বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আইরিন

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ৩১ আগস্ট ২০২৪ | ৫৮

বিখ্যাত লেখক কায়েস কায়সার সাহেব বসে আছেন আমার ড্রয়িংরুমে। তিনি আইরিনকে নিতে এসেছেন।

আমি রীতিমতো তাঁর কাছ থেকে পালিয়ে এই ঘরে চলে এসেছি। নিজের বাড়িতে বসে নিজেকেই পালাতে হবে ভাবতেও পারিনি।

তাঁর মতো ব্যক্তির কাছে আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। যদি বলি আইরিন এখনো আসেনি বা আইরিন এখানে নেই—কোনোভাবেই বিশ্বাস করানো যাবে না তাঁকে। আমি এ রকম এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যাব, ভাবতেই পারিনি। আর তিনিও নিশ্চিত না হয়ে আসেননি এখানে।

তাঁর মতো ব্যক্তিত্ব বলে কথা।
কিন্তু আমি কী করতে পারি? চা-নাশতা দেওয়ার নাম করে তাঁর সামনে থেকে সরে আমার ঘরে এসে বসে বসে এসব ভাবছি। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ! আমি তো তাঁকে এক ঘণ্টা এভাবে বসিয়ে রাখতে পারব না। কাজের বুয়া তাঁকে চা-নাশতা দিয়ে গেল।

আমি ঘর থেকে লক্ষ্যৎ করলাম—কায়েস কায়সার সাহেবের সেদিকে মন নেই। তিনি ড্রয়িং ত্রুমে বসে কী যেন খুঁজছেন।
তিনি খুব বিরক্ত মুখে একটা বিস্কিট হাতে নিয়ে মুখের কাছে নিয়ে গেলেন। কিন্তু কী ভেবে তা খেলেন না। রেখে দিলেন।

লেখক মানুষ তো। কখন কী ভাবেন বলা যায় না। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিলেন।
তাঁর মোবাইল ফোন বেজে উঠল। তিনি হাতে নিয়ে নামটা দেখলেন। তারপর পকেট হাতড়াতে লাগলেন। পাঞ্জাবির বাঁ পকেট থেকে হেডফোন বের করে কানে লাগানের চেষ্টা করলেন। কিন্তু হেডফোনের যা স্বভাব আর কি—খালি জট লেগে যাওয়া। কায়েস কায়সার সাহেব সেই জট খুলে কানে লাগাতে না লাগাতেই ফোন কেটে গেল। তিনি কান থেকে হেডফোন খুলে ফেললেন। তখনই আবার ফোন বেজে উঠল। এবার আর দেরি হলো না। হেডফোন কানে লাগিয়ে হাসি হাসি মুখে স্নিগ্ধ স্বরে বললেন, ‘হ্যালো।’

এরপর চায়ের কাপে আবার চুমুক দিলেন।

তিনি কিছু বলছেন না, তিনি শুধু শুনে যাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে হ্যাঁ-হু করছেন। আমি একটু স্বস্তি পাচ্ছি এই ভেবে যে কিছুটা সময় পাওয়া যাচ্ছে।

কিন্তু এভাবে কতক্ষণ! চায়ের কাপ খালি হয়ে যাবে, কথা বলাও শেষ হবে—তখন তিনি তো আর চুপচাপ বসে থাকবেন না। ভদ্রতা করে না হয় এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিলেন। এরপর তো ডাকাডাকি শুরু করবেন। আর এতক্ষণ সরে থাকাটাও তো আমার জন্য অভদ্রতা। কিন্তু বিখ্যাত লেখক কায়েস কায়সার সাহেবকে আমি কী বলব। যতই বলি আইরিন আমার কাছে নেই, তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করবেন না।

কথা শেষ হলো। চা শেষ হলো কি না বোঝা গেল না। কায়েস কায়সার সাহেবকে এবার গম্ভীর দেখাচ্ছে। বিরক্ত হচ্ছেন বুঝি! আর দেরি করা ঠিক হবে না। আমি খুব জড়সড় হয়ে তাঁর সামনে গিয়ে উত্ফুল্ল হওয়ার চেষ্টা করলাম, ‘স্যরি স্যার, আমি খুব দেরি করে ফেললাম।’

কায়েস কায়সার সাহেব কিছু বললেন না। তাঁকে এখন খুব গম্ভীর দেখাচ্ছে। গাম্ভীর্য নিয়ে তিনি আমার দিকে তীক্ষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তিনি আসলে কী বোঝাতে চাইলেন ঠিকঠিক বুঝতে পারলাম না। আমার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। কিন্তু বাইরে আমি খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলাম।

‘আপনার বাসায় কোনো বইপত্র নেই কেন?’ প্রশ্নবোধক ও কৌতূহলের দৃষ্টি দিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন আমাকে।

প্রশ্নটা আমাকে একটু স্বস্তি দিল। কারণ তিনি আইরিনকে নিয়ে প্রশ্ন করেননি। এভাবেও যদি তাঁকে কিছুক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা যায়। আমি বললাম, ‘স্যার, এখানে বইপত্র রাখলে চুরি হয়ে যায়। তাই রাখি না। অন্য ঘরে আছে। দেখবেন?’

বই দেখানোর অছিলায় আরেকটু সময়ক্ষেপণ করা যায় যদি, মন্দ কী? এর মধ্যে অন্য একটা বিষয় ঢুকে পড়বে নিশ্চয়ই। তখন সেটা নিয়ে খেলা যাবে। আপাতত বই নিয়ে খেলি।

কায়েস কায়সার সাহেবকে চুপচাপ দেখে আমি আবার বললাম, ‘স্যার, বই দেখবেন?’

তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বুঝলাম বইঘরে যেতে হবে এখন। উঠে দাঁড়ানোর পর লক্ষ করলাম তাঁর শরীর থেকে খুব সুবাস বের হচ্ছে। দামি পারফিউম নিশ্চয়। নাকি তাঁর সৃজনশীল লেখাগুলোর সুবাস! লেখক মানুষ যে! সৎ ও সৃজনশীল মানুষদের শরীরে ও মনে এক ধরনের সুবাস থাকে। ভালোভাবে লক্ষ করলে টের পাওয়া যায়। অসৎ মানুষেরা ওই সুবাস কোনো দিনই পান না। তাঁরা দুর্গন্ধ পান। আমি সুবাস পেলাম। এখন নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি। আমি কি সৎ মানুষ? একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বের হয়ে এলো বুকচিরে। আমি সে দীর্ঘনিঃশ্বাসকে হ্রস্বে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করলাম।

বইঘরে নিয়ে গেলাম তাঁকে। তিনি বুকশেলফ ও আলমিরায় চোখ বোলালেন। তারপর মুভি ক্যামেরার মতো আমার মুখের দিকে এসে তাঁর নজর তাক করালেন। বললেন, ‘তুমি তো বই পড়ো না। তাহলে কিনেছ কেন এত বই?’

আমি কোনো উত্তর দিই না। তিনি পরক্ষণেই উত্সুক হয়ে সহাস্য জিজ্ঞেস করলেন, ‘আইরিন পড়ে?’ কায়সার সাহেবের চোখে ইষৎ কৌতুকও খেলা করছে দেখছি। আমি কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই তিনি এক গভীর নিঃশ্বাস বুকের ভেতরে টেনে নেন। কায়সার সাহেবের উপস্থিতিতেই কি না জানি না, ঘরটা আলোকিত হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, ‘আমি আইরিনের শরীরের সুবাস পাচ্ছি। তাই ভেতরে একটু রেখে দিলাম।’

আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি।

তিনি আবার সোফায় এসে বসেন। এবার সরাসরি বলেন, ‘কিন্তু আইরিন কোথায়। তাকে দেখছি না কেন? আমি আইরিনকে নিয়ে যেতে এসেছি।’ বলেই তিনি আশপাশে তাকাতে লাগলেন। তিনি তাঁর সব জড়তা ভেঙে ফেলে স্পষ্ট করে তাঁর মনের ইচ্ছার কথা বললেন।

আইরিন এখন আমার কাছে নেই—এ কথা বলতে যাব আমি। কিন্তু কথাটি মুখ থেকে বের হয় না। জড়তা, দ্বিধা, শঙ্কা ইত্যাকার সব বাধা এসে আমাকে বিহ্বল ও বিপর্যস্ত করে। বিখ্যাত লেখক কায়েস কায়সারের দৃষ্টিতে তা এড়ায় না। তিনি স্পষ্ট করে কিছুটা ধমকের সুরে আমার চোখের ওপর তার তীক্ষ চোখ রেখে বলেন, ‘দেখো, মিথ্যা বলার চেষ্টা করবে না। আইরিন তোমার কাছেই আছে। আমি যথেষ্ট নিশ্চিত না হয়ে এখানে আসিনি।’

আমি ধপাস করে সোফায় বসে পড়ি। খুব বিহ্বল বোধ করতে থাকি। আমি আইরিনকে এখন কোথায় পাব। আইরিন তো এখানে নেই। এত বড় বিখ্যাত লেখক তা বুঝতে পারছেন না কেন?

কায়েস কায়সার সাহেব বোধ হয় আমার ভাবনা পড়ে ফেলেন। লেখক মানুষ তো! তিনি বলেন, ‘কী ভাবছ তুমি। আইরিন থাকলে এতক্ষণে দেখা হয়ে যেত। সুতরাং আইরিন এখানে নেই। এই কথা আমি বুঝতে পারছি না কেন?’

আমি বলতে যাব স্পষ্ট করে কথাটা। কারণ এখন স্পষ্ট করে না বললে লেখক সাহেবকে থামানো যাবে না। কিন্তু তিনি আমাকে সে কথাও বলতে দেন না। তিনি স্পষ্ট করে খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন,  ‘তুমি কী বলবে তা আমি জানি। বলবে আইরিন এখন কেউকেটা কারো সঙ্গে আছে। তাই না? কিন্তু আমাকে এ কথা বলে তো লাভ হবে না।’

‘তোমার বাসায় আর কেউ থাকে না? শুধু তুমি আর আইরিন?’

আমি তাঁর মুখের দিকে নির্বাক চেয়ে থাকি। বলতে পারি না যে আইরিন আমার কাছে নেই। গত পরশু দিন একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি তাকে নিয়ে গেছে। তার পর থেকে তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। কোথায় আছে, কেমন আছে জানি না। এর মধ্যে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি আমাকে বলেছেন আইরিনকে তাঁরা চান। কিন্তু আমি কিভাবে তাঁদে বোঝাব।

অনেকেই তো আইরিনকে চায়। কিন্তু আমি কী করতে পারি। আজ লেখক সাহেব এসেছেন আইরিনকে নিতে।

লেখক সাহেব বললেন, ‘তুমি অনেক ক্ষমতাবান। কারণ তোমার সঙ্গে একজন আইরিন আছে। প্রশ্ন করতে পারো আমি কি ক্ষমতাবান হতে চাই? সে জন্য আইরিনকে নিতে এসেছি?’

লেখক সাহেব আবারও শুরু করেন, ‘আমি আসলে আইরিনকে নিতে এসেছি অন্য কারণে। তুমি জানো আমি লেখালেখি করি। এই সময়ে আমি কিছু গল্প লিখছি। সবগুলো গল্পই প্রতীকী। কিন্তু লেখার পর কোনো গল্পই খুঁজে পাচ্ছি না। কম্পিউটারে লিখলে পরদিন দেখি সবগুলো লেখা ডিলিট হয়ে যাচ্ছে। কাগজে লিখলে কাগজ উধাও। এখন একদম উপায়হীন হয়ে তোমার কাছে আসা। বলো তো কী করি আমি?’

লেখক সাহেবের কণ্ঠ একটু নরম হয়ে এলো বোধ হয়, চোখ দুটো ছলোছলো। আমার দুই চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। লেখক সাহেব আমার দিকে নরম দৃষ্টিতে তাকালেন এবার। আমি সোজা হয়ে বসলাম। এতক্ষণে যেন আমার আত্মবিশ্বাস ফিরে এলো। তাঁর চোখে চোখ রেখে বললাম, ‘স্যার, আসলে আইরিন বলে কেউ নেই।’

লেখক সাহেব নির্বাক হয়ে গেলেন। তাঁর চোখ নিষ্পলক হয়ে গেল। তিনি স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

আমি বললাম, ‘স্যার, আইরিন বলে কেউ নেই। আমি শুধু এটুকু জানি, আইরিন বলে কেউ নেই।’

‘তাহলে তোমার কাছ থেকে অন্যরা আইরিনকে নিয়ে যায় কিভাবে?’

‘একটা শিকল নিয়ে যায় শুধু। বলে দিই তাঁদেরকে, ‘এই শিকলের অগ্রভাবে আইরিন আছে। মাঝেমধ্যে ঘেউ ঘেউ করবে। সেভাবেই সে তার অস্তিত্ব জানান দেবে। আমাকে বিনিময়ে টাকা দেয় তারা- ভাড়া হিসেবে। আইরিন তাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রদান করে। তারা সবাই খুশি। এযাবৎ একজনেরও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়নি। কারো উদ্দেশ্যও ব্যর্থ হয়নি। সবার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।’

লেখক সাহেব চুপ করে আছেন। মাথা একটু নিচু। তিনি এখন কী ভাবছেন বুঝতে পারছি না। তিনি আমার কথাগুলোকে নিয়েছেন কি না তাও বুঝতে পারছি না। তাঁর চুপ করে থাকা দেখে আমি আবার বলা শুরু করি, ‘তবে কিছুদিন হলো কিছু অভিযোগ পাচ্ছি। আইরিন নাকি তাদের অনেক কিছুই খেয়ে ফেলছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু। তারা আমার কাছে অভিযোগ করছে। ক্ষতিপূরণ চাচ্ছে। হতে পারে আপনার লেখাগুলোও হয়তোবা আইরিনই খেয়ে ফেলছে।’

‘এ জন্যই আমার আইরিনকে দরকার।’

আমি এবার উঠে দাঁড়িয়ে কায়েস কায়সার সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়ালাম। একটু উচ্চৈঃস্বরে বললাম, ‘না। আপনার কোনো আইরিনকে দরকার নেই। আইরিনকে দিয়ে কোনো কিছু রক্ষা করা যায় না।’

আমার কথা এখানেই থেমে গেল। আমি আর বেশি কিছু বলতে পারলাম না। আসলে এর বেশি কিছু বলার মতো নেই আমার। লেখক সাহেবও ব্যাখ্যা করলেন না। কারণও জানতে চাইলেন না তার লেখাগুলো তাহলে কিভাবে অদৃশ্য হওয়া থেকে রক্ষা পাবে।

যাওয়ার সময় সেই ঘরে তাঁকে নিয়ে গেলাম। যেখানে আইরিন নামের এক অদৃশ্য কুকুর রাখতাম আমি। সে অদৃশ্য কুকুরকে কেউ কেউ ভাড়া করে নিয়ে যেতেন তাঁদের নিরাপত্তার জন্য। আবার কেউ নিয়ে যেতেন ক্ষমতাবান হওয়ার জন্য। বিনিময়ে আমাকে টাকা দিতেন।

অদৃশ্য সে কুকুরের একটা শিকল পড়ে ছিল ওই ঘরে। লেখক সাহেব সে শিকল হাতে নিলেন। তারপর টান দিতে থাকলেন। দেখা গেল সেগুলো তেমন শক্ত নয়। তিনি এক-একটা টান দেন একটা অংশ খুলে আসে। আবার টান দেন খুলে আসে। অনেকটা চিরুনির দাঁতের ভেতর থেকে যেভাবে চুল পরিষ্কার করা হয় সেভাবে আর কি।

তিনি সবগুলো শিকল খোলার পর একটা ঘরের এক কোনায় ছুড়ে মারলেন। ঘর থেকে বের হয়ে তালা দিলেন। চাবিটা নিয়ে চলে গেলেন ওয়াশরুমে। কমোডের ভেতরে চাবিটা ফেলে দিয়ে ফ্লাশ করলেন।

যেতে যেতে বললেন, ‘সুবাস পাচ্ছ তুমি? আইরিন নামের কুকুরের নয়, আইরিন ফুলের?’

আমি সায় দিলাম মাথা নেড়ে। বললাম, ‘পাচ্ছি।’

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor