বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ডায়াবেটিস হঠাৎ বেড়ে গিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে, কীভাবে জানেন

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫৯

মনে করুন কোনো কারণে হঠাৎ ইনসুলিনের মাত্রা অস্বাভাবিক কমে গিয়ে আপনার রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণের বাইরে অনেক বেড়ে বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছে গেল। তখন শরীরে কিছু আকস্মিক পরিবর্তন ঘটে। প্রথমেই সবচেয়ে বড় ধাক্কা খায় বিপাকক্রিয়া বা মেটাবলিক সিস্টেম। আমাদের দৈনন্দিন কাজের জ্বালানি বা ফুয়েল হলো গ্লুকোজ। রসায়নের ছাত্ররা জানেন যে শরীরে প্রতিনিয়ত ক্রেবস চক্রের মাধ্যমে এই গ্লুকোজ শক্তি উৎপন্ন করে চলেছে, যা দিয়ে আমাদের সব শারীরিক কার্যক্রম চলে।

ইনসুলিনের অভাবে এই গ্লুকোজ ভেঙে শক্তি উৎপাদনের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তখন বিকল্প পদ্ধতিতে শরীরের চর্বির কোষ ভেঙে শক্তি উৎপাদনের চেষ্টা শুরু হয়। কিন্তু চর্বি কোষ ভাঙতে ভাঙতে একসময় বিপুল পরিমাণে ফ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড জমা হয়ে গেলে যকৃত তা আর ‘ম্যানেজ’ করতে পারে না। তখন এই বাড়তি ফ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড রূপান্তরিত হতে থাকে কিটো অ্যাসিডে।

তিন ধরনের কিটো অ্যাসিড রয়েছে—অ্যাসিটোন, অ্যাসিটো অ্যাসিটিক অ্যাসিড ও বিটা হাইড্রোক্সি বিউটারিক অ্যাসিড। এ তিনটি অ্যাসিডই অত্যন্ত শক্তিশালী। এগুলো রক্তে জমা হতে থাকলে রক্তের পিএইচ কমে যায়। রক্তে অ্যাসিডিটি বা অম্লতার মাত্রা বাড়ে। ফলে রোগী অচেতন হয়ে পড়ে। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। চিকিৎসা যথাসময়ে শুরু না হলে মৃত্যু অবধারিত।

জেনে রাখা ভালো, আমাদের রক্তের পিএইচ ৭ দশমিক ৩৪ থেকে ৭ দশমিক ৪৫—এই ক্ষীণ লাইন মেনে চলে। পিএইচ কমে যাওয়া খুবই বিপজ্জনক। এতে শরীরের সবকিছু ওলটপালট হয়ে যেতে থাকে। পিএইচ ৭–এর নিচে চলে গেলে রোগীকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই গুরুতর পরিস্থিতির নাম ডায়াবেটিস কিটো অ্যাসিডোসিস। ডায়াবেটিস বেড়ে গিয়ে আকস্মিক মৃত্যুর এটি অন্যতম প্রধান কারণ। যেহেতু ইনসুলিনের অভাব এই সমস্যার মূলে, তাই টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসেই এ সমস্যা বেশি দেখা যায়। টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস সাধারণত শিশু–কিশোর বা তরুণদের হয়ে থাকে। যার কারণ, অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষ থেকে ইনসুলিন তৈরি হয় না।

কেন হয় কিটো অ্যাসিডোসিস

কেন এমন পরিস্থিতি দেখা দেয়? বেশির ভাগ ক্ষেত্রে টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসের শিশু বা কিশোরদের প্রথম ডায়াবেটিস ধরাই পড়ে এ রকম বিপজ্জনকভাবে। টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। ৭০ শতাংশ কোষ নষ্ট হয়ে গেলে ইনসুলিনের মারাত্মক অভাব দেখা দেয়। ঠিক তখনই গ্লুকোজনির্ভর শক্তি উৎপাদনের চক্র বদলে গিয়ে চর্বি ভাঙার চক্রে রূপান্তরিত হয়। তখন বিপুল পরিমাণে কিটো অ্যাসিড তৈরি হতে থাকে। কোনো কারণে টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসের রোগী কয়েক বেলা বা কয়েক দিন ইনসুলিন ভুলবশত বন্ধ রাখলেও একই ঘটনা ঘটে। টাইপ টু ডায়াবেটিসের রোগীরাও চিকিৎসা না নিলে বা বন্ধ রাখলে রক্তে শর্করা অনেক বেড়ে গিয়ে এই বিপদ হতে পারে। সংক্রমণ, সার্জারি, ডিহাইড্রেশন, বমি, প্রেগন্যান্সি ইত্যাদি এ সমস্যার অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। ফলে এমন সব পরিস্থিতিতে কিটো অ্যাসিডোসিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়।

কীভাবে বুঝবেন

রক্তে শর্করা অনেক বেশি বেড়ে গেলে সাধারণত তা গ্লুকোমিটারের নির্দেশক মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। ৩০ মিলিমোল/লিটার মাত্রার ওপর গ্লুকোজ গ্লুকোমিটার যন্ত্র আর ধরতে পারে না—‘হাই’ বা ‘এরর’ দেখাতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে রোগীর প্রথম দিকে বারবার গলা শুকিয়ে আসা, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার সঙ্গে মারাত্মক পানিশূন্যতা দেখা দিতে থাকে। পিএইচ পরিবর্তিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগী অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে থাকে। অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। কেউ কেউ অচেতন হয়ে পড়ে। মুখের শ্বাসের সঙ্গে অ্যাসিটোন নির্গত হওয়ার জন্য একধরনের অ্যাসিডিক গন্ধ আসতে থাকে। তারপর শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। এই শ্বাসকষ্টের একটা নির্দিষ্ট ‘প্যাটার্ন’ আছে, যাকে বলে ‘কুসমাউলস ব্রিদিং’। রক্তচাপ দ্রুত নামতে থাকে, রক্তের ইলেকট্রোলাইটস বা খনিজ লবণ উল্টাপাল্টা হয়ে যায় এবং রেসপিরেটরি ফেইলিউরও হতে পারে। এ রকম অবস্থায় রোগীকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র ছাড়া চিকিৎসা করা প্রায় অসম্ভব। পুরো ঘটনা ঘটতে কয়েক ঘণ্টা বা দু–এক দিন সময় লাগে। ফলে দ্রুত শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। বলা হয় যে তিন–চার ঘণ্টার মধ্যে রোগীকে দ্রুত নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসা শুরু করা না হলে মৃত্যুহার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায়।

কী করবেন

ডায়াবেটিক কিটো অ্যাসিডোসিস একটি মেডিকেল ইমার্জেন্সি। কারও যদি ডায়াবেটিস অত্যধিক বেড়ে যায়, যা গ্লুকোমিটার যন্ত্রের সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে, রোগী অসংলগ্ন আচরণ করতে থাকলে বা চেতনা হারিয়ে ফেলতে থাকলে—দ্রুততম সময়ের ভেতর হাসপাতালে নিতে হবে। যাঁদের ডায়াবেটিস আছে তাঁরা কখনোই আকস্মিকভাবে ওষুধ বা ইনসুলিন বন্ধ করে দেবেন না। বিশেষ করে যখন কোনো শারীরিক অসুস্থতা, যেমন জ্বর, সংক্রমণ, বমি, ডায়রিয়া ইত্যাদি হয়। অনেকের ধারণা, অসুস্থ হলে খাওয়া কমে যায় বলে ইনসুলিন নিতে হবে না। এ ক্ষেত্রে বারবার রক্তের শর্করা পরীক্ষা করে দেখে নিতে হবে পরিস্থিতি কোনদিকে গড়াচ্ছে। যদি বিপজ্জনক হারে বাড়তে থাকে তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

বারবার গলা শুকিয়ে আসা বা প্রস্রাব হওয়ার মতো সমস্যা হলে রক্তের শর্করা পরীক্ষা করুন। অনেকে কোথাও বেড়াতে গেলে বা উৎসব অনুষ্ঠানের সময়, জার্নি করার সময় ইনসুলিন বা ওষুধ বন্ধ রাখেন, ভাবেন এতে কিছুই হবে না। কিন্তু হঠাৎ শর্করা বেড়ে গেলে বিপদ হতে বেশিক্ষণ লাগবে না। ডায়াবেটিসের রোগীর কোনো অপারেশন প্রয়োজন হলে অবশ্যই সে সময় ভালোভাবে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নয়তো এ সময় কিটো অ্যাসিডোসিস হতে পারে। ডায়াবেটিসের রোগীদের, বিশেষ করে টাইপ ওয়ান ও অন্তঃসত্ত্বা নারীরা কিটো ডায়েট করলেও কিটো অ্যাসিডোসিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। কিটো ডায়েটে শর্করাজাতীয় খাবার একেবারে কমিয়ে ফেলে চর্বিজাতীয় খাবার বাড়ানো হয়। চর্বি কোষ ভাঙতে থাকে বলে রক্তে কিটো অ্যাসিড উৎপন্ন হয়। সে ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকতে হবে।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor