শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

লোটো

প্রকাশিত: ০৭:৩৪, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ১৩

সাতটা ফল রাখা হয়েছিল সাত ভাইয়ের জন্য। তৃতীয় ফলটি ছিল লোটোর। ভাইদের মধ্যে লোটো সাদাসিধা। যা তার পাওনা, তার প্রাপ্তি নিয়ে সে ভাবত না।

জানত, তার জিনিস সে পাবেই। এ কারণে অন্য ভাইদের মতো সে প্রতি সকালে গাছের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত না।
ফল পাকা শুরু হলো। প্রথম ও দ্বিতীয় ফল যাদের পাওনা, তারা নিয়ে গেল।

তৃতীয় ফলের বেলায় এক ভাইয়ের বন্ধু এসে জুটল। লোটোদের মা নেই। বাবা নিরুদ্দেশ। কাকাই সব করেন।
সেই বন্ধু কাকাকে বলল, ‘কাকা, ফলের ওপর লোটোর কোনো লোভ নেই। ও চায়ও না। যদি ফলটি আমাকে দিতেন, আমার বোনটাকে খাওয়াতাম। জানেন তো, দেশি ডালিম আর কোথাও পাওয়া যায় না।’ বন্ধুটি যার, লোটোর সেই ভাইটিও বন্ধুর হয়ে কাকাকে অনুরোধ করল।

কিন্তু কাকা রাজি হচ্ছিলেন না। ভাইটি তখন লোটোর একটি ঘটনা মনে করিয়ে বলল, ‘জানেন তো! লোটো একবার দা দিয়ে এই গাছের ডাল কেটে ফেলেছিল। যদি আপনি না দেখতে পেতেন, তাহলে পুরো গাছটিই ও কেটে ফেলত! তখন কোথায় থাকত ওর ডালিম?’
কাকা বললেন, ‘কিন্তু সে সময় ও তো ছোট ছিল, খেলার ছলে কেটেছিল, ও তো বুঝেশুনে কাটেনি। তা ছাড়া বড় হয়ে সে তো ওই গাছের গোড়ায় তোমাদের সবার মতো জল ঢেলেছে, ওই অপরাধে তাকে ফাঁকি দিই কেমন করে?’

ভাইটি বলল, ‘ফাঁকি নয় কাকা, ফলের জন্য লোটো লালায়িত নয়, ওকে ফল না দিলে ও কিচ্ছু মনেও করবে না, কিন্তু ও যখন বুঝবে, ওর সেই অপরাধের কথা স্মরণে আসবে। বাস্তব জীবনে ও যেমন অগোছালো, অপরাধ-স্মরণ ওকে খাঁটি করে তুলবে, ওকে গুছিয়ে উঠতে সাহায্য করবে, অভিভাবক হিসেবে এমন শিক্ষাদানের সুযোগও তো আপনি চান।’

ভাইটির যুক্তিতে কাকার মন গলে গেল। কাকা পরিবারের ভালো করতে গিয়ে পরিবারের বাইরে চলে গেলেন। লোটোর ফলটি সেই বন্ধুকে দিলেন। তারা তক্ষুনি বাজারে নিয়ে সেটা ৫০ টাকায় বিক্রি করল। সেই টাকা দিয়ে কিনল পটকা বাজি। তাদের সাহস গেল বেড়ে।

একে একে সব ফল ফুরিয়ে গেল। গাছ হয়ে গেল শূন্য। শুধু পাতাগুলো পড়ে থাকল। লোটোর তা খেয়ালই নেই।

একদিন এক বন্ধু লোটোকে বলল, ‘তোর সব ভাই তো ফল পেল, তোর ফলটা কই?’

লোটো সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি ফিরে ডালিমগাছটি দেখল। একটি ফলও নেই। ঘরের পাশের সেই গাছে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। গাছটি যেন হাহাকার করছে।

‘তাইতো! আমার ফলটি কই!’ মনে মনে বলল লোটো। তক্ষুনি ছুটে কাকার কাছে শুনতে যাচ্ছিল, হঠাৎ    অন্ধকার উঠান থেকে কে যেন নিষেধ করল, ‘যাস নে লোটো, যাস নে!’

লোটো পেছন ফিরে দেখে কেউ নেই। কিন্তু কণ্ঠটি তার মায়ের মতো। লোটো এক মায়ের এক ছেলে। অন্য ভাইরা সত্মায়ের। ছোটবেলায় যখন ভাইদের সঙ্গে ঝগড়া বাধত, মা তখন ওভাবেই নিষেধ করত। লোটো কাকার কাছে গেল না। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল। মা স্বপ্নে এসে বলল, ‘কাকার কাছে তোমার পাওনা চাইতে গেলে না কেন?’

‘তুমি যে নিষেধ করলে, মা!’

‘ও তোমার মনের ভুল।’ মা চলে গেল।

ঘুম ভেঙে গেল লোটোর। রাত তখন ভোর। লোটোর মন খুব খারাপ—ফল না পাওয়ার জন্য নয়, বঞ্চিত হওয়ার জন্য। হঠাৎ    বাইরে পটপট শব্দ! সেই সঙ্গে কেমন যেন আর্তনাদ! লোটো দ্রুত বাইরে বেরিয়ে দেখে, দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। পটকা বাজি ফোটাতে গিয়ে তার ভাই আর ভাইয়ের সেই বন্ধু আগুন লাগিয়ে ফেলেছে। ঘুমে অচেতন মানুষগুলো আগুনে পুড়ে ছাই হবে!

মা সব ভাইকে একটা কথা বলত, ‘লেগ কাইট ট্যাপ’। অন্য ভাইদের সেটা মনে থাকত না। লোটোর থাকত। লোটোদের পাঁচিলের ওপর জলের ট্যাপ আছে। প্রয়োজনে ভাইদের সেই ট্যাপ খুলতে বলত মা। কিন্তু বাবার নাম পাঁচালি গাজী বলে মা ‘পাঁচিল’ শব্দটা উচ্চারণ করত না। তাই মজা করে ইংরেজি বানিয়ে বলত। পা মানে লেগ, চিল মানে কাইট, আর ট্যাপ মানে ট্যাপ। পাঁচিলের ট্যাপ মানে ‘লেগ কাইট ট্যাপ’।

ট্যাপ খুলতে পাঁচিলের কাছে হেঁটে যাওয়া যাবে না। চারদিক থেকে আগুন এগিয়ে আসছে। পুড়ে যেতে হবে। পাঁচিলের ওই মাথা থেকে এদিকের মাথায় বিদ্যুতের একটা মোটা তার টানানো আছে, জামা-কাপড় রোদে দেওয়ার জন্য। মা যখন ট্যাপ খুলতে বলত, লোটো সার্কাসের রোপ ওয়াকারের মতো ওই তারের ওপর দিয়ে হেঁটে ট্যাপের কাছে যেত, আর মুখে বলত, ‘লেগ কাইট ট্যাপ, লেগ কাইট ট্যাপ।’ মায়ের শেখানো ওই কথাগুলোতে তার অঙ্গে ছন্দ এসে যেত। সেই ছন্দে রোপ ওয়াকারের দুঃসাধ্য খেলা সে রপ্ত করেছিল। অন্য ভাইরা তা কিছুতেই পারত না। অনেক দিন ওই খেলা খেলা হয়নি। আজ বড় প্রয়োজন। নিজেকে বাঁচাতে আজ ওই তারের ওপর দিয়েই পালাতে হবে।

লোটো দেরি না করে তারের ওপরে উঠে গেল। ওই তারের মতোই আজ সরু লোটোর জীবনরেখা। তার নয়, সে যেন জীবনরেখা দিয়ে হাঁটছে। নিচে দাউদাউ আগুন। মুখে ‘লেগ কাইট ট্যাপ, লেগ কাইট ট্যাপ’ বলতে বলতে ঠিকই পার হয়ে গেল লোটো। ট্যাপের পাঁচিলের ওপর দাঁড়িয়ে সে দেখল, ভাইরা তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে ট্যাপ খুলতে যাবে, আবার সেই কথা ভেসে এলো, ‘যাস নে লোটো, যাস নে’! লোটো ভাবল মনের ভুল। সে ট্যাপ খুলে দিল। হুড়মুড়িয়ে জল ছড়িয়ে পড়ল। আগুন নিভে গেল। পরিবার বেঁচে গেল। চারদিকে ছাই-জল, আধাপোড়া সব। কাকা বাইরে এসে লোটোর কাণ্ড দেখে গাছটির দিকে তাকাল। মনে মনে বলল, ‘যদি আরেকটা ফল থাকত!’ গাছটি বলল, ‘তা কি হয় কখনো!’

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor