নতুন ওষুধটির কার্যকারিতা পরীক্ষায় ভালো ফল পাওয়া গেছে। এতে রোগীরা আগে চিকিৎসার পর গড়ে যে সময় পর্যন্ত ক্যানসারমুক্ত থাকতে পারতেন, সে তুলনায় দ্বিগুণ সময় পর্যন্ত ক্যানসার ঠেকাতে পারছেন।
মাথা ও গলার গুরুতর ক্যানসারে আক্রান্ত মানুষের ইমিউনোথেরাপি চিকিৎসা পদ্ধতিতে সাফল্য এসেছে। এ থেরাপি শরীরে নতুন করে ক্যানসার ফিরে আসা বিলম্বিত করে রোগীকে আরও দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে ভূমিকা রাখে। এ পদ্ধতিতে টিউমার অস্ত্রোপচারের আগে ও পরে বিশেষ একটি ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
ইমিউনোথেরাপি চিকিৎসায় নতুন এ ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষায় এমন সাফল্য দেখা গেছে।
এ–সংক্রান্ত গবেষণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা বলছেন, গত ২০ বছরে এমন জটিল ধরনের ক্যানসারের চিকিৎসায় এটিই প্রথম বড় ধরনের অগ্রগতি বা সাফল্যের ইঙ্গিত।
যুক্তরাজ্যের ডার্বিশায়ারের বাসিন্দা ৪৫ বছর বয়সী লরা মার্সটন বলেন, ছয় বছর আগে তাঁর গুরুতর পর্যায়ের জিবের ক্যানসার ধরা পড়ার পর তাঁর বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম ছিল। এখনো যে বেঁচে আছেন, সেটা ভেবে তিনি ‘বিস্মিত’।
মার্সটন তাঁর অস্ত্রোপচারের আগে ও পরে নতুন ধরনের ইমিউনোথেরাপি নিয়েছিলেন। গবেষকেরা বলছেন, এ ইমিউনোথেরাপি শরীরকে ফিরে আসা ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে শেখায়।
মাথা ও গলার ক্যানসারের চিকিৎসা খুবই কঠিন। দুই দশকে এ ধরনের ক্যানসারের চিকিৎসাপদ্ধতিতে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। গুরুতর পর্যায়ে মাথা ও গলার ক্যানসার শনাক্ত হওয়া রোগীদের প্রায় অর্ধেকের বেশি পাঁচ বছরের মধ্যে মারা যান।
লরা মার্সটন নামের ওই নারী বলেন, ২০১৯ সালে তাঁর জিবে ক্যানসার ধরা পড়ে। তখন বলা হয়েছিল, তাঁর বাঁচার সম্ভাবনা মাত্র ৩০ শতাংশ। এরপর বড় অস্ত্রোপচার করা হয়। জিব ও গলার লিম্ফ নোডগুলো অপসারণ করতে হয়। এরপর তাঁকে আবার কথা বলা ও খাওয়া শিখতে হয়েছে।
বিবিসি নিউজকে মার্সটন বলেন, ‘আমার তখন ৩৯ বছর বয়স এবং খুব ভেঙে পড়েছিলাম।’
নতুন এ ইমিউনোথেরাপি শরীরের অন্য অংশে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি উল্লেখজনকভাবে কমিয়ে দেয়। আর এটাকে আশাব্যঞ্জক হিসেবে দেখছেন তিনি। কারণ, ক্যানসার একবার শরীরে ছড়িয়ে পড়লে তার চিকিৎসা করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যায়।
কেভিন হারিংটন, গবেষণায় নেতৃত্বদানকারী অধ্যাপক
ক্যানসারের নতুন চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে এক আন্তর্জাতিক গবেষণার অংশ হিসেবে ৩৫০ জন রোগীর ওপর ওষুধ পেম্ব্রোলিজুমাবের পরীক্ষা চালানো হয়। লরা ছিলেন তাঁদেরই একজন। গবেষণায় নমুনা হিসেবে নেওয়া রোগীদের শরীরে অস্ত্রোপচারের আগে–পরে এ ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছিল।
যুক্তরাজ্যে ওষুধটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগের কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন অধ্যাপক কেভিন হারিংটন। তিনি প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘(টিউমার অপসারণের আগে ওষুধটি প্রয়োগের মাধ্যমে) আমরা শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সময় দিই, যেন সে টিউমারটি ভালোভাবে চিনতে পারে ও ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য শক্তি তৈরি করতে পারে। টিউমার অপসারণের পরও আমরা এক বছর পর্যন্ত এ ওষুধ চালিয়ে যাই, যেন প্রতিরোধক্ষমতা আরও বাড়ে।’
একই ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত সমানসংখ্যক রোগীর অন্য একটি দলকে সাধারণ বা প্রচলিত চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা মাথা ও গলার ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন, শরীরের অন্য কোথাও তা ছড়ায়নি।
নতুন ওষুধটির কার্যকারিতা পরীক্ষায় ভালো ফল পাওয়া গেছে। এতে রোগীরা ইতিপূর্বে চিকিৎসার পর গড়ে যে সময় পর্যন্ত ক্যানসারমুক্ত থাকতে পারতেন, তার তুলনায় দ্বিগুণ সময় পর্যন্ত ক্যানসার ঠেকাতে পারছেন।
তা ছাড়া যাঁদের পেম্ব্রোলিজুমাব ওষুধ দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের ক্ষেত্রে তিন বছর পর দেখা গেছে, শরীরে ক্যানসার ফেরত আসার ঝুঁকি ১০ শতাংশ কমেছে।
লরা এখন পূর্ণকালীন কাজ করছেন। বলেছেন, তিনি ভালো আছেন ও দারুণভাবে চলছেন।
লরা বলেন, ‘আমি এখনো যে আছি ও আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারছি, তা আমার জন্য বিস্ময়কর এক ঘটনা। কেউ ভাবেনি, আমি এতটা পথ আসতে পারব। আমার বাঁচার সম্ভাবনা তখন খুবই কম ছিল।’
লরার জিবের অংশ কেটে ফেলার পর মুখে যে ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়েছিল, তা পূরণ করতে তাঁর বাঁ হাত থেকে পেশি নিয়ে সেখানে বসানো হয়। এটা ছিল একটি কঠিন ও কষ্টকর পথচলা।
লরা বলেন, ‘এ অসাধারণ ইমিউনোথেরাপি আমার জীবনটা আবার ফিরিয়ে দিয়েছে।’
গবেষকেরা বলছেন, এ সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হলো, অস্ত্রোপচারের আগে ওষুধ দেওয়া। সে ওষুধ শরীরকে ক্যানসার চিনতে শেখায় ও ভবিষ্যতে তা ফিরে এলে ধ্বংস করতে সাহায্য করে।
অধ্যাপক হারিংটন বলেন, এ ইমিউনোথেরাপি শরীরের অন্য অংশে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি উল্লেখজনকভাবে কমিয়ে দেয়। আর এটাকে আশাব্যঞ্জক হিসেবে দেখছেন তিনি। কারণ, ক্যানসার একবার শরীরজুড়ে ছড়িয়ে পড়লে তার চিকিৎসা করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যায়।
হারিংটন বলেন, কিছু রোগীর ক্ষেত্রে এই চিকিৎসাপদ্ধতি খুব ভালো কাজ করেছে। তবে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের আওতায় থাকা সব রোগীর উপকার হচ্ছে দেখে তিনি খুব খুশি।
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলগুলো আমেরিকান সোসাইটি অব ক্লিনিক্যাল অনকোলজির বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
নতুন ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার কাজে ২৪টি দেশের ১৯২টি হাসপাতাল অংশ নিয়েছিল। এ কাজ পরিচালনা করেছে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি মেডিকেল স্কুল। আর অর্থায়ন করেছে ওষুধ কোম্পানি এমএসডি।
Publisher & Editor