শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫

আঁধার ঘরের জানালা

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২০ নভেম্বর ২০২৫ | ৪৩

শীতের শুরুতেই কুয়াশা যেন ভেলাবাড়ি স্টেশন ঢেকে রেখেছে এক দুধসাদা চাদরে। ট্রেন যেন হঠাৎ থেমে গেল—কোনো তাড়া নেই, না শহরের কোলাহল, না আগত যাত্রীর ভিড়।

হঠাৎ করেই দরজার ধাতব শব্দে ট্রেনের নৈঃশব্দ্য ভাঙল। নামল একজন।

মীর সাব্বির।

হাতের কাঁপুনি ঠেকাতে বারবার হাতমোজা ঠিক করতে করতে সে স্টেশনের চারপাশে চোখ রাখল—এখানে ছিল প্রচুর শীত। একটা ভাঙাচোরা বেঞ্চ, কিছু খুঁটি, আর দূরে টিমটিমে আলো জ্বলা অফিসঘরে এক লোক দাঁড়িয়ে। স্টেশন মাস্টার।

বয়স ষাটের কাছাকাছি।
তিনি সাব্বিরকে দেখে শুধু বললেন,

ইশকুলের নতুন শিক্ষক?

হুঁ...

তোমার থাকার জায়গা ওইখানে—চিত্রলেখা অতিথিশালা। তবে রাত হলে বন্ধ রাখবে সব জানালা।

সাব্বির সেসব কথায় কান দিল না।

গ্রাম্য কুসংস্কার বলে মনে হলো। মেঠো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চিত্রলেখা অতিথিশালার সামনে এসে দাঁড়াতেই তার মনে হলো, এই জায়গাটা যেন আগে কোথাও দেখা—স্বপ্নে, নাকি সিনেমায়?
কাঠ আর ইটের দোতলা বিশাল প্রাসাদসদৃশ ভবন, দেয়ালে শেওলা, জানালার কাচ ভাঙা। বাড়ির পাশেই বিশাল এক বটগাছ, আর জানালার পর্দা বাতাসে দোল খাচ্ছে—যেন কেউ ভেতর থেকে তাকিয়ে দেখছে।

চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলতেই ভেতরে একটা কাঁপুনির মতো ঠাণ্ডা হাওয়া এসে গায়ে বসল।

রাত বাড়তেই চিত্রলেখা অতিথিশালার আসল রূপ ধরা দিতে শুরু করল।

ঘরের এক কোণ থেকে অদ্ভুত হাওয়ার শব্দ, পুরনো মেঝেতে যেন কারো পায়ের ছাপ, আর সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার—একটা ঘরের জানালা কিছুতেই বন্ধ হয় না। তিন রাত পর সাব্বির প্রথম শুনল সেই আওয়াজ।
একটা মেয়ের কণ্ঠ। ‘তুমি ফিরলে কেন...? উত্তর না দিয়ে চলে গেলে কেন তুমি?’

গলা খুব পরিচিত মনে হলো তার, অথচ সে জানে, এই গলা এ জীবনে শোনা নয়।

সে জানালা দিয়ে তাকাল—কেউ নেই। কেবল পর্দাটা যেন বাতাসে নড়ছে না, ওটা কারো ছায়া বহন করছে।

সকালে সাব্বির গ্রামের লোকজনের কাছ থেকে জানতে পারল, এই বাড়িতে একসময় থাকত রূপা নামের এক মেয়ে। সবাই জানত শান্ত, চুপচাপ; আর একা থাকত সে। বছর দশেক আগে তার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। কেউ বলে আত্মহত্যা, কেউ বলে খুন। অথচ কোনো অভিযোগ হয়নি, তদন্ত হয়নি। এই বাড়িটার একটা ঘরে নাকি আগেও আরো একজন মারা গিয়েছিল—জমিদারকন্যা চিত্রলেখা। প্রায় আশি বছর আগে।

‘দুজনেরই এক ঘর, জানালাও এক,’ বলল গ্রামের সবচেয়ে পুরনো মানুষ, হালিম চাচা।

সেই রাতে সাব্বির খুঁজে পেল মেঝের নিচে পাথরের তলায় লুকানো একটা পুরনো ডায়েরি। পাতাগুলো ছেঁড়া ছেঁড়া। বেশির ভাগই পোড়ানো। তবু একটা জায়গায় পরিষ্কার লেখা—

‘আমার নাম রূপা। আমাকে সবাই ভুল বুঝেছে। কিন্তু আমার কথা কেউ শোনেনি। আমি চিত্রলেখা। এসেছিলাম উত্তর পেতে। আবার আসব, যদি এবারও না পাই...।’

চোখ কেঁপে উঠল সাব্বিরের। কে এই চিত্রলেখা? সে কি সত্যিই রূপার পুরনো আত্মা? কিন্তু প্রশ্নটা তখন ভয়ংকর হয়ে উঠল, যখন ডায়েরির অন্য পাতায় সে পেল—‘আমার মৃত্যুর দিন কেউ দরজা দেয়নি। বিষ খেয়ে আমি শুধু জানালার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার নিজের চেয়ে জানালা বেশি বুঝেছিল আমাকে। সেটা খোলা ছিল। আজও খোলা থাকবে।’

সাব্বির এবার বিশ্বাস করতে শুরু করল, এই জানালার পেছনে কিছু আছে। আর আছে একজন, যে এখন চুপচাপ এই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। সে আবার ঘাঁটতে শুরু করল ইতিহাস। স্থানীয় স্কুলের পুরনো রেজিস্টারে একটা নাম চোখে পড়ল—সত্যেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। রূপার মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন স্কুলপ্রধান। আশ্চর্যজনকভাবে, চিত্রলেখার মৃত্যুর সময়েও তাঁর নাম পাওয়া যায় সেই এলাকার জমিদার প্রশাসনের একজন হিসেবে। সত্যেন্দ্রনাথ আজ আর বেঁচে নেই।

 কিন্তু তাঁর মৃত্যুর আগে বলা শেষ কথাটি রেকর্ড করা ছিল তাঁর ছেলের ডায়েরিতে—‘ওরা বারবার ফিরে আসে। রূপা ছিল চিত্রলেখা। আমি জানি। আমি তো থামাতে পারিনি ওকে। সেই জানালাটা আমিই খোলা রেখেছিলাম।’

শেষরাতে ট্রেনের হুইসল শোনা গেল দূরে। ঠিক তখনই সাব্বির সেই ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। জানালার পর্দা এবার নড়ল না।

বরং সে দেখল, এক নারী—সারা গায়ে শাড়ি, পাথরের মতো ঠাণ্ডা চোখ—চুপচাপ তাকিয়ে আছে।

দেখে ভয় লাগল না, বরং শ্বাস আটকে এলো। সে ফিসফিস করে বলল, ‘তোমার কি কিছু বলতে ইচ্ছা করে?’

নারীটি বলল, ‘তুমি শুনতে এসেছ, তাই বলছি। আমি শুধু অপেক্ষা করেছিলাম—সম্পর্ক নয়, সত্য জানানোর জন্য।’

‘আমি কখনো কারো প্রেম চাইনি—চেয়েছিলাম কেউ বুঝুক আমি হারিয়ে যাইনি।’

পরদিন সকালে লোকজন অবাক হয়ে দেখল, চিত্রলেখা অতিথিশালার সেই পুরনো কাঠের জানালাটা প্রথমবারের মতো বন্ধ।

সাব্বির নেই। ফিরে গেছে শহরে। কিন্তু ট্রেন ছাড়ার আগে কেউ একজন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিল—সাদা শাড়ি পরা এক মেয়ে। বাতাসে চুল উড়ছিল, আর চোখে সেই চিরন্তন প্রশ্ন—

‘তুমি এবার শুনেছ তো?’

‘শেষ কথা।’

চিত্রলেখা অতিথিশালার সেই পুরনো কাঠের জানালা অবশেষে বন্ধ। শুধু বাতাস আর পোকারা জানে, কত রাত ধরে সেই জানালার ধারে কেউ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকেছে। সে কাউকে দোষ দেয়নি, কারো কাছে ভালোবাসা চায়নি; সে শুধু চেয়েছিল, কেউ একবার তাকে শুনুক।

আমরা কি কখনো শুনি?

নাকি সব শব্দ হারিয়ে যায়, জানালার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা কারো সঙ্গে—চুপচাপ, না-বলা এক যন্ত্রণার ভেতরে? ভেলাবাড়ির বাতাস আজও সেই শব্দ বয়ে আনে—

শুধু আমরা শুনি না। আর সে...সে কখনোই ফিরে আসে না।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor