শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

ইসলাম উদ্দিন পালাকারের গল্প

প্রকাশিত: ০০:০৬, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ৩৯

পালাগানের নেশায় কৈশোরে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন ইসলাম উদ্দিন। ওস্তাদের কাছ থেকে ৯ মাসের তালিম নিয়ে ঘরে ফেরেন। চার দশকের ক্যারিয়ারে পালাগান নিয়ে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ঘুরে এসেছেন বিদেশ। প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০২৩ সালে কোক স্টুডিও বাংলার ‘দেওরা’ গান দিয়ে নতুন করে আলোচনায় আসেন এই শিল্পী। নুহাশ হুমায়ূনের ওয়েব সিরিজ ২ষ–তে তাঁকে অভিনেতা হিসেবেও দেখা গেছে। পালাকারের সঙ্গে দেখা করতে তাঁর গ্রাম নোয়াবাদে গিয়েছিলেন নাজমুল হক।

এগারসিন্দুর প্রভাতী যখন কিশোরগঞ্জে থামল, তখন সময় বেলা ১১টা। ট্রেন থেকে নেমে এক মিনিটের হাঁটাপথে একরামপুর বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে আমাদের গন্তব্য করিমগঞ্জ উপজেলার নোয়াবাদ গ্রাম, ইসলাম উদ্দিন পালাকারের বাড়ি। অটোতে করে পৌঁছে যাই দরগার ভিটা বাজার। সেখানে আমাদেরই অপেক্ষায় ছিলেন ইসলাম উদ্দিন। জানান, অনুষ্ঠান না থাকলে এখানেই সারা দিন কাটান। নির্মাণাধীন একটি ভবনের ছাদে চা, মোগলাই খেতে খেতে জমে ওঠে আড্ডা। শুরুতে নুহাশ আহমেদের দ্বিতীয় ‘ষ’–এর ‘বেসুরা’ প্রসঙ্গ। এখানে গায়কের চরিত্রেই অভিনয় করেছেন। ‘এটাতে অভিনয়ের প্রস্তাব পাওয়ার পর কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলাম। এরপর যখন শুনলাম প্রীতম ভাই আছে, কিছুটা চিন্তা কমে যায়। নিজে নিজে চিন্তা করলাম যাত্রায় কত কঠিন কঠিন গল্পে অভিনয় করলাম জীবনে। আর এইখানে তো পরিচালক বলে দিবেন, আমি শুধু পারফর্ম করব। রাজি হয়ে গেলাম। গানটা যখন রেকর্ড হলো, চিন্তাটা একদম কমে গেল। আর নুহাশ ভাই অনেক ভালো মানুষ, আমাকে যথেষ্ট সম্মান করে সব দেখিয়ে দিয়েছে।’ বললেন ইসলাম উদ্দিন।

স্মৃতির ঝাঁপি খুলে সত্তর-আশির দশকে ফিরে গেলেন ইসলাম উদ্দিন। গ্রামে গ্রামে যাত্রা থেকে পালাগানের আসর বসত, রাতভর দর্শকেরা উপভোগ করতেন নাটক, উঠানে পাটি পেতে শুনতেন গান। ইসলাম উদ্দিন তখন মক্তবের ছাত্র। বয়স ১২ থেকে ১৩। বড় দুই ভাই তখন গ্রামের যাত্রায় অভিনয় করতেন। ভাইদের নাটক দেখতে গ্রামের পর গ্রাম গেছেন তিনি। সে সময় নতুন একটি নাটকের জন্য অভিনেতা খুঁজছিল যাত্রার দল। সব চরিত্র পাওয়া গেলেও নায়ক চরিত্রে কাউকে মনমতো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সে নাটকের একটি চরিত্রে অভিনয় করছিলেন ইসলাম উদ্দিনের এক চাচাতো ভাই। তিনিই সন্ধান দেন ইসলামের। পালাকারকে এ চরিত্রে নিতে তাঁর বড় ভাইকে রাজি করান যাত্রা দলের ম্যানেজার। এভাবেই শুরু হয় ইসলাম উদ্দিনের অভিনয়জীবন।

‘তখন কত আসর হতো। আমাদের গ্রাম থেকে পাশের গ্রাম, যাত্রা, গানের অনেক আয়োজন হতো। আমার বড় দুই ভাই তখন ‘‘ঝুমুর যাত্রা”য় অভিনয় করতেন। তাঁদের অভিনয় দেখতে আশপাশের গ্রামে যেতাম। এমন সময় তাঁদের দল নতুন নাটক ‘‘কাসেম মালা”র প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তবে সব চরিত্র পাওয়া গেলেও কাসেম চরিত্রে তখন কাউকে পছন্দ করতে পারেননি হারমোনিয়াম মাস্টার। এ গল্পেই আমার এক চাচাতো ভাই আমির বাদশাহ চরিত্রে চূড়ান্ত হন। ও জানত, আমি মক্তবে গেলেও মাঝে মাঝে মাঠে-ঘাটে গানে টান দিই। ও তখন আমার নাম প্রস্তাব করে। এ দলেরই ম্যানেজার সম্পর্কে আমার বড় ভাইয়ের উকিল শ্বশুর। পরদিন সকালেই কমিটির পাঁচ-সাতজন নিয়ে আমাদের বাড়িতে হাজির হন তিনি। তাঁরা সবাই বড় ভাইকে রাজি করান। এভাবেই প্রথম কাসেম চরিত্রে অভিনয় করি।’ বলে গেলেন ইসলাম উদ্দিন।

ওস্তাদের সন্ধানে
একবার নোয়াবাদে পালাগান গাইতে আসেন কুদ্দুস বয়াতি। বয়াতির পরিবেশনায় ইসলাম উদ্দিন মুগ্ধ। কুদ্দুস বয়াতিকেই ওস্তাদ মানেন তিনি। তাঁর ভাষ্যে, ‘‘১৯৮৮ সালের দিকের কথা। কুদ্দুস বয়াতির পালা দেকতাছিলাম আর ভাবতাছিলাম, যাত্রায় আমরা ২০-২২ জন অভিনয় কইরা দর্শকরারে বসাইয়া রাহার চেষ্টা করি, হেনো পালাগানে একজন শিল্পীই হাজার হাজার দর্শকরে ধইরে রাহেন। ওনার পরিবেশনা দেইক্কা বাড়িত আইসা চিন্তা করতে লাগলাম, এইডা আমারে শিখতেই অইবো। পাঁচ–ছয় মাস পর কাউরে না বইল্লা এক বন্ধুরে লইয়া বাড়িত্তে সাইকেলে কইরা নেত্রকোনায় ওস্তাদের বাড়ি যাইগা। ওস্তাদের সাথে দেহা হইলে তিনি আমারে চইল্লা আসতে বলেন। হেই দিন বাড়ি ফিরা আইলেও কাউরে জানাই নাই। এরফরে, আর কয় দিন ফর শিহনের লাইগ্যা যহন বাড়ি ছাড়ি তহন এক বন্ধুরে কইয়া গেছিলাম, বাড়িত সবাইরে যেন জানায়। এইভাবেই ওস্তাদের সান্নিধ্য পাই। ৯ মাস ওস্তাদের পেছন পেছন ঘুইরা পালাগান শিখতে তাহি। টানা ছয় মাস তাহনের পরে একবার বাড়িত আইছলাম। এরফরে ফিইরা গিইয়া আবার তিন মাস শিইক্কা একবারে গ্রামে ফিইরা আসি। প্রথম ছয় মাস ওস্তাদের সাথে শুধু ঘুরছি, শেষ তিন মাসে সব রপ্ত করি।’

পালাকার হয়ে ওঠা
চৈত্র মাস, চারদিকে তখন অভাব–অনটন। এ সময়ে অনুষ্ঠানের সংখ্যাও তখন কিছুটা কম থাকে। সে সময় ছোট একটা দল নিয়ে হাওরের বিভিন্ন গ্রামে সফরের জন্য কুদ্দুস বয়াতির কাছে অনুমতি চান ইসলাম উদ্দিন। তবে কুদ্দুস বয়াতির ভরসা হচ্ছিল না, ইসলাম কি পারবে সামলাতে? সবশেষে রাজি হয়ে কদিন রিহার্সাল করতে বলেন। রিহার্সাল শেষে তিনজনের দল নিয়ে হাওরে বেরিয়ে পড়েন ইসলাম উদ্দিন। টানা ২৪ দিনের সফর শেষে ওস্তাদের বাড়ি ফেরেন। পরদিনই ফিরে আসেন নোয়াবাদ গ্রামে। সঙ্গে নিয়ে আসেন তিনজন যন্ত্রশিল্পী। যন্ত্রশিল্পীরা প্রশিক্ষণ দেন স্থানীয়দের। ইসলাম উদ্দিন গঠন করেন ‘ইসলাম উদ্দিন পালাকার ও তাঁর দল’। দিনে দিনে দেশব্যাপী পরিচিতি বাড়তে থাকে তাঁর।

স্মৃতি হাতড়ে ইসলাম উদ্দিন বলেন, ‘তখন মাত্র শেখা শেষ করলাম। চৈত্র মাস, অনুষ্ঠান অনেক কম। ওস্তাদরে বললাম আমি দল নিয়ে বাইর হই। উনি বললেন, ‘‘বাইর হইবি, ফারবি তুই?’’ আমি বললাম, হ ওস্তাদ, ফারবাম। ওস্তাদ বললেন, ‘‘আচ্ছা রিহার্সাল কর।” ওনার দলের কয়েকজনকে নিয়ে রিহার্সাল করতে লাগলাম। আমার প্রতি ওনার দলের সবার একটা আত্মবিশ্বাস জন্মাতে দেখলাম। এরপর তিনজনের একটা দল নিয়ে বের হই। প্রথম দিকে নিজেদের আত্মীয়র বাড়ি খুঁজতে লাগলাম। যাতে করে থাকা–খাওয়ার টাকা না লাগে। এর একটি গছিখাই গ্রাম। যেখানে গিয়ে মনে হলো এ যেন নিজের এলাকা। সেখানের বিভিন্ন পাড়ায় পালা করতে থাকলাম। তখন সম্মানী নিয়েও কাউকে কিছু বলিনি। তো একদিন একজন মাতবর আমাদের ডেকে বললেন, ‘‘ও কিচ্ছাদাররা, তোমরা কিচ্ছা কইতে থাহো আর হিসাব রাহো। টেহা আমি দিমুনে।” এভাবে টানা ৯ দিন সেখানে পালা করলাম। এরপর গেলাম খালিয়াজুরী, ইয়ারাবাজ, নিজগাঁও হয়ে একবারে আটগ্রাম। এভাবেই শেষ হয় ২৪ দিনের সফর। খরচ বাদ দিয়ে ওস্তাদের হাতে তুলে দিই ২ হাজার ৭০০ টাকা। পরদিনই তিনজন মিউজিশিয়ান নিয়ে ফিরে আসি নোয়াবাদ। তিনজনই ছিল ওস্তাদের এক্সট্রা মিউজিশিয়ান। এই তিনজন স্থানীয়দের প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করে চলে গেল। আর আমি আমার দল নিয়ে এই যে শুরু করলাম।’

উত্তরসূরি কি পেলেন
একসময় হাওরে গ্রামে গ্রামে পালাগানের আসর বসলেও এখন সে সংখ্যা হাতে গোনা। অনুষ্ঠানের সংখ্যা ক্রমে কমছে। জীবনের প্রয়োজনে অনেক শিল্পীই তাই বদলেছেন পেশা। নতুন কোনো দলও তৈরি হচ্ছে না। কুদ্দুস বয়াতির হাতে তৈরি ইসলাম উদ্দিন কি উত্তরসূরি পেয়েছেন? পালাকারের কথায়, ‘এখনকার ছেলেপেলেদের মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখি না। সাধনার জন্য তো সময় দিতে হয়, ধৈর্য থাকতে হয়। কিন্তু এখন সবাই তো জীবন–জীবিকায় ব্যস্ত। একটু বড় হলেও পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে পড়ছে। তাই হয়তো আগ্রহীদের সংখ্যা কম। এটা তো এলেম, যে কাউকে তো শেখানো যায় না। এর জন্য যে পরিশ্রম করতে পারবে, তাকেই দেওয়া হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন ইসলাম উদ্দিন পালাকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পালার প্রতি আগ্রহ তাঁকে আশাবাদী করেছে। ইসলাম উদ্দিনের ভাষায়, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পশিক্ষণ দেই। পত্যেকটা জিনিসের ফতি তারার ভীষণ আগ্রহ। হয়তো তারার আতই বাইচ্চা তাকবো এই সব ফালা।’ এরপরও ইসলাম উদ্দিন স্বপ্ন দেখেন। শীত–বর্ষায় গ্রামে গ্রামে পালাগান হবে। উঠানে পাটি পেতে বাচ্চা, বড়রা আসরে মজবে। সে ভিড় থেকেই হয়তো আরেকজন ছোট্ট ‘ইসলাম উদ্দিন’ মুগ্ধ হবে। পালার প্রতি আগ্রহ নিয়ে সাইকেলে ছুটবে কোনো ওস্তাদের বাড়ি। শিখে–পড়ে জাহাঙ্গীর বাদশা, মতিলাল ও রূপকুমার, কমলারানী নিয়ে ছুটে ছুটে যাবে দেশ–বিদেশ।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor