যুধিষ্ঠির তখনো তাকিয়ে আকাশের দিকে। হয়তো নিজেকে আড়াল করতেই তাকিয়ে থাকা। দূরের টিনটিনে চাঁদ আজ যুধিষ্ঠিরের ঘরে; মুখে, বুকে, বিছানায়।
জ্যৈষ্ঠ শেষ হলো। আম কেনা হয়নি যুধিষ্ঠির জলদাসের। আজ কিনল। ব্যাগ ভর্তি করে কিনল।
৯ সদস্যের পরিবারে আজ উৎসব হবে। আম উৎসব। জ্যৈষ্ঠের শুরুর দিকে ছেলেগুলো কয়েক দিন আম আম করছিল। জ্যৈষ্ঠের ১৫ পার হওয়ার পর আর বলেনি।
তারা জেনে গেছে, বলে লাভ নেই। প্রতিবছর এমনটিই হয়। আর তারা যখন পায়, তখন পাওয়া-না পাওয়া সমান হয়ে যায়। জিহ্বায় কিছুটা স্বাদ পেলেও মনে পায় না।
পেট সাড়া দিলেও মন দেয় না।
এখন সমুদ্র কিছুটা বিমুখ। বিহিন্দিজাল নিয়ে যতই জাললগ্ন আর জলমগ্ন হয়ে থাক না কেন, জাল উদোরপূর্ণ করে নৌকাই উঠে না। যা উঠে তাতে মন ভরে না। কর্ণফুলীর জেলেপল্লীর এ এক চিরায়ত রূপ।
শ্রাবণের ছিঁচকাঁদুনে আকাশের মতো। এই ঝলমলে সূর্য, এই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। এই হাসি এই কান্না।
আজ অতিরিক্ত কিছু সুন্দরী মাছ পেয়েছে যুধিষ্ঠির। না পাওয়ার দিনে এটাই অতিরিক্ত। একঝাঁক মাছ দিক ভুল করে যেন বিহিন্দির মধ্যে ঢুকে গেছে। মনে ফুর্তি এসেছিল যুধিষ্ঠিরের। কমলমুন্সির হাটে টান মৌসুম বলে দামও ভালোই পেল। তেল-নুন, কেরোসিন কিনে ব্যাগভর্তি আম কিনল। মূল খাঁচিরগুলো কিনতে পারেনি। সাইড করে রাখা অর্ধেক দামেরগুলো কিনেছে। ফজলি আম। দেখতে মন্দ নয়। যেমন সাইজ তেমনই টসটসে। বোঁটার কাছে কিঞ্চিৎ পচা। পচা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। বড়সড় কালো টিপের মতো দেখা যায়। চোখলাগা ছেলের কপালের কোনায় বসা টিপের মতো। যুধিষ্ঠিরের বড় ছেলে হরিশংকর ছিল বেশ চোখলাগা। যেমন নাদুসনুদুস তেমনই দেখার মতো। একটুতেই বদ বাতাস লাগে, মানুষের নজর লাগে। মা শুকতারা তেমনই একটা ঢাউস কালো টিপ কপালের বাঁ দিকে গুঁজে দিত। মা কখনো ভুলে গেলেও ঠাকুমা ভুলত না। হরিশংকরই এখন তাদের হরি। সেই টিপ পরা আর মাছি বসা আমগুলোই কিনল যুধিষ্ঠির।
সন্ধ্যা পার হয়েছে আগেই। দূরে দেখা যায় পতেঙ্গার বড় বড় আলো। রাতচোরা জাহাজ ডেকে ওঠে দরাজ গলায়। রাতের গভীরতা হালকা করে তোলে নিমেষেই। জাহাজের ডাক জেলেপল্লীর রাত জমাট বাঁধতে দেয় না। রাতে এ পল্লী ঘুমায় নাকি জেগে থাকে তা বোঝা মুশকিল। বাড়ির মরদ ভাসে সমুদ্রে। ঘরে বউ থাকে বাচ্চা বুকে চেপে। যার সন্তান নেই সেও থাকে। এভাবেই এই জেলেপল্লীর রাত-দিন সমান হয়ে থাকে। তবে আজকে যুধিষ্ঠিরের কাছে এই রাতটা দিনের অধিক মনে হলো। সে ব্যাগভর্তি আম নিয়ে ঘরে ঢুকছে। শুধু আম নয়, এক ব্যাগ আনন্দ। তবু সে ঢুকছে চুপিচুপি; চোরের মতো। শুকতারা বারান্দায় ছিল। পতেঙ্গার দিকে মুখ করে ছিল খুঁটিতে হেলান দিয়ে। সমুখের বাতি নিভিয়ে দূরের আলোর দিকে তাকিয়ে ছিল শুকতারা। দূরের আলোতে আশা আছে।
স্বামীকে দেখেই লাফ দিয়ে নামে শুকতারা। যুধিষ্ঠিরের মুখের দিকে তাকাবার সময় তার নেই। সে দ্রুত ব্যাগটা নিজের হাতে তুলে নেয়। চিল্লিয়ে বলে, ‘কিগো, ব্যাগভর্তি এগলা কী আনিচেন? এত্ত বাজার! মাছ ঘুরত আনলেন নাকি?’
- না, মাছ হোবি কেন? সংক্ষিপ্ত জবাব দেয় যুধিষ্ঠির।
- তাইলে ব্যাগের তলা ভিজা কেন?
- এগলা আম। স্বামীর কথা শুনে চোখ কপালে উঠে শুকতারার। বুক ফুলে উঠে আনন্দে। চিল্লিয়ে বলে- ও হরি, দ্যাকেক তুর বাপ কী আনিচে। শুকতারা পাশের ঘরে কিলবিল করা ছেলেদের ডাকে। তবে ডাকটা শেষ হতে দিল না যুধিষ্ঠির। শুকতারার মুখ চেপে ধরল।
- এই চুপ চুপ। খালি ফাল পাড়ে। চুপ মারল শুকতারা, তবে স্বামীর এমন আচরণ সে বুঝতে পারল না। মায়ের ডাকটা বোধ হয় পাশের ঘর পর্যন্ত পৌঁছায়নি। ছনে ছাওয়া দু’ঘরা বাড়ি। এক ঘরে থাকে শুকতারা, অন্য ঘরে তাদের ছয় সন্তান আর তাদের ঠাকুমা পরানেশ্বরী। ছেলেরা মেঝেতে গড়াগড়ি করে পড়ছে। চক ক্ষয় করছে শ্লেটে ঘষে। ছবি আঁকে বানরের। হরি সেই ছবিটা ছোটকে দেখিয়ে বলে, এইটা তুই। পরক্ষণেই সে শ্লেট কেড়ে নিয়ে বিঘত ঘোড়া মাছ এঁকে বলে, তাইলে এটা তুই। এই তাদের পড়াশোনা। আর এই পড়াশোনার দৌরাত্ম্যে মায়ের ডাক শুনতে পায়নি। সেই সুযোগে যুধিষ্ঠির শুকতারাকে টেনেহিঁচড়ে ঘরে তোলে। যুধিষ্ঠির তক্তপোষের ওপর বসে গামছায় মুখ মুছে। হাঁপায়। তার ওপর এত বড় বাগ বয়ে আনা। শুকতারা ব্যাগের দিকে তাকিয়ে স্বামীর ওপর ঝাল ঝাড়ে।
- ছাওয়ালগুলাক ডাকলি কী এমুন ক্ষতি হতো? তাজা আমগুলান দেখি চোখ জুড়াত।
- তাজা দেকপার এত সাধ কেন? এইডা কি ইলিশ মাছ?
- তুমার খালি বেঁকা কথা।
- বেঁকা লয় শুক। তুই আজক্যা লতুন সাজিস কেন? যা আঁশবঁটিটা লিয়ে আয়। শুকতারা কথা বাড়ায় না। সে বুঝে ফেলে, যুধিষ্ঠির এখন কী করবে।
শুকতারা আঁশবঁটির সঙ্গে একটা গামলাও আনে। যুধিষ্ঠির বসে পড়ে আম কাটতে। ব্যাগ থেকে আমগুলো ঢালতেই মনটা কেমন খারাপ হয়ে গলে যুধিষ্ঠিরের। কয়েকটা আম গলে গেছে। যার ঝোলে মেঝে ভিজে গেল। যুধিষ্ঠির এবার বুঝতে পারে, মাছের পচা আর আমের পচা এক জিনিস নয়। মাছে মাছি বসার ধরন বা মাছির ধরন দেখেও যুধিষ্ঠির বুঝে ফেলে, মাছ কতটুকু পচেছে আর কতটুকুই বা রাখা যাবে; দামদর করা যাবে। কিন্তু আম চেনা মুশকিল। মুখের কালো দাগ আমের ভেতরদেশে কত দূর পৌঁছেছে যুধিষ্ঠির বুঝতে পারেনি। আমগুলো এখন বাদ দিয়ে কাটছে। কোনোটার অর্ধেক, কোনোটার আংশিক বাদ দিতে হলো। ফেলেও দিতে হলো একটা।
- ছাওয়ালদের ডাকলি পরে আমগুলান দেকলি খুশি হতো। আমের বাদ দেওয়া অংশগুলো অন্য পাত্রে তুলতে তুলতে বলল শুকতারা।
- না রে শুক, তারা পচা আম দেকলি আনন্দ পানি হতো। মুক মুনে মুনে গালি দিত।
- ক্যান তারা জানে না, জাইলার পোলার ভালো আম খাতি নাই?
- তুমিও কেমুন ছেলি মানুষের মুতন করিস। যা তাদের ডাক। শুকতারা উঠে গেল ছেলেদের ডাকতে। বাদছাদ দিয়েও গামলা ভরে উঠেছে। সেদিকে তাকিয়ে হাসে যুধিষ্ঠির। আজকের সমস্ত সুখ এই গামলার মধ্যে। এক গামলা সুখই তাদের জন্য ঢের। গাঢ় হলুদাভ সুখ। বেশি কিছু ভাবার সুযোগ পেল না যুধিষ্ঠির। হুড়মুড়িয়ে ঢুকল সবাই। হরি সবার পেছনে। সবাই গোল হয় বসে পাল্লা দিয়ে খেতে লাগল। প্রতিদিনই তারা তাকিয়ে থাকত বাবার ফেরার অপেক্ষায়। আজ বুঝি আম আনবে। দৌড়ে গিয়ে বাবার হাত থেকে ব্যাগ কেড়ে নিত। মুখে কিছু বলত না। ব্যাগটা আবার আছাড়মারা করে বারান্দায় ফেলে দৌড় দিত ঠাকুমার ঘরে। ছেলেদের এই অভিমান যুধিষ্ঠির ঠিকই বুঝে। বুঝে শুকতারাও। আড়ালে মুখ ঢাকে। এখন তারা তক্তপোষের ওপর বসে হরিদের আম খাওয়া দেখছে। মা-বাবা তাই খাওয়া দেখছে। নরম আম, অত জোরে না চাবালেও চলে। এলি তো এলি, আরো আগে এলি না কেন। খাবার ঢঙ কতকটা এমনই। খেতে খেতে তিন নম্বর রবি বলল- বাবা, তুমি আমগুলান গোটা থাকতি ডাকলিন না কেন? রবি একটু বেশিই ঠ্যাঁটা। বেশি বলে।
- কেন, ছিলি দিনু এই তো ভালো।
- আম নিজে ছিলে খেতি মজা বেশি। তুমি প্রতিবারই এনে ছিলায়ে দাও। বহদ্দারের বেটা আমের ঠোঁট কেটে সেদিন চুষে চুষে খেল। মুক দেকিয়ে খেল। ইস! একটা গোটা থাকলি কালকে শালাকে দেকিয়ে খেতাম। ছেলের কথা শুনে কোনো কথা বলে না তারা। যুধিষ্ঠির আর শুকতারা দুজন দুজনার দিকে তাকিয়ে বুকভরে বাতাস নিয়ে লম্বা করে ছাড়ে। বড় ছেলে হরির মনের মধ্যে এখন অবশ্য অন্য খেলা। সে আবিষ্কার করে, আজ বাবার মন বেশ খুশি। মাছ বেচে লাভ হয়েছে। না হলে আম আনবে কেন? সে ঠিক করল, অনেক দিন থেকে পুষে রাখা কথাটা আজ বাবাকে বলবে। এমন সুযোগই সে এত দিন মনে মনে খুঁজছিল। তার অনেক দিনের স্বপ্ন- একটা নাটাই, রঙিন ঘুড়ি আর পাঁচ শ গজি সুতার একটা বান্ডেলের মালিক হওয়া। সুতায় মাঞ্জা দেওয়ার সব সরঞ্জাম আগেই সংগ্রহ করে রেখেছে হরি। যেভাবেই হোক, বাবাকে আজ রাজি করাতেই হবে। সে আম খাওয়া বাদ দিয়ে বাবার দিকে তাকাল কথাটা বলার জন্য। কিন্তু বাবা তখন তাকিয়ে আকাশের দিকে। প্রতিবছর চালা ছাওয়ার কথা থাকলেও এবার ছাওয়া হয়নি। এবার ছন খুব আক্রা। এক বোঝা ছনের দাম এবার তিন টাকা। গড়পড়তা এক শ টাকা লাগে ঘর ছাইতে। এবার সারা বছরে এক শ টাকা জোগাড় করা সম্ভব হয়নি যুধিষ্ঠিরের। বর্ষার দিনে বিছানা সরাতে আর মেলতেই সারা রাত পার হয়। ঘরের চালে এখন বেশ কয়েকটা ফুটো। চাঁদ দেখা যায়। সেই ফুটোর দিকেই তাকিয়ে আছে যুধিষ্ঠির। ফুটো গলে চাঁদের ত্যারচা আলো এসে পড়েছে তার গালে। সারা মুখ চকচক করে যুধিষ্ঠিরের। হরি ভালো করে খেয়াল করে, সারা মুখ নয়; গাল বেয়ে যাওয়া েনানা জলের এক ক্ষীণ স্রোতা নদীতে চাঁদ ডুবে চিকচিক করছে। অথবা এক সমুদ্র থেকে পানি আর এক সমুদ্রে বয়ে যায়। যুধিষ্ঠিরের শরীর এক উপসমুদ্র। মানুষের শরীরে যদি পঁচাত্তর ভাগ পানি থাকে, তবে যুধিষ্ঠিরের শরীরে পঁচাত্তর ভাগই বঙ্গোপসাগরের পানি। বাবা কাঁদছে। হরির আর বলা হলো না এত দিনের লুকিয়ে রাখা স্বপ্নের কথা। হরির নাটাই-ঘুড়ি বাবার নোনা জলে ভেসে গেল।
হরিরা আম খেয়ে হাত চাটতে চাটতে ঘর থেকে চলে গেল। যুধিষ্ঠির তখনো তাকিয়ে আকাশের দিকে। হয়তো নিজেকে আড়াল করতেই তাকিয়ে থাকা। দূরের টিনটিনে চাঁদ আজ যুধিষ্ঠিরের ঘরে; মুখে, বুকে, বিছানায়। চাঁদ হাসে, হাসে যুধিষ্ঠিরও। যুধিষ্ঠির আকাশের দিকে তাকিয়েই বলে- বউ, কুপিটা নিভায় দে।
Publisher & Editor