সদ্যঃপ্রয়াত মারিও বার্গাস য়োসার পছন্দের মানুষ বিভিন্ন জগতের অনেকেই নিশ্চয় ছিলেন। তবে এখানে লেখক য়োসার পছন্দের মানুষেরা সাহিত্যজগতের কারা ছিলেন শুধু সে বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আমাদের দৃষ্টি। তাঁর পছন্দের মানুষদের কারো কারো লেখা ও জীবনবোধ তিনি খুব নিবিড়ভাবে দেখেছেন। কারো কারো সঙ্গে সরাসরি দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে তাঁর। তাঁদের লেখালেখি ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়ও তিনি খুব কাছ থেকে পেয়েছেন। কয়েকজন তাঁর অগ্রজ; কয়েকজন তাঁর একেবারে সমসাময়িক। উইলিয়াম ফকনার, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, জাঁ পল সার্ত্রে, হোর্হে লুই বোর্হেস, পাবলো নেরুদা ও গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ছিলেন য়োসার কাছ থেকে দেখা মানুষদের কয়েকজন। খুব অল্প বয়স থেকে সার্ত্রের লেখা তিনি পড়েন।
সে সময় তাঁর মধ্যে সার্ত্রের জন্য একটা প্রবল টান অনুভব করেন। অবশ্য পরিণত বয়সে সার্ত্রের লেখা আগের মতো প্রবল আবেগ নিয়ে পুনরায় পড়ার মতো আগ্রহ বোধ করেননি। পরবর্তী সময়ে য়োসার মনে হয়েছে, সার্ত্রের কথাসাহিত্যের মূল্য একসময় যেমন ছিল, পরে তেমনটা নেই। আর তাঁর প্রবন্ধের মধ্যে দু-একটা ছাড়া বাকিগুলো য়োসার কাছে তাঁর কথাসাহিত্যের চেয়ে মানের দিক থেকে নিম্নতর মনে হয়েছে।
তাঁর কাছাকাছি সময়ের অগ্রজ আমেরিকান লেখকদের মধ্যে ফকনার, হেমিংওয়ে, ফিটজেরাল্ড প্রমুখের লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছেন। বেড়ে ওঠার সময় থেকে তাঁদের লেখা পড়েছেন; পরিণত বয়সেও তাঁদের লেখার প্রবল আবেদন য়োসার পাঠকমনে বিদ্যমান ছিল। ফকনারের লেখা পড়ার সময় তিনি কাগজ-কলম হাতের কাছে রাখতেন। কারণ ফকনারের শৈলী দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। ফকনারের শৈলী তিনি সচেতনে নিজের লেখার মধ্যে ব্যবহার করার চেষ্টাও করেন; বিশেষ করে কাহিনির মধ্যে বিভিন্নভাবে সময় ও স্থানের ছেদ ঘটানোর ওস্তাদি কৌশল রপ্ত করার চেষ্টা করেন।
ফকনারের আরেক কৌশল য়োসার পছন্দের ছিল—বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বয়ান তুলে ধরার শৈলী। তাঁর মতে, নির্দিষ্ট মাত্রার দ্যোতনা এবং অর্থের গভীরতা তৈরি করার জন্য ফকনার এই কৌশল অবলম্বন করেন। ফকনারের শৈলী তাঁর লেখার জন্য প্রয়োজন ছিল বলেই মনে করেন য়োসা; কারণ ফকনারের জগতের চেয়ে তাঁর জগৎ খুব বেশি ভিন্ন নয় বলে মনে করেন। য়োসার বারবার পড়া লেখকদের আরেকজন হলেন হেমিংওয়ে। ফকনারের মতো অতটা না পড়লেও হেমিংওয়ের লেখাও তাঁর পছন্দের ছিল। লেখার পদ্ধতি ও কৌশলের দিক থেকে হেমিংওয়ের সঙ্গে তাঁর নিজের অনেক মিলও দেখতে পেয়েছেন তিনি। হেমিংওয়ে দিনের শেষ মুহূর্তের লেখায় একটা বিশেষ কৌশল অবলম্বন করতেন—কোনো বাক্য অর্ধেকটা লিখে রেখে দিতেন, যাতে পরের দিন ঠিক ওখান থেকে সহজে শুরু করতে পারেন। মনের ভেতর যা আছে, সব লিখে ফেললে পরের দিন নতুন চিন্তা তৈরি করে শুরু করাটা কঠিন মনে হতো। য়োসার কাছেও সবচেয়ে কঠিন মনে হতো শুরু করাটা। তবে একবার শুরু হয়ে গেলে য়োসার লেখা চলতে থাকত এবং সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত তিনি লেখার টেবিলেই থাকতেন। এই সময়টা তাঁর কাছে পবিত্র সময় ছিল। হেমিংওয়ের সঙ্গে আরেকটা মানসিক মিল ছিল য়োসার। কোনো বই, কোনো বিশেষ লেখা শেষ করার পর হেমিংওয়ের মনের মধ্যে একই সঙ্গে শূন্য ও দুঃখের ভাব চলে আসত; আবার সন্তুষ্টির একটা ভাবও আসত। য়োসারও একই রকম অনুভূতি হতো; সন্তুষ্টির সঙ্গে শূন্যতাও আসত তাঁর মনে। শূন্যতার কারণ হলো, লেখা চলাকালে বইটা তাঁর সঙ্গীর মতো থাকত। শেষ হয়ে গেলে বইটা পর হয়ে গেল। অনেকটা পানাসক্ত ব্যক্তির মদ ছেড়ে দেওয়ার মতো মনে হতো তাঁর। এই অনুভূতি থেকে বাঁচার জন্য খুব তাড়াতাড়ি অন্য লেখা শুরু করতে হতো, যাতে মাঝখানে বিরাট কর্মহীন শূন্যতা তৈরি না হয়।
তাঁর খুব পছন্দের আরেকজন লেখক হলেন হোর্হে লুই বোর্হেস। তাঁর সঙ্গে সরাসরি দেখা-সাক্ষাৎও হয়েছে য়োসার। তাঁর মতে, বোর্হেস পুরোপুরি মৌলিক জগৎ তৈরি করেন তাঁর লেখায়। বোর্হেসের ভাষা এবং তাঁর কল্পনা সম্পর্কে য়োসার মুগ্ধতা ছিল বরাবরই। য়োসা মনে করেন, বোর্হেসের ভাণ্ডারে স্প্যানিস ভাষার যত শব্দ আছে, ঠিক সমপরিমাণ কল্পনা ও চিন্তা আছে তাঁর মধ্যে। তাঁকে সমসাময়িককালের সেরা লেখকদের একজন মনে করতেন য়োসা। বোর্হেসের সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হয়েছিল প্যারিসে, ষাটের দশকে। সেবার তিনি বোর্হেসের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। বোর্হেসের সঙ্গে সেই প্রথম দেখার মুগ্ধতা আগের মতোই ছিল য়োসার মনে। পরে পৃথিবীর বিভিন্ন জয়গায় বোর্হেসের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে। একবার দেখা হয়েছিল য়োসার নিজের দেশে। লিমায় সেবার তিনি বোর্হেসের জন্য ডিনারের ব্যবস্থা করেছিলেন। শেষবার দেখা হয়েছিল বোর্হেসের নিজের দেশে। বুয়েনস এইরেসে সেবার য়োসা বোর্হেসের আরেকটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। বোর্হেসকে শ্রদ্ধা করতেন, ভালোবাসতেন। লেখক হিসেবে তো অনেক ওপরে স্থান দিতেন য়োসা। তার পরও শুধু একটা কাঁটা রয়ে গিয়েছিল য়োসার মনে। বোর্হেসের বাড়িতে দেখা করার সময় য়োসা বোর্হেসের বাড়ির হতদশা দেখে কিছুটা করুণা করার মতো দু-একটা কথা বলেছিলেন। বিষয়টা বোর্হেসের ভালো লাগেনি। নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন য়োসা। কিন্তু পরে যে কয়েকবার দেখা হয়েছে, য়োসার মনে হয়েছে, আগের মতো আবেগী নৈকট্য মনে হয় নেই; কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তবে লেখক ও মানুষ বোর্হেসের জন্য শ্রদ্ধাবোধ অটুট ছিল তাঁর মনে।
তাঁর প্রিয় কবি পাবলো নেরুদাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন য়োসা। নেরুদাকে জীবন উপভোগ করার মতো দারুণ একজন মানুষ হিসেবেই দেখেছেন য়োসা। তাঁর জন্য পানাহার ছিল এক রহস্যময় অভিজ্ঞতা। প্রাণশক্তিতে ভরপুর পছন্দ করার মতো মানুষ হিসেবে দেখেছেন নেরুদাকে। ইসলা নেগ্রাতে একবার ছুটির দিনে গিয়ে চমৎকার অভিজ্ঞতা হয় য়োসার। তিনি দেখেছেন, নেরুদার চারপাশে লোকজনের অবাধ উপস্থিতি। মেহমান ছাড়াও রান্না করে দেওয়া এবং অনান্য কাজকর্ম করে দেওয়ার মতো লোকের অভাব নেই নেরুদার।
অসাধারণ প্রাণবন্ত এক সমাজ নেরুদার। সেখানে ভারী কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক আবহ তৈরি হওয়ার সুযোগ নেই। বোর্হেসের সঙ্গে প্রতিতুলনা টেনে নেরুদা সম্পর্কে য়োসা বলেন, জীবনে মদপান করেননি, ধূমপান করেননি, বেহিসাবি খাওয়াদাওয়া করেননি, এমনকি কোনো দিন শৃঙ্খলার বাইরে নারীসঙ্গ ভোগ করেননি যে বোর্হেস, তাঁর একেবারেই বিপরীত মানুষ ছিলেন নেরুদা। লন্ডনে একবার নেরুদার জন্মদিনের অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রসঙ্গ উঠলে নেরুদা ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, নৌকায় আয়োজন করা হোক। ইংরেজ কবি অ্যালাস্টেয়ার রিড ছিলেন নেরুদার ভক্ত। রিড তখন টেমস নদীতে নৌকায়ই থাকতেন। সুতরাং আয়োজন করতে কোনো অসুবিধা রইল না। সেদিন নেরুদা প্রস্তাব করলেন, ফলের রসসহ আরো কয়েক রকমের উপাদান মিশিয়ে একটা ককটেল বানাবেন। যেমন কথা তেমন কাজ। সেই ককটেল পান করে নৌকার সবাই মাতাল হয়ে গেলেন। সেই অবস্থায় য়োসা একটা পত্রিকা দেখালেন নেরুদাকে। এক সমালোচক য়োসাকে অপমান করে কথা বলেছেন। সেটা দেখে নেরুদা বললেন, ‘তুমি বিখ্যাত হয়ে গেছ, তারই প্রমাণ এটা। যত বেশি বিখ্যাত হবে, তত বেশি আক্রমণের শিকার হবে। একটা প্রশংসা পেলে দু-তিনটা আক্রমণ আসবে।’ নেরুদার সেই মন্তব্য সারা জীবন মহান সত্য বলে মেনেছেন য়োসা।
য়োসার আরেকজন কাছের মানুষ ছিলেন নোবেলজয়ী লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। তাঁর সম্পর্কে প্যারিস রিভিউ পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে য়োসা বলেন, ‘আমরা বন্ধু ছিলাম। বার্সেলোনায় থাকাকালে আমরা প্রতিবেশীও ছিলাম। একই রাস্তায় ছিল আমাদের আবাস। পরে আমাদের দূরত্ব বেড়েছিল ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে।’ তাঁদের বিশ্বাসের কারণে যতটুকু দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি হয়েছিল ব্যক্তিগত কারণে। তবে লেখক মার্কেসকে তিনি বরাবরই যথেষ্ট পছন্দ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার মতে, তাঁর লেখালেখি এবং তাঁর রাজনীতি এক মানের নয়। তাঁর লেখা আমার দারুণ পছন্দ। তাঁর বই সম্পর্কে আমি ছয় শ পৃষ্ঠারও বেশি লিখেছি।’ পরে ব্যক্তি মার্কেসকে আর তাঁর পছন্দের মধ্যে রাখেননি। মার্কেসের রাজনৈতিক মতাদর্শ য়োসার কাছে খুব সিরিয়াসও মনে হয়নি। লেখালেখির পদ্ধতিতে দুজনের মধ্যে খানিকটা পার্থক্য ছিল। মার্কেসের কাছে আকস্মিক পাওয়ার মতো দৈব একটা আলোকিত মুহূর্ত ছিল কোনো কোনো লেখার পেছনের শক্তি। য়োসার কাছে লেখার বিষয়টা প্রথমত ছিল সাধনার বিষয়; সেটা নিয়মানুবর্তিতার ওপর নির্ভর করত বেশি। লেখা শুরু হয়ে গেলে অবশ্য একটা শক্তি তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে বলে মনে হয়েছে। আগে থেকে যা পরিকল্পনায় রেখেছেন, সেটা আর আগের মতো থাকেনি। এ রকম ছিল তাঁদের দুজনের মধ্যে সাদৃশ্য আর বৈসাদৃশ্য।
সাহিত্যজগতেরই আরো অনেকের নৈকট্য পেয়েছেন য়োসা। তাঁর পরিণত বয়সে বেশি পড়েছেন উনিশ শতকের লেখকদের লেখা। ফ্লবেয়ার, তলস্তয়, বালজাক, দস্তয়েভস্কি, হথর্ন, ডিকেন্স, মেলভিল প্রমুখের সঙ্গ পেয়েছেন তাঁদের লেখার মাঝে। এ ছাড়া তাঁর পরিচিতির মধ্যে পেয়েছেন এবং লেখার সান্নিধ্য পেয়েছেন কার্পেন্তিয়ের, কোর্তাসার, লেজামা লিমা, সারমিয়েন্তো প্রমুখের।
Publisher & Editor