মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫

সংসারে এক সন্ন্যাসী

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ০৬ অক্টোবর ২০২৫ | ১১

হেলাল হাফিজের চোখে থাকত সুদূরের দৃষ্টি। যতবার তাঁর চোখের দিকে তাকিয়েছি, ততবারই মনে হয়েছে, এই সময়ের মধ্যে থেকেও তাঁর দৃষ্টি চলে গেছে অন্য সময়ে। এই জগতের ভেতরে থেকেও দৃষ্টি এই জগতের ভেতরে নেই। দৃষ্টি চলে গেছে অন্য কোনো জগতে।

যেন আজন্ম এমন এক অন্বেষণে ডুবে আছেন তিনি, এক জীবনে সেই অন্বেষণ কখনোই শেষ হবে না।
কী সেই অন্বেষণ?

কবিতা? কবিতার মায়াময় জগৎ!

সংসারে এক সন্ন্যাসীহ্যাঁ, তাই। কবিতার অন্বেষণে একটা জীবন কাটিয়ে গেছেন হেলাল হাফিজ। লিখেছেন খুব কম।

তবে যা লিখেছেন, তা-ই ইতিহাস হয়ে গেছে। এমন সৌভাগ্য খুব কম বাঙালি কবিরই হয়েছে। কেউ তাঁকে বলেছেন, ‘অল্প লিখে গল্প হওয়া কবি’। কউ বলেছেন, ‘কষ্টের ফেরিওয়ালা’।

তিনি নিজে বলেছেন, ‘মাতৃহীনতার বেদনা আমাকে কবি করেছে।’
শৈশবে মাকে হারিয়েছিলেন হেলাল হাফিজ। সেই বেদনা তাঁকে আজীবন আক্রান্ত করে রেখেছে। হয়তো সৃষ্টিকর্তার ওপর তীব্র অভিমান হয়েছিল। সৃষ্টিকর্তাই জীবন দান করেন, সেই জীবন আবার কেড়েও নেন।

কেন তাঁর মাকে শৈশবেই ছিনিয়ে নিয়েছিলেন? হয়তো এই অভিমানই তাঁকে নিমজ্জিত করে রেখেছিল মৃত্যুমুহূর্ত পর্যন্ত। বিয়ে করলেন না। সংসার করলেন না। কাটিয়ে গেলেন সন্ন্যাসীর জীবন। কবিতার জগতে বসবাস করলেন। কবিতার সংসারই ছিল তাঁর সংসার। বন্ধুদের সঙ্গে, চারপাশের মানুষের সঙ্গে থেকেও থাকতেন আসলে একা। নিজের মধ্যে।
১৯৬৯ সালে লিখলেন ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি। ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। এই একটিমাত্র কবিতা লিখেই কিংবদন্তি হয়ে গেলেন হেলাল হাফিজ। ইতিহাস হয়ে গেলেন। তার পরে হলেন ‘কষ্টের ফেরিওয়ালা’। লিখলেন ‘কষ্ট নিবে, কষ্ট’। আবার লিখলেন, ‘আণবিক বোমা বোঝো, মানুষ বোঝো না’।

এইসব লাইন হেলাল হাফিজকে আকাশস্পর্শী জনপ্রিয় করে তুলেছিল। খ্যাতির চূড়ান্তে পৌঁছে দিয়েছিল। একটি-দুটি রচনা কবি-লেখকদের অতি উচ্চে পৌঁছে দিলে কিছুটা বিপদও হয়। এক ধরনের সংশয়ে ভোগেন কবি-লেখক। ভাবেন, আগের লেখার মান ধরে রাখতে পারবেন কি না। সেই মাত্রায় পৌঁছতে পারবেন কি না। এই দ্বন্দ্বে ভুগে কলম আর এগোতে চায় না।

আমার ধারণা, হেলাল ভাই এই দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সময়কার বা সঙ্গের কবিদের একের পর এক বই বেরোতে লাগল স্বাধীনতার পর থেকে। হেলাল ভাই চুপচাপ। হঠাৎ হঠাৎ দু-একটি কবিতা লেখেন। বই প্রকাশের তাগিদ নেই। নিজের মতো করে সন্ন্যাসজীবন যাপন করেন। মুন্সীগঞ্জে গিয়ে একটি স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করে এলেন। বিভিন্ন সংবাদপত্রে কাজ করলেন ঘুরে ঘুরে। থাকতেন বোর্ডিং হাউসে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আঠারো ঘণ্টাই কাটাতেন প্রেস ক্লাবে। অতি সাধারণ বেশ। ফতুয়া আর প্যান্ট পরা। পায়ে চপ্পল। মাথার পাতলা চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। চোখে চশমা। চশমার ওপারে তাঁর সেই উদাসীন চোখ। চোখে সুদূরের দৃষ্টি। কথা বলেন কম। মুখে মায়াবী হাসি। আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আমার চেয়ে সাত বছরের বড়। বয়সের ব্যবধান আমাদের বন্ধুত্ব আটকায়নি। আমি তাঁকে ‘হেলাল ভাই, তুমি’ বলতাম। দেখা হলেই এক হাতে এমন করে জড়িয়ে ধরতেন, সেই স্পর্শে ছিল গভীর গভীরতর মমত্ববোধ। হেলাল ভাইয়ের কাঁধে সব সময়ই ঝোলানো থাকত কাপড়ের ঝোলা। বহু মানুষের মধ্যে থেকেও নিজেকে তিনি আলাদা করে ফেলতে পেরেছিলেন।

আগের প্রসঙ্গে ফিরি। বন্ধুদের কবিতার বই বেরোচ্ছে একের পর এক। হেলাল ভাই নির্বিকার। কবিতার বই কবে প্রকাশ করবেন, এই প্রসঙ্গ উঠলেই মুখে ফুটত স্মিত হাসি। প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতেন। আর আমরা যারা তাঁর ভক্ত পাঠক, তারা শুধু অপেক্ষা করতাম।

অপেক্ষার কাল শেষ হলো ১৯৮৬ সালে। প্রকাশিত হলো হেলাল ভাইয়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। এই গ্রন্থের প্রকাশনার ইতিহাস আমি একটা লেখায় লিখেছি। কবি হাসান হাফিজ সম্পাদিত ‘হেলাল হাফিজ, অভিমানে সন্ন্যাসে’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এই লেখা আসলে ওই গ্রন্থটি নিয়েই।

প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যজগতে মহাহিল্লোল তুলল। একের পর এক মুদ্রণ হতে লাগল গ্রন্থটি। এ পর্যন্ত গোটা চল্লিশেক মুদ্রণ হয়েছে। ওগুলো স্বাভাবিক মুদ্রণ। অস্বাভাবিক, মানে পাইরেটেড এডিশন হয়েছে কতগুলো, সে খবর আমাদের কানে পৌঁছেনি। এককথায়, বাংলা কাব্যগ্রন্থের জগতে হেলাল হাফিজের ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বিক্রির সর্বোচ্চ তালিকায় উঠে বসে আছে।

আমি নিশ্চিত, পরবর্তীতে হেলাল ভাইয়ের কম লেখা বা বই প্রকাশ করার অনীহার এটাই প্রধান কারণ। তিনি নিশ্চয় ভেবেছেন, পরের বই কি প্রথমটির রেকর্ড ভাঙতে পারবে? এই দ্বিধা তাঁকে বহু বছর নিরস্ত রেখেছে। মোট ছয়টি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে। আসলে বই হচ্ছে দুটি। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ আর ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’। এই দুটি বই ভেঙে আরো চারটি।

কবি-লেখকদের অভিমান নিয়ে আমি ভেবেছি। কেউ কেউ কেন অভিমানী হন তাঁরা। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে ঔপন্যাসিক মাহমুদুল হকের কথা। অসামান্য কিছু গল্প-উপন্যাস লিখেছিলেন। ‘অনুর পাঠশালা’ বা ‘যেখানে খঞ্জনা পাখি’, ‘নিরাপদ তন্দ্রা’, ‘জীবন আমার বোন’, ‘খেলাঘর’, ‘মাটির জাহাজ’, ‘পাতালপুরি’। আর একটিমাত্র গল্পের বই ‘প্রতিদিন একটি রুমাল’। ছোটদের উপযোগী কিছু গল্প লিখেছিলেন। একটি কিশোর উপন্যাস লিখেছিলেন, নাম ‘কুশল ও চিক্কুর মারণকাবুক’। আর কিছু অনুবাদ করেছিলেন। মাহমুদুল হক সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘এই লেখক বাংলা গদ্যে প্রভুত্ব করার ক্ষমতা রাখেন।’

মাহমুদুল হকের ডাকনাম ছিল বটু। আমরা ‘বটু ভাই’ বলে ডাকতাম। বটু ভাই হঠাৎই লেখা ছেড়ে দিলেন। কলম আর ধরলেনই না। আমি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘লিখছেন না কেন, বটু ভাই?’ তিনি অভিমানী গলায় বলেছিলেন, ‘কী হবে লিখে?’ তাঁর অভিমানটা আমি পরিষ্কার টের পেলাম। কিন্তু বুঝতে পারলাম না, অভিমানটা কার ওপর? পাঠকের ওপর? পাঠক কি তাঁর মূল্যায়ন করছেন না? যদি তিনি এই রকম ভেবে থাকেন, তাহলে সেটা ভুল ভাবনা। পাঠক মাহমুদুল হককে মাথায় তুলে রেখেছিলেন। তাঁর বেশির ভাগ গল্প-উপন্যাসই অতি প্রশংসিত। তাহলে? তাঁর অভিমান কি সম্পাদকদের ওপর? প্রকাশকদের ওপর? না, তেমনও তো নয়। আমি তখন সাপ্তাহিক ‘রোববার’ পত্রিকায় কাজ করি। ‘রোববার’-এর পাশাপাশি ‘বিচিত্রা’ আর ‘সচিত্র সন্ধানী’ও প্রকাশিত হয়। সিনেমা পত্রিকা ‘চিত্রালী’ ও ‘পূর্বাণী’ প্রকাশিত হয়। তখনো দৈনিক পত্রিকাগুলো ঈদ সংখ্যা প্রকাশ শুরু করেনি। কিন্তু সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো ঈদ সংখ্যার উপন্যাসের জন্য মাহমুদুল হকের কাছে গিয়ে লাইন দিত। এই ঘটনা আমি নিজ চোখে দেখেছি। তাঁর বইয়ের প্রকাশকেরও অভাব ছিল না। তাহলে অভিমানটা কার ওপর?

অভিমান ছিল আসলে নিজের ওপর। হয়তো যা লিখতে চাচ্ছিলেন, পারছিলেন না। যেমন করে চাইছিলেন, পারছিলেন না। ফলে প্রথমে এক ধরনের ক্রোধ তৈরি হয়েছে নিজের ওপর। তারপর ক্রোধ চলে গেছে অভিমানের দিকে।

হেলাল ভাইয়ের ক্ষেত্রেও বোধ হয় এটাই কারণ। আবার এমনও হতে পারে, বেশি লেখা তিনি পছন্দই করতেন না। হয়তো তিনি ভাবতেন, যা লিখবেন, সেটাই অতি উচ্চমাত্রার হবে।

আমি অবশ্য এই ধারণার সঙ্গে একমত নই। কোনো লেখক বা কবিই আসলে জানেন না, তাঁর কোন লেখাটি ইতিহাস হয়ে যাবে। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বেশ কয়েকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস লিখেছেন তিনি। যেমন—‘চরিত্রহীন’, ‘পথের দাবী’, ‘গৃহদাহ’ এবং আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘শ্রীকান্ত’। এগুলো অবশ্যই বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ রচনা। কিন্তু এইসব লেখার কথা পাঠক আর বলেন না। বলেন ‘দেবদাস’-এর কথা। এক শ বছরের ওপর হয়ে গেছে ‘দেবদাস’-এর বয়স। সেই বই এখনো সমান জনপ্রিয়। হিন্দি ও বাংলা ভাষা মিলিয়ে আটবার সিনেমা হয়েছে। প্রতিবারই সুপারডুপার হিট। অথচ শরত্চন্দ্র নিজেই তাঁর এই উপন্যাসটিকে দুর্বল রচনা হিসেবে বিবেচনা করতেন।

কথায় কথায় অনেক কথা বলা হলো। এবার হাসান হাফিজ সম্পাদিত ‘কবি হেলাল হাফিজ, অভিমানে সন্ন্যাসে’ সংকলনটি নিয়ে বলি। গুনে দেখেছি, এই সংকলনে হেলাল হাফিজের ৯টি সাক্ষাৎকার আছে। এর মধ্যে সাতটিই হাসান হাফিজের গ্রহণ করা। হাসান হাফিজ আমার বিশেষ বন্ধু। সাহিত্যের সব শাখায় তাঁর বিচরণ। ছোটদের জন্য প্রচুর লিখেছেন। প্রচুর বই সম্পাদনা করেছেন। আমাদের অগ্রগণ্য কবিদের একজন। হেলাল হাফিজ খুবই ভালোবাসতেন তাঁকে। লেখালেখির শুরুতে হাসান হাফিজের নাম হাসান হাফিজ ছিল না। হেলাল ভাই নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে তাঁর নাম ‘হাসান হাফিজ’ করে দিয়েছিলেন। বোধ হয় এই কারণে হেলাল ভাইয়ের প্রতি তাঁর সবিশেষ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও গভীর কৃতজ্ঞতা ছিল। এখনো আছে। নিশ্চয় আমৃত্যু থাকবে। হেলাল ভাই চলে যাওয়ার পর ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকায় বেশ বড় আয়োজন করেছিলেন হাসান হাফিজ। তিনি এই পত্রিকার সম্পাদক। তারপর হেলাল ভাইয়ের প্রয়াণ দিবস সামনে রেখে সম্পাদনা করলেন ‘কবি হেলাল হাফিজ, অভিমানে সন্ন্যাসে’। এসবই কবির প্রতি আরেক কবির আন্তরিক ভালোবাসার নিদর্শন। এ রকম আজকাল তেমন দেখা যায় না। প্রকৃত কৃতিমানদের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা জানানোর ক্ষেত্রে আমরা বড় কৃপণ হয়ে গেছি। কেউ ভালো কাজ করলে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে প্রশংসা করতে আমরা ভুলে গেছি। হয়তো হীনম্মন্যতায় ভুগি। ভাবি, অমুকের প্রশংসা করলে আমি বোধ হয় খাটো হয়ে যাব। এই নিম্নভাবনার কালে অগ্রজ কবি হেলাল হাফিজের প্রতি যে সম্মান হাসান হাফিজ দেখালেন, তা উদাহরণ হয়ে থাকবে।

এই গ্রন্থে হেলাল হাফিজকে নিয়ে প্রবন্ধ ও স্মৃতিচারণামূলক লেখা লিখেছেন বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান লেখক-কবি। সবার লেখা আমার পড়া হয়ে ওঠেনি। হাসান হাফিজের লেখাটা পড়েছি। লেখার শিরোনাম ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’। ইরাজ আহমেদ, সুমন রহমান ও সাকিরা পারভিনের লেখা পড়েছি। প্রতিটি লেখাই ভালো লেগেছে। না পড়েও বলতে পারি, অন্যদের লেখাগুলোও নিশ্চয় ভালো। যেহেতু হাসান হাফিজ সম্পাদনা করেছেন, মূল্যবান রচনা ছাড়া তিনি গ্রন্থে সংকলিত করবেন না। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স বইটির প্রোডাকশন ভালো করেছে।

আগেই বলেছি, ৯টি সাক্ষাৎকারের মধ্যে সাতটি সাক্ষাৎকারই হাসান হাফিজের নেওয়া। এই দেখে আমি একটু অবাকই হয়েছিলাম। একই কবির সাতটি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আরেক কবি! এত সাক্ষাৎকার নেওয়ার কী আছে? এক সাক্ষাৎকারেই তো তাঁর সব কথা জেনে নেওয়া যেতো। পরে লক্ষ করলাম, সাক্ষাৎকারগুলো ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে করা হয়েছে। তা ছাড়া হেলাল হাফিজ যে মাত্রার কবি, তাঁর সাক্ষাৎকার শুধু সাতবার নয়, বহুবারই নেওয়া যায়। ধন্যবাদ, হাসান হাফিজ। ভবিষ্যতে হেলাল ভাইয়ের যেখানে যত সাক্ষাৎকার রয়েছে, সবগুলো সংগ্রহ করে আরেকটি বই তুমি সম্পাদনা করবে—এই আশায় রইলাম।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor