জীবন সব সময় এক রকম থাকে না। কখনো সে শান্ত নদীর মতো বয়ে যায়, কখনো আবার প্রবল ঝড় তোলে আমাদের অস্তিত্বে। ২০২২ সালের অক্টোবর, আমার জীবনের ঠিক এমনই এক ঝড় এসেছিল। যার নাম ‘ক্যানসার’। তখন আমি ৪৯-এ পা দিয়েছি। জীবনের সবচেয়ে কর্মচঞ্চল, গতিশীল অধ্যায়, যখন একদিকে পরিবার, অন্যদিকে কর্মজীবনের ভার, সবকিছু সামলে সামনের দিকে এগিয়ে চলছিলাম। হঠাৎ একদিন শুনলাম সেই বাক্য—‘আপনার ব্রেস্ট ক্যানসার হয়েছে’।
শুনে যেন পুরো পৃথিবী থমকে গেল। মনে হচ্ছিল, বুকের ভেতর কেউ যেন একটা পাথর বসিয়ে দিয়েছে, নিশ্বাসই নিতে পারছি না।
‘ক্যানসার’ শব্দটা শুধু একটা রোগ নয়। এটা একধরনের ভয়, একধরনের অজানা অন্ধকার।
যতই বাইরে থেকে শক্ত দেখাই না কেন, ভেতরে-ভেতরে আমি তখন প্রতিদিন একটু একটু করে ভেঙে পড়ছিলাম।
প্রথম ধাক্কাটা কাটিয়ে যখন চিকিৎসা শুরু হলো, তখন বুঝলাম, এই যুদ্ধ শুধু শারীরিক নয়, মানসিক, আবেগসংক্রান্ত, আত্মিক এক যুদ্ধ। প্রথমে বলা হয়েছিল ৬ সাইকেল কেমোথেরাপি, পরে তা গিয়ে দাঁড়াল ৮-এ।
প্রথম কেমোর পরেই আমার চুল পড়া শুরু করল। তারপর চোখের পাতা, ভ্রু, নখ—সব একে একে ঝরে যেতে লাগল। শরীরটা বদলে যেতে লাগল প্রতিনিয়ত, আয়নার সামনে দাঁড়ালে মনে হতো, এটা আমি তো না! নখ কালো, চামড়ার রং বদলে যাওয়া, দুর্বলতা, বমি, যন্ত্রণা—কিছুই বাদ ছিল না।
শুধু শরীর নয়, মনও একসময় বিদ্রোহ করতে শুরু করল। কখনো সারা দিন বিছানা থেকে উঠতে পারতাম না, আবার কখনো পুরো রাত নির্ঘুম কেটে যেত। অপারেশন, রেডিওথেরাপি, টার্গেট থেরাপি—প্রতিটি ধাপ যেন একেকটা যুদ্ধ।
রেডিওথেরাপির পর একটা সময় মনে হয়েছিল আমি বুঝি আর পারব না! শরীরটা বেঁচে আছে ঠিকই, কিন্তু মনটা যেন মৃতপ্রায়।
টার্গেট থেরাপির একপর্যায়ে আমার হার্টে সমস্যা দেখা দেয়। হাঁটতে পারতাম না, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হতো। একসময় মনে হলো—এই বুঝি সব শেষ! কিন্তু হাল ছাড়িনি।
নিজেকে ফিরে পাওয়ার প্রতিজ্ঞা
ক্যানসারমুক্ত’, তখনো ওরাল কেমো চলছিল। সেই ওরাল কেমোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো আরও কষ্টকর, ওজন কমে না, মুড সুইং, ডিপ্রেশন, হট ফ্ল্যাশ—সবকিছু মিলিয়ে আমি বুঝতে পারলাম, এখনো যুদ্ধটা শেষ হয়নি। তখনই মনে হলো—আমার ফিরে যেতে হবে সেই জায়গায়, যেখান থেকে আমি মানসিক শক্তি পাই।
ইয়োগা বা যোগাসন—যে অভ্যাসটা একসময় ছিল আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ইয়োগা বা যোগাসনের পথে ফিরে আসা
ক্যানসার ধরা পড়ার আগেও নিয়মিত হেঁটেছি, ইয়োগা করেছি, প্রাণায়াম করেছি। বিশ্বাস করি, সেই অভ্যাসগুলোই আমাকে চিকিৎসার কঠিন ধাপ পার করতে সাহায্য করেছিল। এবার আমি চাইছিলাম, ইয়োগায় ফিরে যেতে আরও গভীরভাবে, সঠিক উপায়ে। বহু সময় ধরে আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এভারগ্রিন ইয়োগাকে অনুসরণ করতাম। সাহস করে যোগাযোগ করি বাপ্পা শান্তনুদার সঙ্গে—‘এভারগ্রিন ইয়োগা’র পথপ্রদর্শক। সব বললাম তাঁকে, আমার শরীরের অবস্থা, মানসিক অবস্থান, সংশয়।
তিনি শোনেন, বোঝেন, তারপর বলেন—‘আপু পারবে। ধীরে ধীরে শুরু করো। আমি পাশে আছি।’
তারপর শুরু হলো আমার নতুন পথচলা। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ‘বডি ট্র্যাপিং’ দিয়ে শরীর জাগিয়ে তুলি। তারপর নিয়মমতো প্রাণায়াম, সূর্য নমস্কার, ইয়োগার আসনগুলো করি। সব আসন এখনো ঠিকঠাক পারি না, কিন্তু প্রতিদিন চেষ্টা করি।
বিশেষ করে অনুলোম-বিলোম—এই ছোট্ট প্রাণায়াম আমার জীবনের মানসিক ভার অনেকটা হালকা করেছে। ডিপ্রেশন, টেনশন, শীতলী প্রাণায়ামের ফলে হট ফ্ল্যাশসহ (সাধারণত ঘাম হয় এবং দ্রুত হৃৎস্পন্দনের সঙ্গে তীব্র তাপ অনুভব করে) সবকিছু অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
আজও ওরাল কেমো চলছে, শরীর পুরোপুরি ঠিক হয়নি, কিন্তু মন...সে অনেকখানি চনমনে, জীবন্ত। শরীরের সঙ্গে সঙ্গে আত্মাও যেন আবার নতুন করে জেগে উঠেছে।
কৃতজ্ঞতা ও উপলব্ধি
ইয়োগা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে এক নতুন জীবন…এক নতুন ‘আমি’। আজ যখন ফিরে তাকাই, ক্যানসার-পরবর্তী সময়টা ছিল এক অদৃশ্য দেয়ালে আটকে যাওয়ার মতো। শারীরিক কষ্টের চেয়েও বড় ছিল মানসিক ক্লান্তি, হতাশা আর নিঃসঙ্গতা। এ সময়েই ইয়োগা আমার জীবনে নতুন প্রাণ এনে দেয়। শুধু শরীর নয়, ইয়োগা ছুঁয়ে যায় আমার ভেতরের ভাঙাচোরা মনটাকেও।
আয়নায় তাকিয়ে নিজেকেই বলি:
‘তুই বেঁচে আছিস, তুই লড়েছিস, তুই জিতেছিস।’
শেষ কথা
এ যাত্রায় আমার পাশে ছিলেন কয়েকজন মানুষ, যাঁরা না থাকলে আমি এত দূর ফিরতে পারতাম না। শামা মাখিং—আমার ইয়োগা গুরু, যিনি আমার প্রতিটি শারীরিক সীমাবদ্ধতা বুঝে, ধৈর্য ধরে আমাকে গাইড করছেন। বাপ্পা শান্তনু—যাঁর সাপোর্ট, ভালোবাসা আর বিশ্বাস আমাকে সাহস দিয়েছে আবার নতুন করে বাঁচতে।
Publisher & Editor