শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

ট্রাম্পের বহুল আলোচিত বিগ বিউটিফুল বিলে কী আছে

প্রকাশিত: ০৫:২১, ০৪ জুলাই ২০২৫ |

যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ গতকাল বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত নতুন কর ও ব্যয় বিল (ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল নামে পরিচিত) পাস করেছে। এর আগে গত মঙ্গলবার বিলটি উচ্চকক্ষ সিনেটেও মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে পাস হয়। বিলটির পক্ষে–বিপক্ষে সমানসংখ্যক ভোট পড়ায় রিপাবলিকান সিনেটর ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স টাইব্রেকিং ভোট দেন।

প্রসঙ্গত, প্রতিনিধি পরিষদে ২১৮-২১৪ ভোটের ব্যবধানে বিলটি পাস হয়েছে। পরে এতে সই করেন স্পিকার মাইক জনসন। আলোচিত বিলটি কংগ্রেসে পাস হওয়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য বড় জয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বিলটি নিয়ে ট্রাম্পের নিজ দলেও প্রবল বিরোধিতা ছিল। শেষ পর্যন্ত বিলটি পাস হওয়ায় রিপাবলিকান পার্টির জ্যেষ্ঠ সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এখন তিনি সই করলেই বিলটি আইনে পরিণত হবে।

বহুল আলোচিত এই বিলে কী আছে? ট্রাম্পের স্বাক্ষরের অপেক্ষায় থাকা বিলটির চূড়ান্ত খসড়া থেকে জেনে নেওয়া যাক মূল বিষয়গুলো:

স্থায়ী হচ্ছে বড় করছাড়

প্রথম মেয়াদে ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ট্রাম্প ‘ট্যাক্স কাটস অ্যান্ড জবস অ্যাক্ট’ নামের একটি আইন পাস করেন। এটি কর হ্রাস করে ও করদাতাদের জন্য আয়কর থেকে ছাড় (স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন) বাড়ায়। যদিও এর সুবিধা উচ্চ আয়ের মানুষরাই বেশি পান। সুবিধা চলতি বছর, অর্থাৎ ২০২৫ সালের পর বাতিল হওয়ার কথা ছিল। তবে নতুন বিল এটি স্থায়ী করছে।

এ ছাড়া ২০২৮ সাল পর্যন্ত স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন আরও বাড়ানো হচ্ছে। এ ছাড় ব্যক্তি করদাতাদের জন্য ১ হাজার ডলার, পরিবারপ্রধান (হেড অব হাউসহোল্ড) হলে ১ হাজার ৫০০ ডলার ও দম্পতিদের জন্য ২ হাজার ডলার।

ওভারটাইম ও টিপসের ওপর করছাড়

এই বিলের আওতায় নতুন কিছু ক্ষেত্রে করছাড় যুক্ত হচ্ছে। তবে সেগুলো শুধু ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকা পর্যন্তই বহাল থাকবে। তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, এবার টিপস ও ওভারটাইম আয়ের ওপর করছাড় দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি গাড়ি কেনার জন্য নেওয়া ঋণের সুদও কর থেকে ছাড় পাবে।

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অবৈধ অভিবাসীদের তাড়াতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেওয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ‘ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট’ সংস্থাকে ৪৫ বিলিয়ন (৪ হাজার ৫০০ কোটি) ডলার দেওয়া হচ্ছে বন্দিশিবির পরিচালনার জন্য।
৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য অতিরিক্ত ছয় হাজার ডলার করছাড় রাখা হয়েছে। তবে এমন বয়সীদের একক আয় ৭৫ হাজার ডলারের বেশি বা যৌথভাবে দেড় লাখ ডলারের বেশি হলে এ ছাড় প্রযোজ্য হবে না। এসব ছাড় ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট মেয়াদের শেষ বছর, অর্থাৎ ২০২৮ সালের শেষে উঠে যাবে।

অভিবাসী বহিষ্কারে বিপুল বরাদ্দ, সীমান্তে নতুন দেয়াল

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অবৈধ অভিবাসীদের তাড়াতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেওয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ‘ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট’ (আইস) সংস্থাকে ৪৫ বিলিয়ন (৪ হাজার ৫০০ কোটি) ডলার দেওয়া হচ্ছে বন্দিশিবির পরিচালনার জন্য। এসব অভিবাসীদের বহিষ্কার কার্যক্রম পরিচালনায় আরও ১৪ বিলিয়ন (১ হাজার ৪০০ কোটি) ডলার ও ২০২৯ সালের মধ্যে নতুন ১০ হাজার এজেন্ট নিয়োগে কয়েক বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

এ ছাড়া মেক্সিকো সীমান্ত বরাবর নতুন প্রতিরক্ষাকাঠামো তৈরিতে ৫০ বিলিয়ন (৫ হাজার কোটি) ডলার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে দেয়াল নির্মাণও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

কমছে মেডিকেইড ও খাদ্যসহায়তা

নতুন বিলের ব্যয় কমাতে রিপাবলিকানরা যুক্তরাষ্ট্রের দুটি প্রধান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বাজেটে ছাঁটাই করেছেন। এ দুটি কর্মসূচি হলো ‘মেডিকেইড’ (দরিদ্র ও প্রতিবন্ধিতার শিকার ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা) ও ‘সাপ্লিমেন্টাল নিউট্রিশন অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রাম’ বা স্ন্যাপ (খাদ্যসহায়তা কর্মসূচি)।

দুটি ক্ষেত্রেই বাজেট কমানোর পাশাপাশি নতুন কাজের শর্তও জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার অন বাজেট অ্যান্ড পলিসি প্রায়োরিটিজ’–এর হিসাবে, এসব পরিবর্তনের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা হারাতে পারেন এবং প্রতি পাঁচ স্ন্যাপ গ্রহীতার একজন, অর্থাৎ ৮০ লাখ মানুষ খাদ্যসহায়তা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।

বাতিল হচ্ছে সবুজ জ্বালানির কর–সুবিধা

জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট থাকার সময় পরিবেশবান্ধব যানবাহন ও প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহ দিতে যে কর–সুবিধা চালু হয়েছিল, ট্রাম্পের নতুন বিলে তার অনেকটাই তুলে নেওয়া হচ্ছে। বৈদ্যুতিক গাড়ির করছাড় এ বছরই শেষ হবে। বাড়িঘরের উন্নয়নে পরিবেশবান্ধব বা বিদ্যুৎ-সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি কিনতে যে ভর্তুকি পাওয়া যেত, তা–ও বাদ দেওয়া হচ্ছে।

বিলে শুরুতে উইন্ড ও সোলার প্রজেক্টের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপের প্রস্তাব ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সিনেট সদস্যরা তা বাতিল করেছেন।

‘মেডিকেইড’ ও ‘স্ন্যাপ’ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ কমায় যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা হারাতে পারেন এবং প্রতি পাঁচ স্ন্যাপ গ্রহীতার একজন, অর্থাৎ ৮০ লাখ মানুষ খাদ্যসহায়তা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।
অঙ্গরাজ্য ও স্থানীয় করছাড় (সাল্ট)

স্টেট অ্যান্ড লোকাল ট্যাক্স বা ‘সাল্ট’–এ করছাড় কতটা দেওয়া হবে, তা বিলের অন্যতম বিতর্কিত বিষয়। অনেক মার্কিনকে ফেডারেল ট্যাক্সের পাশাপাশি নিজ নিজ অঙ্গরাজ্য ও স্থানীয় ট্যাক্সও দিতে হয়। ডেমোক্র্যাট-শাসিত অঙ্গরাজ্যগুলোর কয়েকজন রিপাবলিকান প্রতিনিধি সাল্টে করছাড়ের সীমা ১০ হাজার ডলার থেকে বাড়িয়ে ৪০ হাজার ডলার না করা পর্যন্ত বিলে নিজেদের সমর্থন দেননি। প্রতিনিধি পরিষদে এ দাবি মানা হলেও সিনেটের রিপাবলিকানরা জানিয়েছেন, এটি সাময়িক ব্যবস্থা।

সিনেটের পদক্ষেপ অনুযায়ী, ২০২৮ সাল পর্যন্ত সাল্টে ছাড়ের সর্বোচ্চ সীমা ৪০ হাজার ডলার থাকবে।

ঋণসীমা বাড়ছে ৫ ট্রিলিয়ন ডলার

যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঋণের সীমা বা ‘ডেট লিমিট’ পাঁচ ট্রিলিয়ন (পাঁচ লাখ কোটি) ডলার বাড়ানো হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট জানিয়েছেন, সরকার আগস্টের মধ্যেই বর্তমান ঋণসীমা ছাড়িয়ে যাবে এবং সময়মতো পদক্ষেপ না নিলে যুক্তরাষ্ট্র ঋণ খেলাপিতে পড়বে, যা বড় ধরনের আর্থিক সংকট ডেকে আনতে পারে।

ধনীদের লাভ, গরিবের ক্ষতি

ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ল্যাবের তথ্য অনুযায়ী, বিলটি ধনিক শ্রেণিকে তুলনামূলক বেশি সুবিধা দিচ্ছে। নিম্ন আয়ের শ্রেণির করদাতাদের গড় আয় ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমবে। এটি হবে মূলত স্ন্যাপ ও মেডিকেইড কর্মসূচিতে সুবিধা কমার কারণে। অন্যদিকে উচ্চ আয়ের মানুষের আয় ২ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়বে।

তবে শেষ মুহূর্তে সিনেটে যেসব সংশোধনী আনা হবে, তার ওপর ভিত্তি করে এসব প্রভাব কিছুটা বদলাতেও পারে।

বিশাল ব্যয়ের বোঝা

সরকারি খরচে লাগাম টেনে ধরার উপায় হিসেবে এ বিলকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন রিপাবলিকানরা। প্রকৃতপক্ষে বিলটি আইনে পরিণত হলে ২০৩৪ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজেট–ঘাটতি ৩ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন (৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি) ডলার বাড়বে বলে হিসাব দিয়েছে কংগ্রেশনাল বাজেট অফিস। ঘাটতির বেশির ভাগ অংশ হবে ২০১৭ সালের করছাড়কে স্থায়ী করার খরচ।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor