চুল পড়া শুরু করলেই আগে দাদি-নানিরা বলতেন, ‘ন্যাড়া করে ফেল, তাতে নতুন চুল গজাবে।’ এর পেছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আছে। ন্যাড়া করার পর মাথার ত্বকের পোরস্ বা সূক্ষ্ম ছিদ্রগুলো খুলে যায়, ফলে নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে। বর্তমানে অনেকটা সেই কাজই করে ডার্মা রোলার।
শুরুতে ডার্মা রোলারের ব্যবহার সীমিত ছিল চর্মরোগবিশেষজ্ঞ (ডার্মাটোলজিস্ট) ও রূপবিশেষজ্ঞদের কাছে। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে অনেকে এই পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারছেন।
অনেকটা আকুপাংচারের মতো এই পদ্ধতিতে মাথার ত্বকে সূক্ষ্ম সুচের মাধ্যমে রক্ত চলাচল বাড়ানো হয়। ফলে মৃত কোষ সক্রিয় হয়, সেবাম (ত্বকের সেবেসিয়াস গ্রন্থি থেকে উৎপন্ন তৈলাক্ত পদার্থ, যা ত্বককে ময়েশ্চারাইজ করে এবং সুরক্ষা দেয়) ও কেরাটিন (এই প্রোটিন চুল, ত্বক ও নখের মূল উপাদান) উৎপন্ন হয় এবং হেয়ার ফলিকল উজ্জীবিত হয়ে নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে। ডার্মা রোলার ব্যবহারের পুরো বিষয়টি জানা গেল রূপবিশেষজ্ঞ শারমিন কচির কাছ থেকে।
যেভাবে প্রয়োগ করা হয়
ডার্মা রোলারে সাধারণত দুটি ধরনের সুচ থাকে—মাইক্রোনিডল ও ন্যানোনিডল। টাইটানিয়াম সুচ হলে ফল আরও ভালো হয়। প্রথমে সপ্তাহে দুই দিন ব্যবহার করা যেতে পারে, পরে ধীরে ধীরে সপ্তাহে এক দিন করলেই যথেষ্ট। সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো, হালকা চাপ দিয়ে ব্যবহার করা। বেশি চাপ দিলে ক্ষতি হতে পারে। সাধারণত ১৮ বছরের পর থেকে এটি ব্যবহার করা যায়। সুচের মাপও ভিন্ন হয়—০.৫ মিলিমিটার থেকে ২ মিলিমিটার পর্যন্ত।
ডার্মা রোলারের ছোট ছোট সুচেরও কিন্তু মাপ আছে। যাঁরা প্রথমবার এই জিনিস ব্যবহার করবেন, বেছে নিন ০.৫ মাপের সুচটি। পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে নম্বর বাড়াতে পারেন।
যেহেতু এটি ত্বকের গভীরে কাজ করে, তাই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া শুরু করা ঠিক নয়। শুরুতে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে করাই সবচেয়ে নিরাপদ। পরে সঠিক নিয়ম মেনে, ধীরে ধীরে ঘরে বসেও করা যেতে পারে।
ডার্মা রোলারের ব্যবহার
১. যেখানে চুল পাতলা হয়ে গেছে বা ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়েছে, শুধু সেই জায়গায় রোলার ব্যবহার করবেন (এটাকে ০ ডিগ্রি ধরে নেবেন)। না হলে চুলের ফাইবারের ক্ষতি হতে পারে। যদি কারও মাথায় অ্যালার্জি, ঘা বা সোরাইসিসের সমস্যা থাকে, তাহলে আগে সেটার সমাধান করতে হবে।
ওপর থেকে নিচে ঘুরিয়ে রোলারটি ব্যবহার করবেন
২. জ্যামিতিক চাঁদা অনুসারে প্রথমে ওপর থেকে নিচে (৯০ ডিগ্রি) তিনবার ঘুরিয়ে রোলারটি ব্যবহার করবেন। এরপর নিচ থেকে ওপরে একবার রোল করবেন। ০ থেকে ০ ডিগ্রি (ডান থেকে বাঁয়ে, বাঁ থেকে ডানে) পর্যন্ত ঘুরিয়ে রোলার ব্যবহার করবেন। এ সময় চাইলে সিরাম লাগাতে পারেন। এরপর ৪৫ ডিগ্রি কোণে রোল করতে হবে—২ থেকে ৩ বার ডান দিকে, ২ থেকে ৩ বার বাঁ দিকে। কপালের সামনের অংশে সব সময় নিচ থেকে ওপরের দিকে রোল করবেন।
৩. রোলার ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে সিরাম ব্যবহার করলে সবচেয়ে ভালো ফল পাবেন। কারণ, তখন চামড়ার ভেতরে সিরাম দ্রুত ঢুকে কাজ শুরু করে। সিরাম ব্যবহারের পর ১২ ঘণ্টা রেখে দিন।
৪. রোলার ও সিরাম ব্যবহারের পর পুরো মাথায় ৫-১০ মিনিট এলইডি লাইট থেরাপি দিলে আরও ভালো ফল পাওয়া যায়। এলইডি থেরাপি ঘরে ব্যবহারযোগ্য মেশিন দিয়েও করা সম্ভব। এটি সিরামের কার্যকারিতা বাড়িয়ে দেয় এবং ফলাফল দ্রুত দেখা যায়।
৪৫ ডিগ্রি কোণে রোল করতে হবে
৫. রোলার ব্যবহারের আগে অবশ্যই গরম পানি দিয়ে ধুয়ে শুকিয়ে নিন। তারপর স্যানিটাইজার বা জীবাণুনাশক তরলে ডুবিয়ে পরিষ্কার করুন। শুকিয়ে গেলে তবেই ব্যবহার করবেন।
খুব কি কঠিন
অনেকে ডার্মা রোলার ট্রিটমেন্ট করতে গিয়ে ভয় পান, যদি ব্যথা পাই বা রক্ত বের হয়। এসব স্বাভাবিক ব্যাপার। ট্রিটমেন্টের সময় হালকা চিমটি কাটার মতো লাগতে পারে। কারও কাছে একটু বেশি, কারও কাছে একেবারেই সহনীয় মনে হবে বিষয়টি। একেবারে সহ্য না হলে নাম্বিং স্প্রে বা অয়েনমেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। ত্বক কিছুটা লাল হয়ে যেতে পারে, তবে এটা সাময়িক। সাধারণত নিজে থেকেই সেরে যায়, এলইডি থেরাপি (একধরনের আলোক থেরাপি, যা ব্রণ, বলিরেখা ও সোরিয়াসিসের মতো ত্বকের বিভিন্ন সমস্যার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়) নিলে আরও দ্রুত কমে। কখনো কখনো সামান্য রক্ত বের হতে পারে, যেমন হালকা আঁচড় লাগলে হয়। এ সময় অ্যান্টিবায়োটিক অয়েনমেন্ট ব্যবহার করলেই ঠিক হয়ে যায়।
হেয়ার সিরাম বেছে নেওয়ার সময় সতর্কতা
চর্মরোগবিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া সিরাম ব্যবহার করা যাবে না। কোন সিরাম কত শতাংশ হবে, সেটাই আসল বিষয়। মিনোক্সিডিল সিরাম এখন সবচেয়ে কার্যকর এবং পরিচিত। সব সময় শুধু মিনোক্সিডিল নামেই পাওয়া যায় না, অনেক সময় চুল গজানোর সিরাম বা রিগ্রোথ সিরাম নামেও বিক্রি হয়।
এ ধরনের সিরাম ৫ শতাংশ ঘনত্বের হলেই যথেষ্ট। মিনোক্সিডিল না পাওয়া গেলে মিউসিন হেয়ার অ্যান্ড হেয়ার ফল ডিফেন্স সিরাম বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। চুল পড়া কমাতে ও নতুন চুল গজাতে সহায়তা করে।
অর্ডিনারি মাল্টিপেপটাইড সিরামটি বহুমুখী কাজের সিরাম। এটিও ৫ শতাংশ ঘনত্বের হলেই যথেষ্ট। তবে অবশ্যই আসল পণ্য কিনতে হবে। বাজারে যে নকল ‘অর্ডিনারি’ সিরাম পাওয়া যায়, তা ব্যবহার করলে উল্টো ক্ষতি হতে পারে। এ ছাড়া আছে নিউট্রাফল সিরাম। এটি যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় জনপ্রিয়।
Publisher & Editor