখে গেছেন তাঁর অমূল্য সৃষ্টিসম্ভার। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর রাবীন্দ্রিক সংস্কৃতি শক্তিতে তিনি গড়তে চেয়েছিলেন তাঁর প্রিয় শিক্ষার্থীদের—এই যে সন্‌জীদা খাতুন, তিনি সব সময় থাকবেন আমাদের সঙ্গে, অনাগত কাল ধরে আমাদের বলে যাবেন এগিয়ে যাওয়ার যথার্থ পথ, দূর থেকে জানিয়ে যাবেন জাতিসত্তার প্রকৃত ঠিকানা, আর পুনঃ পুনঃ উচ্চারণ করবেন : ‘মাভৈ, এগিয়ে যাও।’

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor