পথ দেখতে দেখতে পথ ফুরায়। পথের শেষে শূন্য গন্তব্যে পাক খায় দিকহারা পথিক। তার পানির পিপাসা লাগে। পানি পানের জন্য কুয়োর পারে গিয়ে সে এক সুন্দরী নারীকে দেখে এবং সে পানি পানের কথা ভুলে যায়।
নারীটির ভ্রুর আহ্বানে পথিক তার পিছু নিলে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথের বাঁকে বাঁকে রমণী যখন পেছন ফিরে চায় পথিক তাকে অনুসরণ করছে কি না দেখতে, তখন পথিক শুধু রমণীর দৃষ্টির ভেতরই তার পথ খোঁজে পায়। যেতে যেতে পাহাড়ের গাছ, সবুজ তার মন আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। পাখির গান তার মনোযোগ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, পথিক কোনো কিছুতেই ভোলে না। সে নারীর রঙিন আঁচলে চোখ রেখে নিবদ্ধযাত্রায় কত দূর যাবে কে ভেবে রেখেছে।
তার পথ ফুরায় না। নারীটি বোধ হয় পাহাড়টি অতিক্রম করবে এবং এ মুহূর্তে তার জলের মশক বহন করার জন্যও যে তার যাওয়া উচিত, তা পথিকের মনে হয়। তাই সে অবজ্ঞা করতে পারে না কোনোমতে।
পাহাড়ের খাড়ের কাছে মাটি কেটে নেওয়া হয়েছে কিছুদিন আগে।
সেখানে লতার সদ্য বেড়ে ওঠা ডগাগুলো সাপের মতো ঝুলে আছে আর ফুঁসছে যেন অদৃশ্য বিষের বিষে। তাই তাদের নির্বিষ ঝুলে থাকা কোনো অর্থ বহন করতে পারে না পাহাড় কাটা ইঁদুরদের কাছে। বড় বড় মাটির গর্ত খুঁড়ে তারা পাহাড়ের প্রাণবিন্দু বের করে চলছে দিনরাত। কয়েকটি শিয়ালের গর্তও আছে বোধ হয় এখানে। কেটে নেওয়া পাহাড়টির পাশে ঝোপের কাছাকাছি হয়তো তাদের গর্ত আর রোদের আলোয় তারা কী নির্বিবাদে দেহ তাতাচ্ছে কেটে নেওয়া মাটিতে গড়াগড়ি করে।
নারী ও পথিকের আগমনে তারা সরে সরে যায়, ঝোপের ভেতর দৌড়ে পালায় ইঁদুরগুলোসহ। তখন পাহাড়ে মাটিতে ইঁদুর-শিয়ালে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে পথিক টের পায় তার দেহ ও হৃদয়, হয়তো বা যুবতির দেহ ও তার হৃদয়, হয়তো বা তার দেহ যুবতির হৃদয় হয়ে মিশে গেছে। তখন সে আর রমণীটি থেকে তাকে আর তফাত করতে পারে না এবং একই রকম অন্তরাত্মা যেন সে দেখতে পায় দুজনেরই।
রমণীটি পাহাড়টি ডিঙায়। জলের মশক সে নিজেই বহন করে। মাঝখানে পেছন ফিরে চায় পথিক তাকে ঠিকভাবে অনুসরণ করছে কি না। হঠাৎ তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে পথিক না থাকলে সে সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। রোদের তীব্রতায় তার ভ্রু সামান্য কুঞ্চিত হয়। সে ভ্রুর ওপর হাতের কবজি রেখে আরো দূরে দেখার চেষ্টা করে। না, পথিক নেই। কই? কোথাও দেখা যাচ্ছে না তো! রমণী এবার পেছনযাত্রা শুরু করে এবং একটি গাছের গুঁড়িতে হেলান দেওয়া অবস্থায় পথিককে দেখতে পায়। ক্লান্ত অথবা মূর্ছাও গিয়ে থাকতে পারে। যুবতি তার কলসি থেকে জল ছিটিয়ে দেয় যুবকের মুখে। দু-একবার কেঁপে ওঠে যুবকের চোখ। চোখ খুলতে পারে না। কোনো রকম বলতে পারে, পানিহ! যুবতি তাকে পানি দেয়। মশক থেকে আঁজলায় ঢেলে পান করানোর চেষ্টা করে। আধবন্ধ মুখ থেকে গড়িয়ে পানি পড়ে যায় নিচে। এবার রমণী তাকে আরেকটু সোজা করে বসানোর চেষ্টা করে। পথিকের মাথা টলে পড়ে যায়। তাই সে কোলের ওপর হেলান দিয়ে নিজের বক্ষ-মদিরায় মাথাটি টেনে নেয় পথিকের। পরম প্রেমের সঙ্গে মুখটি খুলে দেওয়ার চেষ্টা করে, মমতায় আঁজলা ভরে জল দেয়। দু-তিন ফোঁটা হয়তো পান করে পথিক। তার চোখ খুলে যায়। চোখ খুলতেই আপন বুক থেকে পথিকের মাথাটি ঠেলে সরিয়ে দেয় রমণী আর পথিকও যেন সম্ভ্রমে নিজের দেহটিকে না পারতেও টেনে একটু সরিয়ে নেয় যুবতির কোল থেকে। তবে মাথাটি সে তুলে ঠিক দাঁড়াতে পারছে না। বসেও থাকতে পারছে না সোজা হয়ে। তাই সে গাছটির গায়ে হেলান দিয়ে বসে, অনেকটা আধশোয়া হয়ে। প্রাচীন এই গাছটির মমতাময় পেট যেন বিছানোই ছিল শিকড়ের মখমলে। পথিকের ঘুম পাচ্ছে খুব। সে চোখ দুটি টেনে খুলে রাখতে পারছে না। যুবতিটি পথিকের মাথার চুলে বিলি কাটতে থাকে। পথিক ঘুমিয়ে পড়ে।
মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে পথিক দেখে একা চাঁদ আকাশে আর একা রমণীটি তার শয্যায় জেগে আছে। সে কি! একা একটি রমণী একা একটি মুমূর্ষু-ঘুমন্ত যুবকের সঙ্গে সেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, রাত, মধ্যরাত অবধি জেগে আছে। সে তার কাছে ছায়া বলে মনে হয়। আসলেই কি সে ছায়া। না, মোটেও নয়। যুবতি তার আঁচল থেকে দুটি ফল বের করে পথিকের হাতে দেয়। চোখের ভাষায় বলে—খাও। একান্ত অনুগত সহসংসারীর মতো সে-ও হাত পেতে নেয় যুবতির কাছ থেকে দুটি ফল আর অভুক্তের মতো খেলেও একটি সে যুবতির দিকে বাড়িয়ে দিতে ভোলে না, মুখে বলে—তুমিও খাও। যুবতি পথিকের হাত থেকে ফল নিয়ে খেতে থাকে। সাদা চাঁঁদের মতো সে ফল রাতের অন্ধকার, আবছায়া, বিভ্রম, ভয় আর হাহাকারকে কোথায় যেন শূন্যে ছুড়ে মারে। পথিকের বেশ নির্ভার লাগে নিজেকে। সে চাঁদের আলোর দিকে তাকিয়ে দেখে, সেদিকে রমণীটিও তাকিয়ে। সে দূরে একটি ছোট্ট নীল গ্রহে চোখ রেখে দেখে রমণীর দৃষ্টিও তার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে। দূরে একটি হুতোমপ্যাঁচা হোহ হো হো, হোহ হো হো করে ডাকতে থাকে। কোথা থেকে যেন একদল নীল সারস আকাশকে অতিক্রম করে তাদের মাথার ওপর গাছে এসে বসে। একটি শিয়াল কোনো ছোট প্রাণীকে তাড়া করে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। দু-একটি বনখাটাশ সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে তাদের দিকে। চরাচরে সবুজ বিছিয়ে আছে। রাতের জ্যোত্স্নায় সেগুলো আরো বেশি ঘন হয়ে কালো হয়ে আছে। আর কোটি তারা ঝিকমিক করছে আকাশভরে। এমন জ্যোত্স্নাবিধৌত রাতে পথিকের আর তখন গন্তব্য বলে কিছু থাকে না। আশ্চর্যের যে রমণীটিও ভুলে যায় তার কোথাও মশক নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। হয়তো ঘরে তার অসুস্থ স্বামী স্ত্রীর পথ চেয়ে তৃষ্ণায় মরে যাচ্ছে, হয়তো অন্য কেউ। কেউই এই মুহূর্তে আর নিজের অতীত নিয়ে ভাবছে না এক মুহূর্তও। অপরূপ রাতের শোভার ভেতর পরস্পরের পাশাপাশি বসে যেন মুছে গেছে স্মৃতিচিহ্ন সব, মুছে গেছে পরিজন-পরিবার।
এসব মুছে যাওয়ার ভেতর রাত বাড়তে থাকলে পথিকের মনের ভেতর একটা শূন্যতা তৈরি হয়। একটা হাহাকার যেন ফুরায় না তার বুকে। অথচ রাত তো ফুরিয়ে যাচ্ছে, আর রাত শেষ হলেই যদি সে দেখতে পায় এসব তার স্বপ্নের বিভ্রম, তাহলে এই চাঁদ, জ্যোত্স্নাবিধৌত রাত আর তারাভরা আকাশের নিচে বুনো ফুলের গন্ধ মাখানো এই অপরূপ রমণীটি যদি তার কাছ থেকে হারিয়ে যায়, তাহলে আর তার জেগে উঠে লাভটা কী। পথিক দেখে, ফুঁপিয়ে কাঁদছে নারীটিও। সে কিছু বলছে না। কিন্তু চোখের জলের প্রতিটি বিন্দুর ভাষা যেন পড়ে ফেলতে পারছে পথিক, যেন নারীটিও এই রাত ফুরিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আতঙ্কিত। সে-ও যেন এই মগ্নপাহাড়ের তুমুল নৈঃশব্দ্যের ভেতর নিজেকে ছুড়ে ফেলে অতীত এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের কোনো সংজ্ঞা রাখতে চাচ্ছে না। সে-ও যেন হাজার তারার মাঝে দূরে একটি নীল তারার ক্রমেই মলিন হয়ে যাওয়া দেখছে আরো বেশি বিরহজ্বালাসহ। তার হাত ভিজে যাচ্ছে, আঁচল ভিজে যাচ্ছে, ভিজে যাচ্ছে রাতের কালো দেহ চোখের জলে। সে জলের ধারা ঝরনা হয়ে পথিকের তৃষ্ণা যেন আরো বাড়িয়ে তোলে।
Publisher & Editor