শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

বিদায় ইসমাইল কাদারে

প্রকাশিত: ০৪:০১, ১২ জুলাই ২০২৪ | ১২১

আলবেনিয়ার নাট্যকার, কবি, প্রাবন্ধিক এবং কথাসাহিত্যিক ইসমাইল কাদারে। বিশ্বসাহিত্যের মহান লেখকদের অন্যতম মনে করা হয় তাঁকে। জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তবে সর্বোচ্চ মনে করা হয় এমন পুরস্কারটা বাকি রয়ে গেল।

দীর্ঘ সময় ধরে নোবেল পুরস্কারের মৌসুমে তাঁর নাম পাঠক-সমালোচকদের মুখে উচ্চারিত হয়ে আসছিল। কিন্তু চিনুয়া আচেবে, মিলান কুন্ডেরার মতো গত ১ জুলাই তিনিও অনন্তলোকে চলে গেলেন নোবেল পুরস্কারের সীমা ছাড়িয়ে। তবে পাঠকের হৃদয়ে চির অম্লান রয়ে যাবেন কাদারে।  
১৯৯০ সালের অক্টোবর মাসে কাদারে ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং পেয়েও যান।

কারণ এরই মধ্যে তিনি আলবেনিয়ার সরকারের সমালোচনা করেছেন, ইউরোপের সর্বশেষ সমাজতান্ত্রিক দেশ আলবেনিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি তুলেছেন, শাসকচক্রের রোষানলে পড়েছেন এবং গোপন পুলিশের হুমকিও পেয়েছেন। তবে এত সব বিপদের মধ্যেও দেশবাসীর কাছে ছিলেন প্রিয় মানুষ, প্রিয়তম লেখক।  আলবেনিয়ায় এমন কোনো বাড়ি নেই যেখানে কাদারের কোনো বই নেই। বিদেশি অতিথি এলে উপহার হিসেবে দেওয়া হয় কাদারের বই।

১৯৭০ সালে তাঁর ‘দ্য জেনারেল অব দ্য ডেড আর্মি’ উপন্যাসের ফরাসি অনুবাদ প্রকাশ করার পর কাদারের আন্তর্জাতিক খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এ উপন্যাসের কাহিনিতে ইতালির এক জেনারেলের আলবেনিয়া আগমনের কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিশ বছর পর সে সেনাবাহিনীর এক পাদ্রিকে নিয়ে আলবেনিয়া আসে সেখানে শহীদ হওয়া সৈনিকদের মরদেহ খুঁজে বের করে ইতালিতে নিয়ে পুনরায় সৎকার করার উদ্দেশ্যে। ফ্রান্সে প্রকাশের পর খুব দ্রুতই ইউরোপের অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়ে যায় কাদারের এ উপন্যাস। ১৯৭৭ সাল নাগাদ বিশটির বেশি ভাষায় অনূদিত হয়।

আলবেনিয়ার তৎকালীন কমিউনিস্ট সংবাদমাধ্যমও এ উপন্যাসটিকে সত্তরের দশকের সফল অনুবাদের অন্যতম বলে স্বীকার করে নেয়।
কাদারে ১৯৭১ সালে প্রকাশ করেন ‘ক্রনিকল ইন স্টোন’ উপন্যাস। এ উপন্যাসেও যুদ্ধকালীন সংকটের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। একজন অল্পবয়সী যুবকের বয়ানে বর্ণনা করা হয় তার দেশ কিভাবে পর্যায়ক্রমে গ্রিস, ইতালি এবং জার্মানির দ্বারা আক্রান্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কথাসাহিত্যিক জন আপডাইক এ উপন্যাসের জাদুবাস্তব উপাদানের প্রশংসা করেন। এ উপন্যাসটি পাঠককে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি মোহাবিষ্ট করে রাখে বলে মন্তব্য করেন আপডাইক। ইউরোপের অন্যতম প্রাচীন সমাজ থেকে নির্যাস তুলে আনলেও কাদারের কাব্যিক গদ্য ও বয়ানের দক্ষতা এ উপন্যাসকে শুদ্ধ ও উচ্চমার্গীয় অবস্থায় তুলেছে বলে মনে করেন তিনি। 

ইসমাইল কাদারে ১৯৭৫ সালে প্রকাশ করেন ‘দ্য ডে পাশা’ নামের একটা রাজনৈতিক ব্যঙ্গ কবিতা। তাঁর এ কবিতার কারণে কাদারের ওপর খেপে যায় কমিউনিস্ট কর্তৃপক্ষ। অল্পের জন্য মৃত্যুদণ্ড থেকে বেঁচে যান কাদারে। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁকে মধ্য আলবেনিয়ার প্রত্যন্ত পল্লী অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কায়িক শ্রমের শাস্তি দিয়ে। সংক্ষিপ্ত সময়ের ওই শাস্তি ভোগ করে ফিরে আসার পর ছোট আকারের উপন্যাসিকা প্রকাশ করা শুরু করেন তিনি।

লেখক হিসেবে কাদারের বিশেষ কৌশলের মধ্যে অন্যতম হলো হাতের কাছে পাওয়ার মতো অনেক উপাদানের মধ্য থেকে অল্প কিছু বাছাই করার ক্ষমতা। অনেক উপাদান ফেলে রাখা বা ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টিকে তিনি নেগেটিভ ক্রিয়েশন বা নেতিবাচক সৃজন মনে করেন। ভালো লেখকের ক্ষমতার মধ্যে এটা নিশ্চয়ই একটা বড় বিষয়। তিনি মনে করতেন, লেখক যতটা লেখেন তার চেয়ে বেশিসংখ্যক উপাদান ফেলে দেন, এটাই স্বাভাবিক। এ উপাদানগুলোকে কাদারে মৃত উপাদানও বলেছেন। লেখককে এগুলো থেকে মুক্ত থাকতে হয় বলেই তাঁর মতামত। বৈরী পরিবেশে লেখা চালিয়ে যাওয়া বিপজ্জনক হওয়ার কারণে লেখার মধ্যে রূপক, প্রতীকসহ আরো সব কৌশল ব্যবহার করতে হয়েছে কাদারেকে। তাতে তাঁর লেখার মান উন্নত হয়েছে এবং শাসকশ্রেণির বোধগম্যতার স্তরের অনেক উঁচুতে স্থাপন করা গেছে তাঁর লেখা। এ ক্ষমতাপ্রাপ্তির পেছনে অনেকটা বড় ভূমিকা পালন করেছে কাদারের ছেলেবেলার অভিজ্ঞতা। প্রথমত যুদ্ধ এবং দ্বিতীয়ত স্বৈর শাসকের শাসন—এগুলোর মধ্যে বড় হতে হতে তিনি সতর্কতা অর্জন করেন। এ ছাড়া তাঁর পরিবারের লোকদের অবস্থা ও বিশ্বাসের বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাঁর বাবার পরিবারের লোকেরা মধ্যমপন্থার মানুষ ছিলেন। তাঁদের আর্থিক অবস্থাও মধ্যম পর্যায়ের ছিল। অন্যদিকে তাঁর মায়ের পরিবারের লোকেরা ছিলেন অর্থিক দিক থেকে বিত্তশালী। তাঁদের সংযোগ ছিল কমিউনিস্টদের সঙ্গে। তাঁর বাবার পরিবারের লোকেরা ছিলেন পিউরিটান। মা ও বাবার পারিবারিক আবহ ভিন্ন হলেও তাঁরা কখনো ঝগড়া-বিবাদ করতেন না। তবে একে অন্যের সঙ্গে রাজনৈতিক আদর্শের প্রসঙ্গে কথা বলার সময় কৌশলী পরিহাসমূলক বাক্য ব্যবহার করতেন। বড় হয়ে কাদারে তাঁর লেখায়ও এই কৌশল ব্যবহার করেন। কেননা তাঁর বৃহত্তর পরিবেশটাও বেশির ভাগ বৈরীই ছিল। সোজা কথা সোজাভাবে বলার সুযোগ ছিল না।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor