শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ করে যে হুমকির মুখে পড়ল ইসরায়েল

প্রকাশিত: ০২:৩০, ০৫ জুলাই ২০২৫ | ১০

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের সাম্প্রতিক হামলাগুলো কেবল সামরিক পরিসরেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং রূপ নিয়েছিল কৌশলগত আক্রমণে।
এর লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলি রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভিত্তি অর্থনৈতিক ও আর্থিক অবকাঠামোগুলোকে দুর্বল করে দেওয়া। প্রতিশোধমূলক আক্রমণ দিয়ে শুরু হলেও এটি বহুমাত্রিক আক্রমণ অভিযানে পরিণত হয়েছিল। শুধু তাৎক্ষণিক ক্ষতি করাই এর লক্ষ্য ছিল না, বরং ইসরায়েলের যুদ্ধ-অর্থনীতির আর্থিক ও লজিস্টিক কাঠামোকে অস্থিতিশীল করে দিয়েছিল।

ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন ফর ইসরায়েলের (ইসরায়েলি বন্ডস নামে পরিচিত) প্রধান নির্বাহী দানি নাভেহের বাড়ি লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলাটি সে কারণে মোটেই কাকতালীয় ঘটনা ছিল না। নাভেহ শুধু ইসরায়েলের আমলাতন্ত্রের একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব নন, দেশটির বৈশ্বিক বন্ড বিক্রি ব্যবস্থার একজন স্থপতিও।

২০২৩ সালের অক্টোবরের পর থেকে তাঁর নেতৃত্বে প্রবাসী ইহুদি এবং বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে ৫ বিলিয়নের বেশি ডলারের মূলধন ইসরায়েলে এসেছে। এর মধ্যে ১.৭ বিলিয়ন ডলার এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সরকারি সংস্থা থেকে। এই বন্ডগুলো যুদ্ধরত ইসরায়েলের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নাভেহর বাড়িতে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে তেহরান মূলত ইসরায়েলের ঋণ সংগ্রহব্যবস্থার সবচেয়ে নাজুক জায়গাটিতে আঘাত করেছে। সেটি হলো বিনিয়োগকারীদের আস্থা।

এই আক্রমণের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাজারের প্রতি ইরান একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে। সেটি হলো ইসরায়েলের কোনো অর্থনৈতিক বা আর্থিক কেন্দ্রই নিরাপদ নয়। এটি শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ের আক্রমণ নয়। ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন আর্থিক কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রচেষ্টাও। একই সঙ্গে তেহরানের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল তেল আবিবের অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হাইফার কৌশলগত বন্দর ও তেল পরিশোধনাগার। ইসরায়েলের আর্থিক অবকাঠামো ক্ষতি করার এটা ইরানের পরিকল্পিত নীতি। জ্বালানি পরিশোধনাগারে সাইবার ও ক্ষেপণাস্ত্র—দুই ধরনের আক্রমণ করেই শিল্প ও বেসামরিক কাজে ব্যবহৃত জ্বালানি সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করে ইরান।

গাজা যুদ্ধের ব্যয়ের কারণে ইসরায়েল এরই মধ্যে চাপে আছে। এখন জ্বালানির উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ইসরায়েলকে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ইসরায়েলের অর্থনীতির ওপর সবচেয়ে বড় আঘাতটি এসেছিল বৈশ্বিক সমুদ্র পরিবহন খাত থেকে। গত ২০ জুন বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম কনটেইনার শিপিং কোম্পানি মের্কস ইসরায়েলের হাইফা বন্দরে সব ধরনের জাহাজ ভেড়া স্থগিত করে দিয়েছিল।

হাইফা হলো ইসরায়েলের ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের প্রধান বন্দর। এটি শিল্প যন্ত্রপাতি, ওষুধ ও কৌশলগত জিনিসপত্র আমদানির কেন্দ্র। এই বন্দর বন্ধ হলে ইসরায়েলি অর্থনীতি নাজুক হয়ে পড়ে এবং মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বেড়ে যায়। এরই মধ্যে দেশটিতে আমদানি খরচ বেড়ে যায় এবং পণ্য মজুতের ঘাটতি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়।

ইরানের সম্ভাব্য প্রতিশোধের ঝুঁকির মুখে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কোম্পানিটি। বাস্তবে বাইরের বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ক্ষেত্রে ইসরায়েলের বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছিল। কোনো আনুষ্ঠানিক নৌ অবরোধ ঘোষিত না হলেও, এর প্রভাব ছিল কার্যত অবরোধের সমান। ইরানের আক্রমণের কারণে ইসরায়েলের বাণিজ্যে যে বিঘ্ন তৈরি হয়েছিল, সেটা লোহিত সাগরে হুতিদের অবরোধের কারণে সৃষ্ট সংকটের চেয়ে বহুগুণ বেশি। বাব আল-মান্দাব শুধু কার্গোর রুট বদলে দিয়েছিল। মের্কসের হাইফা ত্যাগ নৌ–বাণিজ্যের সব পথই বন্ধ করে দিয়েছিল।

হাইফা হলো ইসরায়েলের ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের প্রধান বন্দর। এটি শিল্প যন্ত্রপাতি, ওষুধ ও কৌশলগত জিনিসপত্র আমদানির কেন্দ্র। এই বন্দর বন্ধ হলে ইসরায়েলি অর্থনীতি নাজুক হয়ে পড়ে এবং মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বেড়ে যায়। এরই মধ্যে দেশটিতে আমদানি খরচ বেড়ে যায় এবং পণ্য মজুতের ঘাটতি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হওয়ার পর মের্কস আবারও হাইফা বন্দর দিয়ে কনটেইনারবাহী জাহাজ চলাচলে রাজি হয়। তথাপি সংঘাতের সময় ইসরায়েলের ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা অনেক বড়।

এর বিপরীতে, ইরান ন্যূনতম খরচ করে সর্বোচ্চ ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। ইরান ক্ষেপণাস্ত্র খাতে আনুমানিক ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। এটি মূলত কৌশলগত বিনিয়োগ। এর বাইরে মুদ্রাবাজারে কঠোর সরকারি নিয়ন্ত্রণ, অপ্রচলিত বাজারে তেল বিক্রির কূটনীতি এবং বিভিন্ন খাতে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ইরান অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে চলেছে। ইরান বহু বছর ধরেই নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের মধ্যে বাস করছে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে দশকের পর দশক টিকে থাকার সক্ষমতা দেশটি গড়ে তুলেছে।

দীর্ঘদিন ধরে ব্যাঘাত ঘটতে থাকলে ইসরায়েলের অর্থনীতি ও রাজনীতি ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু ইরান এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, যেটা সংঘাতের মধ্যেও টিকে থাকবে। ইরানের কৌশলগত ধৈর্য কয়েক দশকের চাপের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। এটা ইরানকে গভীর জাতীয় সংকল্প দিয়েছে। আর এটিই ইসরায়েলি রাষ্ট্রের যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার আর্থিক সামর্থ্য ও যুক্তিকে পরাভূত করার হুমকি তৈরি করছে। ইসরায়েলের অর্থনৈতিক সংকট শুধু ব্যয়ের কারণে নয়, বরং আস্থার সংকটে তৈরি হয়েছে।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি মুদ্রার মান ধারাবাহিকভাবে অবমূল্যায়িত হয়েছে। বন্ডের সুদের হার বেড়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে। ছোট ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ঋণের মানেও অবনমন ঘটেছে।

শহরগুলোতে কাজের ঘণ্টা কমে যাওয়ায় সেই ধাক্কা উৎপাদনে এবং রাজস্ব আহরণে এসে লেগেছে। বেকারত্ব বেড়েছে। বেড়েছে জন–অসন্তোষ। অন্যদিকে সরকার মূল্য সংযোজন কর বাড়িয়েছে, সামাজিক ব্যয় কাটছাঁট করেছে। দেশীয় উৎস থেকে ঋণ নেওয়া বাড়িয়েছে। সরকারের এসব পদক্ষেপ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কর্মসূচি নয়, এটি অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় জরুরি ব্যবস্থা।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জনকল্যাণ ব্যয় কমিয়ে সামরিক খাতে ব্যয়ের জোগান দেওয়া হচ্ছে। মানব পুঁজির ক্ষয় হচ্ছে। পুঁজি ও মানবসম্পদের দেশান্তর দ্রুততর হচ্ছে। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার প্রতি আস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে।  অর্ধশতকের বেশি বছরের মধ্যে এই প্রথম ইসরায়েল অস্ত্রের জন্য নয়, বরং নগদ অর্থের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে আবেদন জানিয়েছে। এটি দেশটির অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার প্রতিচ্ছবি।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor