শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

পরমাণু স্থাপনায় ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বচসা

ইরান কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করবে না: আয়াতুল্লাহ খামেনি

প্রকাশিত: ০২:০৫, ২৭ জুন ২০২৫ |

ইরানের তিন পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ে শুরু হয়েছে বচসা। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, ইরানের নাতাঞ্জ, ইস্পাহান ও ফর্দোতে চালানো বোমা হামলা ‘ঐতিহাসিকভাবে সফল’। মার্কিনিদের উচিত এ হামলা উদযাপন করা। অপরদিকে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ লড়াইয়ের জয় উদযাপন করছে ইরান। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি বলেছেন, তাঁর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের গালে চড় মেরেছে। তেহরান কখনও ওয়াশিংটনের কাছে আত্মসমর্পণ করবে না।

গতকাল বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ জানান, মার্কিন হামলায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জাতিসংঘের পরমাণবিক পর্যবেক্ষকদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ক্ষতিটা হয়েছে ‘অনেক বেশি’। সিআইএও এমনটা মনে করে বলে জানান তিনি। এ সময় মার্কিন গণমাধ্যমের সমালোচনা করে হেগসেথ বলেন, গণমাধ্যম এটাকে ‘বিফল’ দেখাতে চাইছে। এটা অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ। বিবিসি জানায়, পিট হেগসেথ এ ‘ঐতিহাসিক সাফল্যে’ মার্কিনিদের ঘটনাটি উদযাপনের আহ্বান জানিয়েছেন। 

অপরদিকে যুদ্ধবিরতির পর প্রথমবারের মতো বক্তব্য দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। আলজাজিরা জানায়, ইরান কখনও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করবে না বলে জানিয়েছেন তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত বিবৃতি ও টেলিভিশন ভাষণে খামেনি বলেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁর এক বিবৃতিতে ইঙ্গিত দিয়েছেন– ইরানকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। আত্মসমর্পণ! এখন এটি আর সমৃদ্ধকরণের প্রশ্ন নয়, পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ও নয়, সরাসরি আত্মসমর্পণের প্রশ্ন! এ ধরনের ঘটনা কখনও ঘটবে না। কখনও না।’

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ১২ দিনের সংঘাতের পর প্রথমবারের মতো মুখ খুললেন খামেনি। গত ১৯ জুনের পর এটিই তাঁর প্রথম জনসমক্ষে বক্তৃতা। সংঘাত চলাকালে ইসরায়েলের হত্যার হুমকির মধ্যে তাঁকে গোপন বাঙ্কারে নেওয়া হয়। ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের মধ্যে ভাষণটি এলো। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, হামলায় পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ‘নিশ্চিহ্ন’ হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে খামেনি বলেন, ট্রাম্প হামলার প্রভাবকে ‘অতিরঞ্জিত’ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ‘এ যুদ্ধ থেকে কিছুই অর্জন করেনি’ দাবি করে তিনি বলেন, মার্কিন হামলা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ‘উল্লেখযোগ্য কিছুই হয়নি’। তিনি বলেন, ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র জিতেছে ও প্রতিশোধ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের মুখে চড় মেরেছে।’ বক্তব্যে নিজ দেশের সশস্ত্র বাহিনীকেও অভিনন্দন জানান খামেনি। 

এদিকে বিবিসির খবরে বলা হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বৃহস্পতিবার ইরানের ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনা থেকে সমৃদ্ধ করা ইউরেনিয়াম অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া নিয়ে কথা বলেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি বলেন, ‘ওই স্থাপনা থেকে কোনো কিছুই সরিয়ে নেওয়া হয়নি। এটা সরানো অনেক সময়ের ব্যাপার ও ভয়নক কাজ। খুবই কঠিন কাজ।’ 

যুদ্ধ শেষ, ইরানের সঙ্গে বৈঠক আগামী সপ্তাহে: ট্রাম্প

আগামী সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠক হবে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি জানান, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ১২ দিনের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। যুদ্ধের কারণে স্থগিত হওয়া সংলাপ ওই বৈঠকের মাধ্যমে ফের শুরু হবে। গত বুধবার ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা আগামী সপ্তাহে ইরানের সঙ্গে কথা বলব। একটা চুক্তিও হতে পারে। আমার দৃষ্টিতে তারা (ইরান-ইসরায়েল) যুদ্ধ করেছিল, আর এখন যুদ্ধ শেষ।’ তিনি বলেন, ‘১২ দিনের যুদ্ধ শেষে ইসরায়েল ও ইরান ক্লান্ত। তবে তাদের মধ্যে সংঘাত আবারও শুরু হতে পারে।’ 

ইরানে হামলা ১৫ বছরের পরিকল্পনার পরিণতি: মার্কিন জেনারেল

যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের প্রধান জেনারেল ড্যান কেইন বলেছেন, ইরানে অপারেশন ‘মিডনাইট হ্যামার’ ছিল ১৫ বছরের কাজের ‘চূড়ান্ত পরিণতি’। তিনি বলেন, হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনায় হামলায় যাতে সাফল্য অর্জন করা যায়, সেজন্য নকশা, পরিকল্পনা ও সরবরাহ করা হয়েছিল। কেইন বলেন, ঘটনাস্থলে দুটি ভাগে তারা হামলা চালান। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, হামলা প্রতিহত করার জন্য ইরানিরা সেগুলো কংক্রিট দিয়ে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কেইনের উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসি জানায়, ঘটনাস্থলে মোট ছয়টি বোমা নিক্ষেপ করা হয়। পরে একটি বোমার ভিডিও দেখান তিনি।

স্থাপনা ‘ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত’: সিআইএ পরিচালক

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর পরিচালক জন র‍্যাটক্লিফ বলেন, মার্কিন বাহিনীর হামলায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ‘ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়েছে। এ হামলা ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে কয়েক বছর পিছিয়ে দিয়েছে। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার প্রভাবকে খাটো করে দেখে মার্কিন গোয়েন্দাদের প্রাথমিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন ফাঁস হওয়ার পর সিআইএর পরিচালক এ কথা বলেন। প্রতিবেদন ফাঁসের ঘটনায় ভীষণ ক্ষুব্ধ হন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। 

জন র‍্যাটক্লিফ বলেন, মার্কিন হামলায় ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। যদিও তিনি ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ‘পুরোপুরি নির্মূল করা হয়েছে’ বলতে অস্বীকৃতি জানান। ফাঁস হওয়া ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে মার্কিন হামলার পরও ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো অক্ষত থাকার কথা বলা রয়েছে। প্রতিবেদন ফাঁস ও এটা নিয়ে ট্রাম্পের কড়া প্রতিক্রিয়ার এক দিন পর সিআইএর পরিচালক বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করলেন। 

গত বুধবার ট্রাম্প দাবি করেন, সংবাদমাধ্যমে ‘ভুয়া খবর’ ছড়ানো হচ্ছে। নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়ে ট্রাম্প বলেন, ইরানে চালানো হামলা ‘খুবই তীব্র’; ‘ধ্বংসের মতো’। আগামী সপ্তাহে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় বসবে বলেও জানান তিনি। 

ইউরেনিয়াম ভান্ডার অক্ষত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে: জাতিসংঘ

রয়টার্স জানায়, ইসরায়েল ও মার্কিন হামলায় ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ভান্ডার ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বলে ধারণা জাতিসংঘের। গত বুধবার আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রধান রাফায়েল গ্রসি বলেন, হামলার শুরু থেকেই ইউরেনিয়াম সরিয়ে থাকতে পারে তেহরান। ইরানের পক্ষ থেকে জাতিসংঘকে এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি বলেও জানান গ্রসি। এ প্রেক্ষাপটে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাঘাই আলজাজিরাকে বলেছেন, তাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছে, এটা নিশ্চিত।

হামলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাখ্যার প্রতিবাদ জানাল ইরান

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থাপিত ব্যাখ্যার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ইরান। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সেক্রেটারি জেনারেল ও প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে ইরানের স্থায়ী প্রতিনিধি আমির সাঈদ ইরাভানি এ ব্যাখ্যাকে আইনিভাবে ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করেন। 

চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলাকে ‘অবৈধ এবং জাতীয় সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন’বলে উল্লেখ করে তেহরান। সেইসঙ্গে জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদের আওতায় আত্মরক্ষার অধিকার দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এ হামলার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের হত্যা’ বলে বর্ণনা করা হয়।

ইসরায়েলের মতো নেতানিয়াহুকেও রক্ষা করবেন ট্রাম্প 

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ক্ষমা করে দেওয়া বা দুর্নীতির অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে চলা বিচারকাজ বাতিল করতে দেশটির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ইসরায়েলকে রক্ষা করেছে, ঠিক সেভাবে নেতানিয়াহুকেও রক্ষা করবে। 
গত বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এসব কথা বলেন বলে জানিয়েছে রয়টার্স। নেতানিয়াহুকে ‘একজন যোদ্ধা’ বলে প্রশংসা করে তিনি লেখেন, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে রক্ষা করেছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্রই নেতানিয়াহুকে রক্ষা করবে। 

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ঘুষ, প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে ইসরায়েলের আদালতে মামলা চলমান। ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প লেখেন, ‘নেতানিয়াহুর বিচার অবিলম্বে বাতিল করা উচিত, কিংবা তাঁর মতো একজন মহান নায়ককে ক্ষমা করে দেওয়া উচিত; যিনি ইসরায়েলের জন্য অনেক কিছু করেছেন।’ ট্রাম্প লেখেন, তিনি জানতে পেরেছেন, সোমবার আদালতে নেতানিয়াহুর হাজিরা দেওয়ার কথা রয়েছে।

জনগণের দৃঢ়তা ও প্রতিরোধে জয়: ইরানি প্রেসিডেন্ট

ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জয় জনগণের দৃঢ়তা ও প্রতিরোধের ফলে অর্জিত হয়েছে। বার্তা সংস্থা মেহের জানায়, জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক বার্তায় পেজেশকিয়ান বলেন, ইসরায়েলের সরকারের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়েছে ইরানের মহান জাতির প্রতিরোধ, ঐক্য এবং সৌহার্দ্যের মাধ্যমে। এ ঐতিহাসিক বিজয়ের সব গৌরব মহান জাতি ও সভ্যতার।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor