বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫

ছয় ঋতুর বাড়ি

প্রকাশিত: ০৪:৫১, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ |

পৌষের বাবা ও কাকারা ছয় ভাই। পৌষরাও ছয় ভাই-বোন। ওদের একেকজনের আলাদা আলাদা ঋতুতে জন্ম। প্রত্যেকের নামও রাখা হয়েছে সেই ঋতুর সঙ্গে মিলিয়ে।

পৌষের অসীম কাকুর ছেলের জন্ম গ্রীষ্মকালে। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাস নিয়ে গ্রীষ্মকাল। তাই ওর নাম রেখেছে বৈশাখ। অর্ণব কাকুর মেয়ে বর্ষাকালে জন্মেছে। আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস নিয়ে বর্ষাকাল। সেখান থেকে মেয়ের নাম রাখা হয়েছে বর্ষা। পৌষের  রতন কাকুর ছেলের নাম শরৎ। ভাদ্র ও আশ্বিন মাস নিয়ে শরৎকাল। এই কালে জন্মেছে বলে সেই ছোট্ট থেকে বাড়ির সবাই ওরে শরৎ নামেই ডাকে। হেমন্তকালে পৌষের অরুণ কাকুর ছেলের জন্ম। সেই ছেলের নাম ফসল। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস নিয়ে সৃষ্ট হেমন্তকালের সময়টাতে মাঠে ফসল তোলার প্রস্তুতি থাকে। সেই বুঝে ফসল ওর নাম।

পৌষ শীতকালে জন্মগ্রহণ করেছে। পৌষ ও মাঘ মাস নিয়ে শীতকাল। তাই ওর নাম পৌষ। পাতার জন্ম বসন্তাকালে। ফাল্গুন ও চৈত্র মাস নিয়ে বসন্তকাল। আর এই সময় প্রকৃতিতে নতুন পাতা ও ফুল ফোটে। বসন্তকালের নতুন পাতার সঙ্গে মিলিয়ে পৌষের অধীর কাকুর মেয়ের নাম পাতা।
প্রতিবেশী সবাই পৌষদের বাড়িটাকে ছয় ঋতুর বাড়ি বলে চেনে। কারণ ছয় ঋতুতেই এই বাড়িতে উৎসব হয়। প্রতিটি উৎসবে ওরা পাড়া, প্রতিবেশী, আত্মীয়দের নিমন্ত্রণ করে। নাচে-গানে আর নানা স্বাদের খাবার দিয়ে অতিথিদের বরণ করে নেয়। গেল বছরের ছয় ঋতুতে কী কী উৎসবের আয়োজন করল, চলো শুনি।

প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে একটাই উৎসব করে ওরা। আগের বছরও তাই করেছিল। বাংলা নববর্ষের এই উৎসবে গ্রীষ্মকালে ফোটা বিভিন্ন ফুল সংগ্রহ করে সেই ফুল দিয়ে অতিথিদের বরণ করে। বাড়িতে মেলা বসায়। মেলায় নানা রকম মাটির তৈরি হাঁড়ি, পুতুল, ঘোড়া, মাছ, বাঁশের তৈরি কুলা, ডালা, ঝুড়ি, চালুন, মাছ ধরার চাঁই, হাতে বানানো গয়না, নকশিকাঁথা, গামছা, কাঠের ঘোড়া, হাতি এসবের পসরা সাজিয়ে বসিয়েছিল বৈশাখ। অতিথিরা বৈশাখের দোকান থেকে কত কী কেনে! নববর্ষের উৎসবে ওরা অতিথিদের মুড়িমুড়কি, জিলাপি, বাতাসা, কদমা, তরমুজ, বাঙ্গি দিয়ে আপ্যায়ন করেছিল।

বর্ষাকালে পৌষরা বাড়িতে ফুল, ফল ও সবজির উৎসব করেছিল। বাড়ির উঠোনে থরে থরে সাজানো ছিল কাঁঠাল, জাম, জাম্বুরা, লটকন, আমড়া, গাব, কদবেল, আনারস, ড্রাগন, করমচা, কামরাঙা, আঁশফল ও ডালিম। ফুলের মধ্যে কদম, বেলি, জুঁই, কেয়া, রজনীগন্ধা, জবা, রেন লিলি, গাঁদা, জারুল, শিউলি, মালতী, কপিফুল ও দত্তুরা। সবজির মধ্যে করলা, চিচিঙ্গা, পটোল, বরবটি, ঝিঙা, ঢেঁড়স, ওল, কচু, বেগুন, মিষ্টি কুমড়া, চালকুমড়া এবং বিভিন্ন ধরনের শসা ও পুঁই। পৌষের বাবা ও অর্ণব কাকা ফল ও সবজির পুষ্টিগুণ নিয়ে কথা বলেছিল। বর্ষার আগমনে প্রকৃতিতে ফুলের যে সমারোহ দেখা যায়, তার বর্ণনা করেছিল ওর কার্তিক কাকা। উৎসবে প্রতিবেশী বড়দের সঙ্গে আসা ছোটরা মন দিয়ে শুনেছিল কথাগুলো। কত কী জেনেছে ওরা!

উৎসবের ঋতু শরৎকালে হয় বাঙালির আনন্দ অনুষ্ঠান দুর্গাপূজা। প্রতিবছর এই ঋতুতে পৌষদের বাড়িতেও এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। ঈদ, বড়দিন, বুদ্ধ পূর্ণিমার উৎসবে পৌষরা যেমন প্রতিবেশীদের বাড়িতে বেড়াতে যায়, তেমনি শারদীয় উৎসবে পৌষদের বাড়িতেও প্রতিবেশীরা বেড়াতে আসে। গেল বছর পূজায় ওদের বাড়ির প্রতিমা দেখতে প্রতিবেশীরা তো বটেই, আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে পুরো গ্রামের মানুষ দলে দলে এসেছিল। পৌষরা ভাই-বোন মিলে অতিথি আপ্যায়নে মিষ্টি, ফল আরো কত কী খেতে দিয়েছিল অতিথিদের।

পৌষদের গ্রামের প্রতি ঘরে ঘরেই নবান্ন উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে সবাই। হেমন্তকালের প্রধান এই নবান্ন উৎসব পৌষদের বাড়িতেও হয়। ওরা ভাই-বোনরা মিলে যেমন প্রতিবেশীর বাড়ির নবান্ন উৎসবে যায়, তেমনি প্রতিবেশীরাও পৌষদের বাড়ির নবান্ন উৎসবে যোগ দিতে আসে। গেল বছর পৌষরা নতুন চালের ভাত, পিঠা, পায়েস, চিড়া, মুড়ি তৈরি করে প্রতিবেশীদের নিমন্ত্রণ জানিয়ে এই উৎসব পালন করেছিল। উৎসবে পৌষ প্রতিবেশী অতিথিদের দেশীয় নৃত্য করে দেখায়। ফসল বাউল গান গেয়ে শোনায়। বৈশাখ ও বর্ষা গায় লোকগীতি।

সেবার শীতকালে পৌষরা বাড়িতে উৎসবের মতো করেই চড়ুইভাতি করেছিল। উৎসবে প্রতিবেশী ছোটরাই বিশেষ অতিথি ছিল। ছোটরা যার যার বাড়ি থেকে এটা-ওটা খাবার নিয়ে পৌষদের বাড়িতে আসে। সঙ্গে অভিভাবকরাও ছিল। কলাপাতা জোগাড় করে প্রচুর গাছগাছালি ভরা পৌষদের বাড়ির আঙিনায় সবাই জড়ো হয়ে খাবার ভাগাভাগি করে খায়, গল্প করে। আনন্দভোজন শেষে গান, গল্প, কবিতা আবৃত্তি পাঠ হয়েছিল।

শীতের শুষ্কতা শেষে প্রকৃতিতে নতুন পাতা ও ফুল ফোটে জানান দেয় বসন্ত এসে গেছে। প্রতিবছর পৌষদের বাড়িতে বসন্ত উৎসবের সব আয়োজন পৌষের বোন পাতাই করে। গেল বছর পাতা মূল যে উৎসবের আয়োজন করেছিল, সেটি দোল। রঙের উৎসবও বলা যায়। এই উৎসবে ওরা ভাই-বোনরা একে অপরের গায়ে আবির ও রং ছুড়ে আনন্দ, ভালোবাসা প্রকাশ করে। ওদের সঙ্গে রং উৎসবে যোগ দেয় প্রতিবেশী বন্ধু প্রীতম, পূজা, তন্বী, আলো, আবীর, নেহাল, রায়, শুদ্ধ ও ছোট-বড় আরো কত্ত বন্ধু! সবাই সেদিন নেচে-গেয়ে খুব আনন্দ করেছিল।

পৌষদের বাড়ির ছয় ঋতুর উৎসবগুলোর আয়োজন করতে পৌষরা ভাই-বোনদের সব থেকে বেশি সহযোগিতা করে পৌষের বাবা সরোদ। এই শরতেও পৌষদের বাড়িতে শারদীয় উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। পৌষ জানিয়েছে, ওদের ভাই-বোনের পক্ষ থেকে উৎসবে বন্ধুদের নিমন্ত্রণ।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor