২০১৫ সালে আত্মপ্রকাশ করে কে-পপ ব্যান্ড সেভেনটিন। দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী এই কে-পপ ব্যান্ড আত্মপ্রকাশের এক দশক পার করেছে গত ২৬ মে। এক দশক পরও তারা সাফল্যের শীর্ষে। কোরিয়ান পপ মূলত সংগীত, নাচ, ফ্যাশন, ভিজ্যুয়াল আর্ট ও প্রযুক্তির সংমিশ্রণ। এমন ইন্ডাস্ট্রিতে ‘ব্যতিক্রম’ হয়ে ওঠা খুব একটা সহজ নয়। তবে সেভেনটিন শুরু থেকেই পেয়েছে ‘ব্যতিক্রম’-এর তকমা। ইন্ডাস্ট্রিতে এক দশক কাটিয়ে দেওয়ার পরও তারা স্বমহিমায় উজ্জ্বল। তারা কখনো নিজেদের হারায়নি; বরং সময়ের সঙ্গে নিজেদের নতুনভাবে উপস্থাপন করেছে। কঠোর পরিশ্রম আর সৃষ্টিশীলতার জন্যই সম্ভব হয়েছে এ অর্জন।
যেখানে অনেক জনপ্রিয় ব্যান্ড নিরীক্ষা করতে হোঁচট খাচ্ছে, সেখানে সেভেনটিন ঠিকই নিজেদের খুঁজে নিয়েছে। দ্বিতীয় দশকে পা দিয়ে তারা কে-পপের নিয়মই শুধু নতুন করে লিখছে না; বরং নিজেদের কাজ, শিল্প, সততা আর বন্ধুত্বের এক অন্য গল্প তৈরি করছে।
শুরুটা যেভাবে
প্লেডিস এন্টারটেইনমেন্ট এজেন্সির হাত ধরে শুরু হয় সেভেনটিনের যাত্রা। কে-পপ ইন্ডাস্ট্রির মূল চালিকা শক্তি এসব এজেন্সি। সম্ভাবনাময় শিল্পীদের নির্বাচন করে প্রশিক্ষণ দেয় তারা, তৈরি করে গ্রুপ; তারাই যথাযথ মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে শিল্পীদের ইন্ডাস্ট্রিতে নিয়ে আসে।
২০১২ সাল থেকে সেভেনটিনের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করছিল প্লেডিস এন্টারটেইনমেন্ট। এর মধ্যে অনেক নতুন শিল্পী যুক্ত হয়েছেন, বাদও পড়েছেন অনেকে। অবশেষে ১৩ সদস্য নিয়ে গঠিত হয় এই ব্যান্ড। ২০১৫ সালের ২৬ জুন সেভেনটিন ক্যারট অ্যালবামের মাধ্যমে তারা আত্মপ্রকাশ করে। এটি ছিল সে বছর সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া অভিষেক অ্যালবামগুলোর একটি। এভাবে শুরুতেই নিজস্ব প্রযোজনা, কোরিওগ্রাফি ও পারফরম্যান্সের মাধ্যমে নিজেদের আলাদা পরিচয় গড়ে তোলে সেভেনটিন।
১৩ সদস্যের ব্যান্ডের নাম ‘সেভেনটিন’ কেন
ব্যান্ডের সদস্যসংখ্যা ১৩, কিন্তু নাম সেভেনটিন। অভিষেকের পর সেভেনটিনের এ নাম অনেকের কাছেই বিভ্রান্তিকর মনে হয়েছিল। তবে তাদের এ নামের পেছনে রয়েছে একটি গাণিতিক দর্শন। ১৭ সংখ্যাটিকে তারা ভাগ করেছে ৩ ভাগে। ১৩, ৩, ১; এদের যোগফল ১৭। এর মানে ১৩ জন সদস্য, ৩টি বিশেষায়িত বিভাগ (হিপহপ, ভোকাল, পারফরম্যান্স) মিলে ১টি দল। ব্যান্ডের হিপহপ বিভাগে রয়েছেন এস কুপস, উনউ, মিনগিউ, ভারনন। ভোকালে রয়েছেন উজি, জংহান, জোশুয়া, ডিকে, সোকওয়ান। কোরিওগ্রাফি ও পারফরম্যান্সে রয়েছেন হোশি, জুন, ডি এইট, ডিনো।
সেভেনটিনের আসল বিশেষত্ব ভারসাম্য। এ ব্যান্ডে কেউ গুরুত্বহীন নন। এই দলগত ভাগের ফলে দলের প্রত্যেক সদস্যের নিজস্ব বিশেষত্ব খুব সহজেই বোঝা যায়। শুরু থেকেই তারা যেন গণতান্ত্রিক দল! একটি ব্যান্ডের এ রকম বিভাগীয় গঠন ছিল কে-পপ ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন। এই পদ্ধতি কে-পপের প্রচলিত ‘টপ-ডাউন’ সিস্টেমের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়।
যত অর্জন
২০১৫ সালে আত্মপ্রকাশের পর থেকেই সেভেনটিন নিজেদের ‘সেলফ প্রডিউসিং আইডল’ হিসেবে পরিচিত করিয়েছে, যেখানে সদস্যরা নিজেরা গান লেখেন, সুর করেন ও কোরিওগ্রাফি করেন। তাঁরা তাঁদের বারবার ভেঙেছেন এবং প্রতিবার নিজেদের নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ‘ডোন্ট ওয়ানা ক্রাই’, ‘লেফট অ্যান্ড রাইট’, ‘রক উইথ ইউ’ ইত্যাদি গান।
অ্যালবাম বিক্রির দিক থেকেও সেভেনটিন অনন্য। ফেস দ্য সান, এফএমএল ও সেভেনটিন ইজ রাইট হিয়ার অ্যালবামগুলো কে-পপ ইতিহাসের অন্যতম সর্বোচ্চ বিক্রীত অ্যালবাম। বিশেষ করে এফএমএল ‘সবচেয়ে বেশি বিক্রীত কে-পপ অ্যালবাম’ হিসেবে অর্জন করেছে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড, যেটির বিক্রি ছাড়িয়েছে ৬২ লাখের বেশি।
আন্তর্জাতিক পুরস্কারেও সেভেনটিনের আধিপত্য স্পষ্ট। ২০২২ সালে তারা এমটিভি ভিডিও মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস থেকে ‘পুশ পারফরম্যান্স অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কারটি পায়, যা পশ্চিমা গণমাধ্যমে তাদের স্বীকৃতি এনে দেয়। একই বছর তারা এমটিভি ইউরোপ মিউজিক অ্যাওয়ার্ডসে পায় ‘বেস্ট পুশ অ্যাক্ট’ ও ‘বেস্ট নিউ আর্টিস্ট’ নামে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার। ২০২৩ সালে ব্যান্ডটি এশিয়া আর্টিস্ট অ্যাওয়ার্ডসের সর্বোচ্চ সম্মান ‘আর্টিস্ট অব দ্য ইয়ার’ লাভ করে, যাকে এশিয়া মহাদেশজুড়ে তাদের প্রভাব ও শৈল্পিক দক্ষতার স্বীকৃতি বলেও মনে করা হয়। ২০২৪ সালে তারা বিলবোর্ড মিউজিক অ্যাওয়ার্ডসে ‘টপ কে-পপ ট্যুরিং আর্টিস্ট’ হয়, যা বিশ্বমঞ্চে তাদের আধিপত্যের জানান দেয়।
শক্তি যখন ভক্তরা
শুধু দক্ষিণ কোরিয়াতেই নয়, সারা দুনিয়াতেই ব্যাপক জনপ্রিয় সেভেনটিন। ব্যান্ডটির ভক্তরা নিজেদের ‘ক্যারট’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। সেভেনটিন যেমন দর্শকদের পরিবার ভাবে, দর্শকেরাও তা–ই।
ইউটিউব সিরিজ গোয়িং সেভেনটিন বা ডেবিউ বিগ প্ল্যান ভক্তদের সঙ্গে একাত্ম থাকার জন্যই করা। ভক্তরা দেখেছেন তাঁদের হাসি, ঝগড়া, পরিশ্রম—সবকিছু। সোকওয়ানের হাস্যরস, জংহানের দুষ্টুমি, ডি এইটের দার্শনিক ভাব—সবই ভক্তদের চেনা। ফলে ব্যান্ডের চেয়ে তাঁরা মানুষ হিসেবে ভক্তদের কাছে বেশি প্রিয়, তাঁদের পরিবারের অংশ।
ভবিষ্যৎ মানে ‘পুরোনো আমরা’
বেশির ভাগ ব্যান্ড কয়েক বছর পরপর নিজেদের বদলে নতুনভাবে শুরু করতে চায়। অনেকে আবার পুরোনো গানেই আটকে থাকে। সেভেনটিন নিজেদের ধারা তৈরি করেছে, আবার তা ভেঙেছেও। তাদের সংগীতে এখন রয়েছে অলটারনেটিভ আরঅ্যান্ডবি, সিন্থ-পপ, অর্কেস্ট্রা ব্যালাড, এমনকি হাইপার পপ ধারাও। যেখানে অনেক জনপ্রিয় ব্যান্ড নিরীক্ষা করতে হোঁচট খাচ্ছে, সেখানে সেভেনটিন ঠিকই নিজেদের খুঁজে নিয়েছে। দ্বিতীয় দশকে পা দিয়ে তারা কে-পপের নিয়মই শুধু নতুন করে লিখছে না; বরং নিজেদের কাজ, শিল্প, সততা আর বন্ধুত্বের এক অন্য গল্প তৈরি করছে। তথ্যসূত্র: এনডিটিভি
Publisher & Editor