শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

ইলন মাস্ক কি আসলেই নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারবেন

প্রকাশিত: ০২:২০, ০৩ জুলাই ২০২৫ | ১১

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’ কংগ্রেসে পাস হলে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করবেন বলে গত সোমবার হুমকি দিয়েছেন ইলন মাস্ক। এই ধনকুবেরের মতে, বিলটি পাস হলে ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে রিপাবলিকানদের আর কোনো পার্থক্য থাকবে না। ডেমোক্র্যাটরা করদাতাদের টাকা অপচয় করেছেন বলে রিপাবলিকানরা অভিযোগ করে থাকেন।

ট্রাম্পের প্রস্তাবিত বিলটি গতকাল মঙ্গলবার মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে পাস হয়েছে। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য এটিকে নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে পাঠানো হয়েছে। বিলটিতে করছাড়ের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা ও দরিদ্রদের জন্য খাদ্যসহায়তা কমানোর কথা বলা হয়েছে।

মাস্ক গত মাসে একাধিকবার এই বিলের সমালোচনা করেছেন এবং জুনের শুরু থেকে নতুন দল গঠনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। গত সোমবার মাস্ক তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া পোস্টে লিখেছেন, ‘এই পাগলাটে বিল পাস হলে পরদিনই “আমেরিকা পার্টি” গঠন করা হবে।’

এই ধনকুবের আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান মিলিয়ে একটাই দল চলছে। মানুষের আসল কণ্ঠস্বর শোনার জন্য এখন একটা বিকল্প দরকার।’

একসময়ের ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ ইলন মাস্ক এখন এই বিলের অন্যতম কড়া সমালোচক। ৩ জুন এক্সে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, ‘আমি দুঃখিত, কিন্তু আর সহ্য হচ্ছে না। এই বিশাল, অপ্রয়োজনীয়, অপচয়ে ভরা কংগ্রেসীয় ব্যয় বিলটি একেবারে জঘন্য।’
এর আগের এক পোস্টে মাস্ক লিখেছেন, ‘এই পাগলাটে খরচের বিল উত্থাপনের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে আমরা এখন একদলীয় দেশে বাস করছি, যার নাম “পর্কি পিগ পার্টি”! এই বিলের মাধ্যমে ঋণের সীমা রেকর্ড ৫ লাখ কোটি ডলার বাড়ানো হচ্ছে।’

যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ঋণের সীমা নির্ধারণ করে দেয়। এই ঋণসীমার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয় সর্বোচ্চ কী পরিমাণ অর্থ ঋণ নিতে পারবে। বর্তমানে এই ঋণসীমা ৩৬ লাখ ১০ হাজার কোটি ডলার।

মাস্ক কেন বিরোধিতা করছেন
একসময়ের ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ ইলন মাস্ক এখন এই বিলের অন্যতম কড়া সমালোচক। ৩ জুন এক্সে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, ‘আমি দুঃখিত, কিন্তু আর সহ্য হচ্ছে না। এই বিশাল, অপ্রয়োজনীয়, অপচয়ে ভরা কংগ্রেসীয় ব্যয় বিলটি একেবারে জঘন্য।’

একপর্যায়ে মাস্ক অভিযোগ করেন, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের কুখ্যাত নারী নিপীড়নকারী জেফরি এপস্টাইনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যদিও সেই পোস্টটি তিনি পরে মুছে ফেলেন।

তবে পরে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, মাস্কের জন্য তাঁর শুভকামনা আছে। ট্রাম্পের এ কথার পর মনে হচ্ছিল, মাস্কের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ঠিকঠাক হয়ে গেছে। এরপর ১১ জুন মাস্ক এক পোস্টে লেখেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন।

‘নিশ্চিতভাবেই একটি তৃতীয় রাজনৈতিক দল চালানোর মতো আর্থিক সক্ষমতা মাস্কের আছে, যা রিপাবলিকানদের জন্য বড় ধাক্কা হতে পারে। তবে তিনি আদৌ এই ঝুঁকি নেবেন কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়।’ (নাটাশা লিন্ডস্ট্যাড, ইউনিভার্সিটি অব এসেক্সের রাজনৈতিক বিশ্লেষক)
এরপরও মাস্ক অনলাইনে একের পর এক পোস্ট দিয়ে বিলটির সমালোচনা করেই যাচ্ছেন। তিনি বলেছেন, এই বিল পাস হলে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের সীমা বেড়ে যাবে, দেশ দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে এবং লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারাতে পারে।

মাস্ক বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলা ও মহাকাশ সংস্থা স্পেসএক্সের মালিক। ট্রাম্প প্রস্তাবিত বিলে সিনেট কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। সেখানে ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনার ওপর ৭ হাজার ৫০০ ডলারের করছাড় বন্ধের প্রস্তাব রয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রে বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা কমে যেতে পারে।

মাস্কের প্রস্তাবিত ‘আমেরিকা পার্টি’ কী
গত ৫ জুন ইলন মাস্ক তাঁর এক্স অ্যাকাউন্টে একটি অনলাইন জরিপ চালান। সেখানে তিনি অনুসারীদের প্রশ্ন করেন, ‘এখন কি যুক্তরাষ্ট্রে এমন একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের সময় এসেছে, যা মাঝামাঝি অবস্থানে থাকা ৮০ শতাংশ মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করবে?’

ওই জরিপে ৫৬ লাখ মানুষ অংশ নেন। এর মধ্যে ৮০ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ ‘হ্যাঁ’ উত্তর দিয়েছেন। এর পর থেকে মাস্ক বারবার এই ফল শেয়ার করে বলছেন, এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয় যে বেশির ভাগ মার্কিন নাগরিক নতুন একটি রাজনৈতিক দল চান।

ইউনিভার্সিটি অব এসেক্সের সরকার বিভাগের অধ্যাপক নাতাশা লিন্ডস্ট্যাড আল–জাজিরাকে বলেন, ‘মাস্ক বিশ্বাস করেন, যুক্তরাষ্ট্রের ৮০ শতাংশ মানুষ ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান—এই দুই প্রধান দল নিয়ে সন্তুষ্ট নন এবং তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করা হচ্ছে না।’

মাস্কের অনলাইন জরিপের ফলাফল পুরো যুক্তরাষ্ট্রের জনমতকে তুলে না ধরলেও এর মধ্য দিয়ে ভোটারদের প্রবণতা বোঝা যায়। ২০২৪ সালের গ্যালাপ জরিপ অনুযায়ী, ৪৩ শতাংশ মার্কিন নাগরিক নিরপেক্ষ ভোটার, ২৮ শতাংশ রিপাবলিকান এবং ২৮ শতাংশ ডেমোক্র্যাট ভোটার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন। অর্থাৎ ডেমোক্রেটিক বা রিপাবলিকান পার্টির সমর্থক ভোটারের চেয়ে নিরপেক্ষ ভোটারের সংখ্যা বেশি।

এক্সে মাস্কের দেওয়া পোস্টের নিচে উত্তর দেওয়ার ঘরে তাঁর এক অনুসারী একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন। সেখানে লেখা ছিল ‘আমেরিকা পার্টি’। জবাবে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি মাস্ক লেখেন, ‘আমেরিকা পার্টি’ নামটা দারুণ শোনায়। এটাই হবে সেই দল, যারা আসলেই আমেরিকাকে প্রতিনিধিত্ব করবে।

মাস্কের ‘আমেরিকা পার্টি’ কতটা বাস্তব
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইলন মাস্ক চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে একটি তৃতীয় রাজনৈতিক দলের অর্থ জোগান দেওয়ার মতো সামর্থ্য রাখেন। ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার সূচক অনুযায়ী, গত সোমবার পর্যন্ত মাস্কের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩৬ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। তবে তিনি আদৌ এই উদ্যোগ নিয়ে এগোবেন কি না কিংবা তাঁর দল নির্বাচনে বড় কোনো প্রভাব ফেলবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়।

যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব এসেক্সের রাজনৈতিক বিশ্লেষক নাতাশা লিন্ডস্ট্যাড বলেন, ‘নিশ্চিতভাবেই একটি তৃতীয় রাজনৈতিক দল চালানোর মতো আর্থিক সক্ষমতা মাস্কের আছে, যা রিপাবলিকানদের জন্য বড় ধাক্কা হতে পারে। তবে তিনি আদৌ এই ঝুঁকি নেবেন কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়।’

লিন্ডস্ট্যাড মনে করিয়ে দেন, মাস্ক একপর্যায়ে ট্রাম্পের প্রতি তাঁর কড়া সমালোচনা থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘যদি মাস্ক নিজের কথামতো এগোন, তাহলে তিনি এই প্রকল্পে লাখ লাখ ডলার খরচ করতে পারেন।’

লিন্ডস্ট্যাড বলেন, ‘মাস্ক সম্প্রতি বিলটির বিরুদ্ধে তাঁর সমালোচনা আরও জোরদার করেছেন। প্রতিনিধি পরিষদের কিছু আইনপ্রণেতা, যাঁদের এলাকার মানুষ ট্রাম্পের নীতিতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তাঁরা মাস্কের পক্ষ নিতে পারেন। বিশেষ করে বাজেট খরচ নিয়ে উদ্বিগ্ন যেসব আইনপ্রণেতা আছেন; তাঁদের দৃষ্টি মাস্কের দিকেই থাকবে।’

লিন্ডস্ট্যাডের মতে, মার্কিন ভোটারদের মধ্যে তৃতীয় দলের প্রতি বড় আগ্রহ রয়েছে। লিন্ডস্ট্যাড বলেন, ‘এই বিলের কারণে যুক্তরাষ্ট্র কেবল সুদ পরিশোধেই শত শত কোটি ডলার খরচ করবে। যত বেশিসংখ্যক মানুষ এটা বুঝবে, তত বেশি তারা অন্য কোনো বিকল্পের দিকে ঝুঁকবে। ঐতিহ্যবাহী দুই দলের প্রতি জনগণের হতাশা এখন সর্বোচ্চ স্তরে, আর মাস্ক হয়তো এখান থেকে লাভবান হতে পারবেন।’

তবে লন্ডনের ইউসিএল স্কুল অব পাবলিক পলিসির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক টমাস গিফট বলেন, মাস্ক সত্যিই নতুন দল গড়তে চান কি না, তা স্পষ্ট নয়। গিফটের মতে, এটা ইলন মাস্কের ধোঁকাবাজি হতে পারে। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান—এই দুই দলের নেপথ্যে থাকা রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে টেক্কা দেওয়া যে খুব কঠিন হবে, তা মাস্ক ভালোই জানেন।

গিফট আরও বলেন, ‘দল গঠন করা সম্ভব হলেও কংগ্রেস বা হোয়াইট হাউসে আসন জেতা একেবারে আলাদা বিষয়।

নিউইয়র্কের ফোর্ডহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক পল লেভিনসন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, তৃতীয় দলগুলো খুব একটা সফল হয়নি।’ লেভিনসন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয় দলগুলোর অতীত ইতিহাস খুবই দুর্বল—এমনকি সাবেক প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টও ১৯১২ সালে “বুল মুজ পার্টি” বা “প্রগ্রেসিভ পার্টি” গড়লেও সেটি সফল হয়নি।’

১৯১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রুজভেল্ট রিপাবলিকান দলের মনোনয়ন না পেয়ে প্রগ্রেসিভ পার্টি গঠন করেছিলেন। নির্বাচনে তিনি ৮৮টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়েছিলেন। আর সব মিলে তাঁর ভোটসংখ্যা ছিল প্রায় ৪০ লাখ। তবে তিনি জয়ী হতে পারেননি। ওই নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী উড্রো উইলসন ৪৩৫ ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০২০ সালে প্রগ্রেসিভ পার্টি বিলুপ্ত হয়ে যায়।

তাই পল লেভিনসন মনে করেন, ইলন মাস্কের প্রস্তাবিত আমেরিকা পার্টি সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor