২০২৩ সালের নভেম্বর। সেদিন ছিল শুক্রবার। কলাবাগানে নিজের বাসাতেই ছিলেন ৪৭ বছর বয়সী প্রকৌশলী শাহরিয়ার কবীর। নিজের মেয়েদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলেন। হঠাৎ অবশ হয়ে যায় তাঁর শরীরের এক পাশ। কথাও বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর স্ট্রোক হয়েছিল। আজ বিশ্ব স্ট্রোক দিবসে পড়ুন শাহরিয়ার কবীরের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার গল্প।
শাহরিয়ারের স্ত্রী আসমা-উল হুসনা ঘরে ঢুকে দেখেন, ছটফট করছেন শাহরিয়ার। বাঁ হাতে ফোন নিয়ে ফ্রন্ট ক্যামেরায় নিজেকে দেখার চেষ্টা করছেন; কিন্তু কিছুই বলছেন না। তখনো বিষয়টা বুঝে উঠতে পারছিলেন না আসমা। তবে শাহরিয়ার সম্ভবত বুঝেছিলেন, তাই দেখতে চেষ্টা করছিলেন তাঁর মুখটা বেঁকে গেছে কি না। ডান পাশটা অবশ হয়ে যাওয়ায় ব্যবহার করেছিলেন বাঁ হাত। তবে সেই সময়ের কথা এখন আর শাহরিয়ারের মনে নেই।
দ্রুত শুরু হলো স্ট্রোকের চিকিৎসা
শাহরিয়ারের ভাইকে দ্রুত খবর দেওয়া হলো। তিনি এসে হুইলচেয়ারে করে ভাইকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। বাসার খুব কাছেই স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেড। সেখানকার জরুরি বিভাগে যাওয়ার পর জানা গেল, শাহরিয়ারের স্ট্রোক হয়েছে। মস্তিষ্কের রক্তনালির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে এই স্ট্রোক হয়।
স্ট্রোকে অবশ হয়ে যাওয়া দেহে আগের মতো শক্তি ফিরে পাওয়াটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। বছরের পর বছর বিছানায় পড়ে থাকেন বহু রোগী। কথা বলার ক্ষমতাও অনেকের থাকে না। দীর্ঘ মেয়াদে দেখা দিতে পারে নানান জটিলতা। তবে স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসা রয়েছে। এই চিকিৎসাপদ্ধতির নাম থ্রম্বোলাইসিস। সঠিক সময়ে থ্রম্বোলাইসিস করা হলে জটিলতা অনেক কমে যায়। সহজে সুস্থ হয়ে ওঠেন রোগী। তবে সব হাসপাতালে থ্রম্বোলাইসিসের সুযোগ নেই। আর অন্যান্য চিকিৎসার মতো এরও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয় থাকে। তাই সব দিক ভেবেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। একদিকে সুস্থতার আশা, অন্যদিকে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা। দ্রুততম সময়ে নিউরো আইসিইউতে নেওয়া হলো শাহরিয়ার কবীরকে। করা হলো থ্রম্বোলাইসিস।
চিকিৎসার বাকি ধাপ
থ্রম্বোলাইসিস হয়ে যাওয়ার পর নিউরো আইসিইউতে নিবিড় পর্যবেক্ষণ শেষে তাঁকে কেবিনে আনা হলো। শুরুর দিকে নলের মাধ্যমে নাক দিয়ে খাওয়ানোর প্রয়োজন হলেও পরে মুখেই খেতে পারছিলেন তিনি। স্ট্রোকের সাত দিন পার হয়ে যাওয়ার পর ফিজিওথেরাপির নির্দেশনা দিয়ে তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হলো। পরদিন ভর্তি করা হলো মিরপুরের সেন্টার ফর রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজডে (সিআরপি)। কোনো কোনো দিন সেখানকার বারান্দার গ্রিল ধরে নিজেই হুইলচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান। একটু একটু করে তাঁর উন্নতি হতে থাকে। কথা বলার শক্তি ফিরতে থাকে। কোনো কোনো দিন অবশ হাত দিয়েই চলে খাওয়ার চেষ্টা। ৪২ দিন পর বাড়ি ফিরলেন শাহরিয়ার। বাসায় ফেরার পরও মিরপুরের ফিজিওকেয়ার সেন্টারে গিয়ে ফিজিওথেরাপি নিয়েছেন বেশ কিছুদিন। স্ট্রোক হওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই মোটামুটি সুস্থ হয়ে যান তিনি।
এখন কেমন আছেন
হাঁটাচলা বা কথা বলায় আর সমস্যা নেই। তবে শাহরিয়ার নিজেই বলছিলেন, ‘স্ট্রোকের পর থেকে আমি অল্পতেই রেগে যাই। কথা বলতে ভালো লাগে না। প্রকৌশলবিদ্যার মূল বিষয়গুলো ভুলে গেছি। আগে আমিই আমার মেয়েদের বিজ্ঞান ও গণিত দেখিয়ে দিতাম। এখন সেটি আর পারছি না।’
এ বিষয়ে হাসপাতালটির নিউরোমেডিসিন বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. রমা বিশ্বাস জানান, স্ট্রোকের পর কারও কারও এ ধরনের সমস্যা হতে পারে। তবে সময়ের সঙ্গে এসব সমস্যাও সেরে যায়।
সময়টাই দামি
ডা. রমা বিশ্বাস বলেন, ‘স্ট্রোক হলে প্রতি মিনিটে ১.৯ মিলিয়ন নিউরন অর্থাৎ স্নায়ুকোষের মৃত্যু হতে থাকে। তাই স্ট্রোকের রোগীদের জন্য সময়টাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। উপসর্গ দেখা দেওয়ার সাড়ে তিন ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে আনা হলে থ্রম্বোলাইসিস করার সুযোগ থাকে। এবারের স্ট্রোক দিবসের প্রতিপাদ্য ‘এভরি মিনিট কাউন্টস’, অর্থাৎ ‘স্ট্রোকের কোনো উপসর্গ দেখা দিলে একমুহূর্তও নষ্ট করার সুযোগ নেই।’
সঠিক সময়ে স্ট্রোকের চিকিৎসা করানো হলে বেঁচে যায় প্রাণ। এড়ানো যায় বহু অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতা।
Publisher & Editor