বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫

প্রতিবন্ধীরা কীভাবে ভোট দেবেন

প্রকাশিত: ০৩:১৩, ২২ এপ্রিল ২০২৫ | ৩৭

২০০৭ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারের কনভেনশন (সিআরপিডি) অনুমোদন করেছে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ চোখে পড়ে না। বিশেষত নির্বাচনী ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে ‘প্রতিবন্ধিতা’ বিষয়টি উপেক্ষিতই বলা চলে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ভোটব্যবস্থায় সংস্কার আনার কোনো প্রস্তাব আছে কি না, বুঝতে নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার কমিশনের ২০২৫ সালের প্রতিবেদনটি যতটা সম্ভব উল্টেপাল্টে দেখলাম। 

এবার প্রবাসী বাংলাদেশিরা কীভাবে ভোট দেবেন, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের এবং সরকার-সংশ্লিষ্টদের একাগ্রতা বেশ প্রশংসনীয়। নারী ও প্রবাসী ভোটাধিকারে দীর্ঘ অধ্যায় আলোচনাও রয়েছে। কিন্তু নির্বাচনকে প্রতিবন্ধীবান্ধব করার জন্য সমান চেষ্টা বা উদ্যোগের দেখা মেলেনি এই প্রতিবেদনে। 

২০১৮ সালের নির্বাচন-পরবর্তী ভোটার অংশগ্রহণ মূল্যায়ন বিষয়ে নির্বাচন কমিশন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, নির্বাচনটি জাল-জালিয়াতির হলেও প্রতিবেদনটিতে অন্তত ‘প্রতিবন্ধী ভোটার’ বিষয়ে কিছু তথ্য দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ রয়েছে, দেশের ৩০ লাখের বেশি প্রতিবন্ধী ভোটার রেজিস্ট্রারে নাম লিখিয়েছেন। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে ১০ শতাংশের কম প্রতিবন্ধী নাগরিক ভোট দিয়েছেন। তৎকালীন সরকার এ তথ্য সঠিক দাবি করলেও প্রশ্ন করা যেত, ৯০ ভাগ ভোটারই কেন ভোট দিল না বা দিতে পারল না? কী এবং কতটা প্রতিবন্ধীবান্ধব ভোট ব্যবস্থাপনা বা পরিকল্পনা ছিল? এবারও প্রশ্ন একই—আগামী নির্বাচনগুলোকে প্রতিবন্ধীবান্ধব করার কী কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? 

গত দুটি নির্বাচনে জনগণই ভোট দিতে পারেনি, প্রতিবন্ধীদের জন্য সহজ ভোটদানপদ্ধতির চিন্তাভাবনা দূরকল্পনাই ছিল। ২০০৮-এর নির্বাচনেও প্রতিবন্ধীদের ভোট দিতে না যাওয়ার বিষয়ে অনেক আক্ষেপের কথা শুনেছিলাম। একটি তিনতলা স্কুল কেন্দ্রের ভোট ব্যবস্থাপনা নিয়ে শোনা প্রতিবন্ধী অভিজ্ঞতার বয়ান মনে পড়ছে। বয়োবৃদ্ধ, অসুস্থতার কারণে চলনশক্তিহীন ও প্রতিবন্ধীরা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে যাতে কষ্ট না পান, সে জন্য আলাদা ব্যবস্থা ছিল। স্কুলঘরের তৃতীয় তলাটি তাঁদের জন্য নির্ধারিত। কারণ, নিচের দোতলায় দারুণ ভিড়ভাট্টা ও হইহল্লা হতে পারে। কিন্তু তিনতলায় ওঠার জন্য লিফট নেই, সিঁড়ি সরু, খাড়া ও অপ্রশস্ত। দুজন মানুষ পাঁজাকোলা করে একজন বয়োবৃদ্ধকে ওপরে তুলতে পারবেন—এমন অবস্থাও একেবারেই অনুপস্থিত। ভাবুন তো, কতটা সংবেদনহীন হলে এ রকম ‘প্রতিবন্ধীবান্ধব’ নির্বাচন ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা করা যায়! 

গত এক দশকে বাংলাদেশের নির্বাচনীব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে আন্তর্জাতিক নানা সংস্থা প্রশ্ন তুলেছে। কিন্তু এসব আলোচনায়ও প্রতিবন্ধিতার মতো গুরুতর বিষয়টি মোটাদাগে প্রায় উপেক্ষিতই থেকেছে। অপ্রিয় সত্য হলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নির্বাচন–ভাবনা ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে অনেকটা বিযুক্তই রাখা হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে ভোটাধিকার থাকা সত্ত্বেও তাঁরা ভোট দিতে পারছেন না, কারণ কি শুধুই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, নাকি নির্বাচনপদ্ধতি, নীতিনির্ধারকদের অবহেলা বা উদাসীনতাও একটি বড় কারণ? 

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনটিকে দীর্ঘদিনের বৈষম্য দূর করার এক মোক্ষম সুযোগ ভাবা দরকার। শুধু মুখে ‘ইনক্লুসিভ’ নির্বাচন’ বললেই তো হলো না! ‘ইনক্লুসিভ’ শব্দের ভুল ব্যাখ্যাও বিপজ্জনক রকম বাড়ছে। ‘ইনক্লুসিভ’ বা ‘অংশগ্রহণমূলক’ বলতে শুধু যেন আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া বোঝায়। কিন্তু শব্দটির মূল অর্থ, সব বাদ পড়া, বিপন্ন, প্রান্তিক বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা। যেমন শারীরিক চলাচলে অক্ষম, প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গ ও অসমলিঙ্গ জনগোষ্ঠী। তাঁদের ভোটের অধিকারও সমান। 

সারা দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো জরুরি। ভোটার, নির্বাচন কর্মকর্তা, রাজনৈতিক দলসহ সবার মাঝে। এভাবে এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের মানসিক জড়তা বা সামাজিক বৈষম্য দূর করা সম্ভব। সর্বশেষ এই কাজগুলো কতটা কার্যকর হচ্ছে, তা পর্যালোচনার জন্য একটি স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন কাঠামো থাকতে হবে। নির্বাচনের পর প্রতিবন্ধী ভোটারদের অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করে সমস্যাগুলো শনাক্ত করতে হবে। 

আসলে শারীরিকভাবে বিপন্নদের ভোটাধিকার কাজির গরুর মতো কাগজ-কলমে থাকলেও গোয়ালে নেই। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চর্চা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে নানা বিতর্ক চলছে। ভোট কারচুপি, সহিংসতা, ভয়ভীতি—এসব বিষয় নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবন্ধী ভোটারদের ভোটাধিকার নিয়ে পাবলিক ফোরামে কখনো কোনো আলোচনা কি শোনা গেছে? যায়নি।  

এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি), ফ্রিডম হাউস এবং ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইলেকটোরাল সিস্টেমসের (আইএফইএস) রিপোর্টগুলো দেখেছি। সেগুলোতে প্রতিবন্ধীদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার উল্লেখ আছে। গণতান্ত্রিক অধিকারের লঙ্ঘন উল্লেখ করা হয়েছে। বর্ণনা আছে যে ভোটকেন্দ্রগুলোর অধিকাংশই এমনভাবে তৈরি, যেখানে র‍্যাম্প নেই, দরজাগুলো সরু, ব্রেইল সামগ্রী অনুপস্থিত। ফলে হুইলচেয়ারে থাকা ব্যক্তিরা বা দৃষ্টিহীন ভোটাররা একেবারেই অংশ নিতে পারেন না। 

প্রতিবন্ধীদের ভোট থেকে বাদ পড়ার মূল কারণ দুটি। এক, ভোটকেন্দ্রগুলোর কাঠামোতেই তাঁরা প্রবেশ করতে পারেন না; দুই, যেসব আইন তাঁদের অধিকার নিশ্চিত করার কথা, সেগুলোর কার্যকর প্রয়োগ নেই। 

২০১৩ সালের ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন’ এই জনগোষ্ঠীর ভোটাধিকারের কথা বললেও, এটি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে আইনি স্বীকৃতি থাকলেও বাস্তবসম্মত কোনো পদক্ষেপ নেই। আরও দুর্ভাগ্যজনক হলো, নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে যত আলোচনা হয়, তার কোনোটাতেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিনিধি বা সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্ত করা হয় না। ২০১৪ সালের পর থেকে চলা প্রতিটি আলোচনায় তাদের অংশগ্রহণ ছিল শূন্য। ফলে তাঁরা যেমন নীতিনির্ধারণে দাবি জানাতে পারছেন না, তেমনি তাঁদের সমস্যার কোনো সুনির্দিষ্ট সমাধানও হচ্ছে না। 

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে উন্নত নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শেখার চেষ্টা এবং পরামর্শ এবারের সংস্কার প্রতিবেদনের একটি ইতিবাচক দিক। কয়েকটি দেশের অভিজ্ঞতার উল্লেখও রয়েছে। কিন্তু উল্লেখ নেই যে দেশগুলো দেখিয়েছে, কীভাবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা যায়। ভারতের ‘অ্যাক্সেসিবল ইলেকশন’ উদ্যোগ, মেক্সিকোর ‘মোবাইল ভোটিং ইউনিট’, অস্ট্রেলিয়ার ব্রেইল, অডিও ও সহায়ক ভোটিং ব্যবস্থা—এসব উদাহরণ চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, কীভাবে সামান্য উদ্যোগেই প্রতিবন্ধীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব। 

এখনই সময় পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়ার। যদি সত্যিকারের ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ চাই, তাহলে নিশ্চিত করতে হবে সব ভোটকেন্দ্র যেন শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধীদের জন্য সহজগম্য হয়। র‍্যাম্প, চওড়া দরজা, ব্রেইল ব্যালট, হুইলচেয়ার সহায়তা—এসব বাধ্যতামূলক করতে হবে। পরবর্তী ধাপে, নির্বাচনী আইনে স্পষ্টভাবে প্রতিবন্ধীদের অন্তর্ভুক্তির বিধান যুক্ত করতে হবে। নির্বাচন কমিশন ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মধ্যে প্রতিবন্ধী প্রতিনিধি রাখতে হবে। 

এ ছাড়া সারা দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো জরুরি। ভোটার, নির্বাচন কর্মকর্তা, রাজনৈতিক দলসহ সবার মাঝে। এভাবে এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের মানসিক জড়তা বা সামাজিক বৈষম্য দূর করা সম্ভব। সর্বশেষ এই কাজগুলো কতটা কার্যকর হচ্ছে, তা পর্যালোচনার জন্য একটি স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন কাঠামো থাকতে হবে। নির্বাচনের পর প্রতিবন্ধী ভোটারদের অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করে সমস্যাগুলো শনাক্ত করতে হবে। 

২০২৫ বা ২০২৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আমরা এখনই যদি পরিকল্পনা না করি, তবে আবারও একটি বিশাল জনগোষ্ঠী ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। এই অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নটা শুধু আইনি বাধ্যবাধকতার নয়। এটি ন্যায়বিচার, সম্মান এবং প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রশ্ন। ভোট দিতে পারা কারও দয়ার বিষয় নয়। এটি নাগরিক অধিকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশন বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এখন থেকেই একটি সুস্পষ্ট, বাস্তবমুখী, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনী রোডম্যাপ তৈরি করুক। ভোট হোক সত্যিকার অর্থেই সবার জন্য ‘ইনক্লুসিভ’! 

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor