বুধবার, ০৬ আগস্ট ২০২৫

ফ্যাসিবাদ-গণতন্ত্রের প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য বহাল আছে, থাকবে

প্রকাশিত: ০২:৫৯, ০৬ আগস্ট ২০২৫ |

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, হাজারো শহীদের রক্তাক্ত রাজপথে ফ্যাসিবাদবিরোধী অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে আর কখনোই ফ্যাসিবাদ কায়েম হবে না, কাউকে গণতন্ত্র হত্যা করার সুযোগ দেওয়া হবে না। বাংলাদেশকে আর কখনোই তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করতে দেওয়া হবে না। এসব প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য বহাল আছে, থাকবে। ৫ আগস্ট উপলক্ষ্যে মঙ্গলবার দেশবাসীর উদ্দেশে এক ভার্চুয়ালি ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।

তারেক রহমান তার ভাষণে সব শহীদের অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। পাশাপাশি আহতদের দ্রুত আরোগ্য লাভের জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেন। তিনি বলেন, ১৯৭১ সাল ছিল স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ। আর ২০২৪ সালে ছিল স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধ। ৭১ সালের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশ ভোলেনি। ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদেরও বাংলাদেশ ভুলবে না। ’৭১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত দেশ এবং জনগণের স্বাধীনতা অর্জন, স্বাধীনতা রক্ষা, স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনÑএভাবে ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে লাখো মানুষ শহীদ হয়েছেন। 

তারেক রহমান বলেন, একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম এবং রাজনৈতিক উদ্যোগ হচ্ছে জনগণের সরাসরি ভোটে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ, জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক একটি রাষ্ট্র এবং সরকার প্রতিষ্ঠা। জনগণের কাছে দায়বদ্ধ একটি সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য বর্তমান অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার কাজ করছে। বিগত দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের সঙ্গে স্বাধীনতা-পরবর্তী তিন-সাড়ে তিন বছরের সময়কাল ছাড়া আর কোনো শাসনামলের তুলনা চলে না।

তারেক রহমান বলেন, সবাইকে বিনীতভাবে আহ্বান জানাব, হিটলারের নাৎসিবাদ সম্পর্কে যেমন কেউ গৌরব করে না, পলাতক ফ্যাসিস্টের শাসনকাল নিয়েও গৌরব করার কিছু নেই। ডাকাতি করে কিছু সম্পদ চ্যারিটি করলেও জনগণের চোখে ডাকাত যেমন গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনই অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের ব্যর্থতা খুঁজতে গিয়ে কৌশলে পলাতক ফ্যাসিস্টের পক্ষে সাফাই গাওয়াও তেমনই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

তিনি বলেন, যারা কৌশলে ফ্যাসিবাদী শাসনের সঙ্গে বর্তমান অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের তুলনা করতে চান, তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতে চাইÑ৫ আগস্ট বাংলাদেশে যা ঘটেছে, এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের ইতিহাসেও মনে হয় নজিরবিহীন। ৫ আগস্ট গণভবন ছেড়ে ফ্যাসিস্ট পালিয়েছে। সংসদ ভবন রেখে সংসদ-সদস্য পালিয়েছেন। আদালত ছেড়ে প্রধান বিচারপতি পালিয়েছেন। বায়তুল মোকাররম ছেড়ে প্রধান খতিব পালিয়েছেন। ক্যাবিনেট ছেড়ে মন্ত্রীরা পালিয়েছেন। ফ্যাসিস্টের দোসররা গা ঢাকা দিয়েছে। তবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, পলাতক এই ফ্যাসিস্টচক্রের মনে এখনো কোনো অনুতাপ-অনুশোচনা নেই।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে যার যার দলীয় আদর্শ ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইস্যুভিত্তিক ভিন্নমত থাকবে। এটি বিরোধ নয় বরং ভিন্নমত। এটিই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তবে ভিন্নমত কিংবা বিরোধের মাত্রা যেন ফ্যাসিবাদ, উগ্রবাদ, চরমপন্থার উত্থান কিংবা পুনর্বাসনের কারণ না হয়ে দাঁড়ায়, সে ব্যাপারে প্রতিটি রাজনৈতিক দল এবং গণতন্ত্রকামী জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল, যার যার দলীয় কর্মসূচি কিংবা এজেন্ডা নিয়ে জনগণের আদালতে যাবেন। জনগণ কোনটি গ্রহণ করবে কিংবা বর্জন করবে, এটি সম্পূর্ণ জনগণের এখতিয়ার। এভাবেই প্রতিদিনের রাজনৈতিক চর্চার মধ্য দিয়েই রাষ্ট্রে জনগণকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে জনগণ যখন সরাসরি নিজের পছন্দের প্রার্থীকে নিজের ভোট প্রয়োগ করে প্রতিনিধি নির্বাচন করে সরকার গঠন কিংবা সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা অর্জন করতে না পারবে, ততদিন রাষ্ট্র ও সরকারে জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হবে না। তাই আসুন, রাষ্ট্র, সরকার, শাসন-প্রশাসন পরিচালনা আর প্রতিদিনের কার্যক্রমে জনগণের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকারচর্চা প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে আমরা জনগণকে শক্তিশালী করে তুলি। জনগণকে শক্তিশালী করে তুলতে না পারলে শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই শক্তিশালী ও টেকসই হবে না।

তারেক রহমান বলেন, ‘মায়ের চোখে বাংলাদেশ’ যেমন আমরা, তেমন একটি বাংলাদেশ গড়তে চাই। যেখানে দলমত, ধর্মবর্ণÑনির্বিশেষে বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী, সংশয়বাদী প্রতিটি সন্তান, প্রত্যেক মানুষ নিরাপদে থাকবে। আজ ও আগামী দিনের প্রতিটি ‘৫ আগস্ট’ হয়ে উঠুক গণতন্ত্র-সুশাসন প্রতিষ্ঠা আর মানবিক মানুষ হয়ে ওঠার অঙ্গীকারের দিন। এই সুমহান অঙ্গীকার বাস্তবায়নের দীর্ঘ যাত্রায় আমি এবং আমার দল বিএনপি দেশের সব গণতন্ত্রকামী জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতা আশা করছি।’

তিনি বলেন, আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে ২০২৪ সালের এই দিনে ফ্যাসিস্ট বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়েছে। রাহুমুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতাপ্রিয়, গণতন্ত্রপ্রিয় জনগণের জন্য দিনটি আনন্দের। দিনটি বিজয়ের। রাহুমুক্ত বাংলাদেশের এই দিনটিকে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করেছে। তাঁবেদারমুক্ত বাংলাদেশের জনগণ প্রতিবছর এই দিনটি স্বাধীনভাবে সানন্দে সরকারি ছুটির দিন হিসাবে উপভোগ করবে। স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকারচর্চার নতুন অঙ্গীকারে উদ্বুদ্ধ হবে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, দেশ ও জনগণের স্বাধীনতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে শহীদরা আমাদের ঋণী করে গেছেন। এবার শহীদদের প্রতি আমাদের ঋণ পরিশোধের পালা। শহীদদের পরিবারের কাছে বাংলাদেশ ঋণী। দেশে জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি ইনসাফভিত্তিক গণতান্ত্রিক মানবিক বাংলাদেশ গঠনের মাধ্যমেই আমরা শহীদদের ঋণ পরিশোধ করতে পারি।

তারেক রহমান বলেন, একুশ শতকের এই বাংলাদেশে পলাতক স্বৈরাচার এক বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম করেছিল। গুম, খুন, অপহরণ, হামলা-মামলা, নির্যাতন-নিপীড়নকে সাধারণ ও স্বাভাবিক ঘটনায় রূপান্তর করেছিল। এই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দেড় দশকের বেশি সময় চলা আন্দোলনের সময় বিএনপিসহ ভিন্ন দল ও মতের গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তির লাখো-কোটি নেতাকর্মীর জন্য দেশকে নরকে পরিণত করে রাখা হয়েছিল। শত শত মিথ্যা মামলার কারণে ভিন্ন দল ও মতের লাখ লাখ নেতাকর্মী সমর্থককে ঘরবাড়িছাড়া করে দেওয়া হয়েছিল। অনেকের পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, গণতন্ত্রকামী মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ করতে পলাতক স্বৈরাচারের নির্দেশে দেশে শত শত গোপন বন্দিখানা ‘আয়নাঘর’ বানানো হয়েছিল। সেই আয়নাঘরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে জলজ্যান্ত মানুষকে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, বছরের পর বছর আটকে রাখা হতো। অনেককে চিরতরে গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। বিএনপির সাবেক সংসদ-সদস্য ইলিয়াস আলী কিংবা কমিশনার চৌধুরী আলমের আজও খোঁজ মেলেনি।
তারেক রহমান বলেন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশনসহ দেশের সব সাংবিধানিক বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানকে অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছিল। সংবিধান উপেক্ষা করে মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে নির্বাচনি ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছিল। দেশকে চিরতরে তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করতে শিক্ষাব্যবস্থাকে বিনষ্ট করার সব আনুষ্ঠানিকতা প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। বই, খাতা-কলমের পরিবর্তে রাজনীতির নামে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল লগি-বৈঠা-হাতুড়ি-চাপাতি। বিপর্যস্ত করে দেওয়া হয়েছিল দেশের অর্থনীতি। ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া করে ফেলা হয়েছিল। দেশ থেকে ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার করে দেওয়া হয়েছে। অন্যায়-অনিয়ম, অনাচার-দুরাচার ও লুটপাট দৈনন্দিন চিত্র হয়ে উঠেছিল। দেশে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল ব্যক্তিতন্ত্র।

তিনি বলেন, তবে ফ্যাসিস্টের শেষরক্ষা হয়নি। দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ, ছাত্র-জনতা, কৃষক শ্রমিক, রিকশাওয়ালা, মুটে মজুর, গার্মেন্টকর্মী, হোটেল-রেস্তোরাঁকর্মী, পরিবহণ শ্রমিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, গৃহবধূ, নারী-শিশু, এমনকি আমাদের মায়েরা- সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে রাজপথে নেমে এসেছিল। গণ-অভ্যুত্থান দমন করতে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। কোলের শিশু, আবু সাঈদ, ওয়াসিম, মুগ্ধ- আমাদের এই সাহসী সন্তানদের বুকে গুলি করে শহীদ করে দেওয়া হয়েছে।

তারেক রহমান আরও বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসের ঘৃণ্যতম ফ্যাসিস্ট পালিয়ে যাওয়ার পরপরই বীর জনতার উদ্দেশে দেওয়া অভিনন্দনবার্তায় বলেছিলাম, বিজয়ীর কাছে পরাজিতরা নিরাপদ থাকলে বিজয়ের আনন্দ মহিমান্বিত হয়। সেটি পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়ে দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণের প্রতি আমার আহ্বানÑকেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। মব ভায়োলেন্সকে উৎসাহিত করবেন না। নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করবেন না। অন্যের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকুন।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor