বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫

সৌদি আরব ট্রাম্পকে যেভাবে হুঁশিয়ারি দিচ্ছে

প্রকাশিত: ০৯:২৬, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ২৪

গত মঙ্গলবার নিউইয়র্ক সিটিতে গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) দেশগুলোর নেতারা গভীর অস্বস্তিকর পরিবেশে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেন।

উপসাগরীয় অঞ্চলের কোনো একটি দেশে (কাতার) প্রথমবারের মতো ইসরায়েল হামলা চালানোর পর অনুষ্ঠিত এই শীর্ষ বৈঠকে অন্যান্য আরব ও মুসলিম দেশের নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। কাতারে ইসরায়েলের হামলা এমন একটি অপ্রত্যাশিত উত্তেজনা তৈরি করেছে, যা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নিরাপত্তা নিশ্চয়তার ওপর যে বিশ্বাস, সেটিই গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে।

ওই হামলার পর জিসিসির প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরব পাকিস্তানের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে। পাকিস্তান হলো পারমাণবিক শক্তিধর সামরিক শক্তি। মনে করা হচ্ছে, চুক্তিটি স্বাক্ষর না হওয়া পর্যন্ত সৌদি আরব তার অংশীদার দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে এ বিষয়টি জানায়নি।

ওয়াশিংটনে কেউ কেউ এ ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রের বলয় থেকে সৌদি আরবের সরে যাওয়ার ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন। যেন এটা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ছাতার প্রতি সূক্ষ সমালোচনা। কিন্তু এটি ভুল ব্যাখ্যা। এই চুক্তির লক্ষ্য ওয়াশিংটন নয়; বরং এটি এমন একটি পরিপূরক চুক্তি যেটি মার্কিন নিরাপত্তা নিশ্চয়তাকে আরও শক্তিশালী করবে।

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নিরাপত্তা নিশ্চয়তা যে অপর্যাপ্ত সেটি ইতিহাসে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। অতীতে ইরান ও এর মিত্ররা যখন আক্রমণ করেছে এবং সম্প্রতি কাতারে হামাসের মধ্যস্থতাকারীদের লক্ষ্য করে ইসরায়েলি বিমান হামলার সময় তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের উপসাগরীয় ও আরব অংশীদারদের মধ্যে এই উদ্বেগ ও হতাশা নতুন নয়। এটা এক দশকের বেশি সময় ধরে চলমান এবং রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট দুই প্রশাসনের আমলেই সেটি বিরাজমান। ওবামা প্রশাসন উপসাগরীয় ও আরব দেশগুলোর সঙ্গে পরামর্শ না করেই গোপনে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছিল। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ২০১৯ সালে ইরান সমর্থিত হুতিরা সৌদি আরবের তেল স্থাপনাগুলোতে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল। সে সময় ট্রাম্প প্রশাসন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।

যদি ট্রাম্প প্রশাসন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে সৌদি–পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি কেবল একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি থেকেও বেশি কিছু হয়ে উঠতে পারে। আঞ্চলিক বড় শক্তি মিসর ও তুরস্কও মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র পাল্টে দেওয়ার ইসরায়েলি প্রচেষ্টা নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ফলে পাকিস্তান–সৌদি প্রতিরক্ষা চুক্তি অন্যান্য ইসলামী দেশগুলোর প্রতিরক্ষা চুক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে। সেটি ট্রাম্পের বৈদেশিক নীতির প্রধান অর্জন, অ্যাব্রাহাম অ্যাকর্ডসকে দুর্বল করবে।
বাইডেনের আমলে ২০২২ সালে হুতি বিদ্রোহীরা সংযুক্ত আরব আমিরাতে ড্রোন হামলা চালানোর সময়ও মার্কিন প্রশাসন চোখ বন্ধ করে রেখেছিল। এসব ঘটনায় সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও অন্য দেশগুলোতে এমন ধারণা আরও দৃঢ় হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর একমাত্র নির্ভরশীল হওয়া যায় না।

গত সপ্তাহের দোহায় হামাসের শান্তি আলোচনাকারীদের ওপর ইসরায়েলের নির্লজ্জ বিমান হামলা এই দুশ্চিন্তাকে আরও তীব্র করে দিয়েছে। বছরের পর বছর ধরে উপসাগরীয় অঞ্চলের শাসকেরা ইরান নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন; কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ আঞ্চলিক মিত্র ইসরায়েল যখন লাল রেখা অতিক্রম করে আক্রমণ করেছে, তখন এই প্রশ্নটিই সামনে চলে আসে যে, মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে ওয়াশিংটন কতটা ইচ্ছুক।

ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করেছে, তারা হামলাটি প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়নি, তার কারণ হলো ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান আকাশ ওড়ার সময় এবং ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার আগমুহূর্তে তাদেরকে জানিয়েছে। কিন্তু খুব কম আরব নেতা এই বয়ানকে বিশ্বাস করেন। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ট্রাম্পকে যথেষ্ট আগেই সতর্ক করা হয়েছিল।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কথাবার্তা ও ও কর্মকাণ্ড আরব নেতাদের মধ্যে আরও উদ্বেগ বাড়িয়েছে। লেভান্ত অঞ্চলে ইরান-সমর্থিত অক্ষশক্তির বড় অংশ ধ্বংস করার পর, নেতানিয়াহু এখন দাবি করছেন যে ইসরায়েল ‘সাতটি ফ্রন্টে’ লড়াই করছে। এটা এমন একটি বিস্তৃত ঘোষণা যেটা ইঙ্গিত দেয় যে কথিত আত্ম প্রতিরক্ষার বাইরে অঞ্চলিক সীমানা পুনর্গঠনের উচ্চাকাঙক্ষা তাঁর রয়েছে।

ইতিমধ্যেই, ইসরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ লেবানন ও দক্ষিণ সিরিয়ায় ভূখণ্ড দখল করেছে। পশ্চিম তীরের বড় অংশ দখলের প্রকাশ্য ইঙ্গিত দিচ্ছেন তিনি। জিসিসি নেতাদের কাছে, নেতানিয়াহুর এমন ভাষা ও কর্মকাণ্ড কেবল উসকানিমূলক নয়; বরং অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে। তাঁরা মনে করছেন, নেতানিয়াহু মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র একতরফাভাবে বদলে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন এবং ইরানি প্রাধান্যের পরিবর্তে ইসরায়েলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন।

উপসাগরীয় দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এই দেশগুলোর জ্বালানি এবং বিপুল রাষ্ট্রীয় তহবিল যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখে। এই দেশগুলো মার্কিন ট্রেজারি বিলে শত শত বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে যা বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারকে শক্তিশালী করে। ট্রাম্প এটি স্পষ্টভাবে বোঝেন। এ কারণেই তিনি দ্বিতীয় দফা দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর প্রথম বিদেশ সফর সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারে করেছেন।

সে কারণেই সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান না করে এটিকে বরং সতর্কবার্তা হিসেবে নিতে হবে ট্রাম্পকে। উপসাগরীয় দেশগুলো গালফ রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের সীমা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রকে পরিত্যাগ করছে না।

এই নভেম্বর সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ওয়াশিংটন সফরে আসছেন। তাঁর এই সফর আবর ও উপসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার সুযোগ রয়েছে। এখনকার বাস্তবতা হচ্ছে, মার্কিন সিনেটে জোরালো প্রতিরক্ষা চুক্তি করা রাজনৈতিকভাবে সম্ভব নয়।

সে কারণে ট্রাম্প ২০২৩ সালে স্বাক্ষরিত যুক্তরাষ্ট্র–বাহরাইন স্বাক্ষরিত কমপ্রিহেনসিভ সিকিউরিটি ইন্টিগ্রেশন অ্যান্ড প্রস্পেরিটি অ্যাগ্রিমেন্টের (ন্যাটোর অনুচ্ছেদ–৫ এর পর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অঙ্গীকার) মডেলে বিদ্যমান প্রতিরক্ষা প্রতিশ্রুতিগুলো সম্প্রসারণ করতে পারেন। এই প্রতিশ্রুতিগুলোকে অবশ্যই উপসাগরীয় অংশীদারদের প্রতিরক্ষা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করতে হবে, এমনকি হুমকির উৎস যদি ইসরায়েল হয় তবুও।

যদি ট্রাম্প প্রশাসন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে সৌদি–পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি কেবল একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি থেকেও বেশি কিছু হয়ে উঠতে পারে। আঞ্চলিক বড় শক্তি মিসর ও তুরস্কও মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র পাল্টে দেওয়ার ইসরায়েলি প্রচেষ্টা নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ফলে পাকিস্তান–সৌদি প্রতিরক্ষা চুক্তি অন্যান্য ইসলামী দেশগুলোর প্রতিরক্ষা চুক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে। সেটি ট্রাম্পের বৈদেশিক নীতির প্রধান অর্জন, অ্যাব্রাহাম অ্যাকর্ডসকে দুর্বল করবে।

ওয়াশিংটনের সামনে বেছে নেওয়ার বিকল্প এখন স্পষ্ট। হয় তাদের আরব ও উপসাগরীয় অংশীদারদের আশ্বস্ত করতে হবে এবং ইসরায়েলকে তার বৈধ সীমার মধ্যে রাখতে হবে; অথবা মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকান নিরাপত্তাকাঠামো ধ্বংস হতে দেখতে হবে।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor