কাজী নজরুল ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ ‘চিত্তনামা’ চলতি বছর শতবর্ষ পার করতে যাচ্ছে। ১৯২৫ সালের ঠিক এই আগস্ট মাসে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ ১৯২২ সালে প্রকাশের পরে এটি ছিল পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ। একই সঙ্গে বছরটি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশেরও মৃত্যুশতবর্ষ।
গ্রন্থটি লেখার মাত্র মাসখানেক আগে—মে মাসে চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে কবির দেখা হয়েছিল ফরিদপুর কংগ্রেসের সম্মেলনে। একই বছরের জুন মাসে দেশবরেণ্য এই নেতা দার্জিলিংয়ে আকস্মিকভাবে মারা যান। সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। শোকাহত রবীন্দ্রনাথ তাঁর মৃত্যুতে লেখেন, ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।
নজরুল ইসলাম তাঁর জীবনের মাত্র দুই দশকের সাহিত্য সাধনায় ষাটের অধিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, বহু বরেণ্য নেতা ও সুহৃদকে নিয়ে অনেক গদ্য-পদ্য রচনা করেছিলেন; কিন্তু সমকালীন কোনো ব্যক্তির নামে সরাসরি কাব্যগ্রন্থ এটিই একমাত্র। যদিও এই গ্রন্থ প্রকাশের বছরখানেক আগে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মারা গেলে তিনি ‘আশুপ্রয়াণ গীতি’ নামে একটি কোরাস কবিতা রচনা করেন, যেটি কবির ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কবি এক ডজন কবিতা রচনা করলেও আলাদা কোনো বই করেননি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিখ্যাত ‘ভাঙার গান’ গীতিকবিতাটিও লেখা হয়েছিল চিত্তরঞ্জন দাশকে উপলক্ষ করে, দেশবন্ধুর মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগে।
শতবর্ষে জাতীয় কবির চিত্তনামা১৯২১ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার চিত্তরঞ্জন দাশকে কারাগারে পাঠালে তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবীর অনুরোধে নজরুল ইসলাম ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট’ গানটি রচনা করেন। ১৯২২ সালের ২০ জানুয়ারি তাঁর সম্পাদিত নারায়ণ পত্রিকায় এটি প্রকাশিত হয়। গানটি এতটাই কালজয়ী হয়েছে যে, কালে কালে সব আন্দোলন-সংগ্রামে গানটি আন্দোলনকারীদের মনে সাহস জুগিয়ে আসছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঢাকায় জুলাই বিপ্লব এবং কলকাতায় একই সঙ্গে আন্দোলনরত লাখো তরুণের কণ্ঠে সাহসের উচ্চারণ হিসেবে গানটি মুহুর্মুহ গীত হয়েছে। গানটি প্রকাশের পর চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবী নজরুলকে তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান।
তিনি ছিলেন খুব স্নেহশীল নারী। নজরুল তাঁকে মা বলে সম্বোধন করতেন। ‘চিত্তনামা’ গ্রন্থটিও কবি বাসন্তী দেবীকে উৎসর্গ করেছিলেন। উৎসর্গপত্রে লেখা ছিল, ‘মাতা বাসন্তী দেবীর শ্রীশ্রীচরণারবিন্দে’।
চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ ভারতের পুরোধা স্বাধীনতাসংগ্রামী এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অন্যতম পথিকৃৎ। কাজী নজরুল ইসলাম, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, শরৎ বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বিধানচন্দ্র রায়, শরত্চন্দ্র বসু, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত—এই নেতারা তাঁর কর্ম ও দর্শন দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত ছিলেন। রাজনীতিতে নজরুলের সক্রিয় অংশগ্রহণের পেছনেও চিত্তরঞ্জন দাশের প্রভাব ছিল। তিনিই প্রথম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ফলে কারাভোগ করেন। মন্টেগু চেমসফোর্ড, রাউলাট অ্যাক্ট, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। চিত্তরঞ্জন দাশ পেশায় ছিলেন ব্যারিস্টার, তিনি দেশের স্বার্থে অসহযোগ আন্দোলনের সময় আইন পেশা ছেড়ে দেন। গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন থেকে সরে গেলে চিত্তরঞ্জন দাশ খুব ব্যথিত হন। ১৯২৩ সালে স্বরাজ দল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৫ সালে কাজী নজরুল ইসলাম শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দল প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন এবং দলের মুখপত্র লাঙ্গল পত্রিকা প্রকাশ করেন। চিত্তরঞ্জন দাশ জাতীয় স্বাধীনতার জন্য অহিংসা এবং সাংবিধানিক পদ্ধতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য, সহযোগিতা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে সারা জীবন কাজ করেছেন।
একই সঙ্গে চিত্তরঞ্জন দাশ বাংলা ভাষার একজন উল্লেখযোগ্য কবি, গীতিকার ও সম্পাদক ছিলেন। তিনি ‘মালঞ্চ’ ও ‘মালা’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। তিনি নারায়ণ, বাংলার কথা, ফরোয়ার্ডসহ বেশ কিছু পত্রিকা সম্পাদনা বা পরিচালনা করতেন। কাজী নজরুল ইসলাম শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মতো চিত্তরঞ্জন দাশের পত্রিকায় লেখালেখি ও রাজনীতির দ্বারা উপকৃত হয়েছিলেন। শেরে বাংলার নেতৃত্বে কাজী নজরুল ইসলাম ও মুজাফ্ফর আহমদের সম্পাদনায় নবযুগ প্রকাশ করেন। নজরুলের বিদ্রোহাত্মক লেখার কারণে ব্রিটিশ সরকার প্রথমে জামানতের দুই হাজার টাকা বাজেয়াপ্ত করে, পরে পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। ১৯৪২ সালে হক সাহেব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হলে নজরুলকে প্রধান সম্পাদক করে নবযুগ পুনরায় শুরু করেন। এ ছাড়া শিশু-কিশোরদের জন্য শেরে বাংলা বালক ও ভারত সুহৃদ নামে দুটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। চিত্তরঞ্জন দাশের নারায়ণ পত্রিকাও শুরু থেকে কাজী নজরুল ইসলামের গান-কবিতা প্রকাশ ও প্রশংসা করতে থাকে। এমনকি কবির ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের আগেই ১৯২১ সালে প্রকাশিত ‘খেয়াপারের তরণী’ ও ‘বাদল বরিষণে’ কবিতার প্রশংসা করে নারায়ণ পত্রিকায় আলোচনা ছাপা হয়। এর আগে মোসলেম ভারত পত্রিকায় ‘বাঁধন হারা’ উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকলে পত্রিকাটি বিভিন্ন সংখ্যায় লেখকের লেখার প্রশংসা করে। ১৯২২ সালে ‘ব্যথার দান’ গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হলে পত্রিকা ভূয়সী প্রশংসা করে। বিশ শতকের একুশ ও বাইশ সালের মধ্যে পত্রিকাটি বিদ্রোহী কবির ১১টি গান-কবিতা প্রকাশ করে। চিত্তরঞ্জন দাশের মেয়ে কল্যাণী দেবী স্মৃতিচারণায় বলেছেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম বাবার বিশেষ অনুগত ছিলেন, ভক্তও ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন।’ অর্থাৎ পল্টন থেকে ফেরার পর থেকেই চিত্তরঞ্জন দাশের পরিবারের সঙ্গে কবির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং বাসন্তী দেবী মাতৃ আসনে বরিত হন।
১৯২৩ সালের ১৪ এপ্রিল নজরুল জেল-জুলুমের বিরুদ্ধে একটানা অনশন শুরু করলে কবির জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে দেশের মানুষ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দিনাতিপাত করেন। সে সময় নজরুলের অনশনের কারণ নিরসনের জন্য বিদেশি সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য চিত্তরঞ্জন দাশের সভাপতিত্বে ২১ মে গোলদীঘির ময়দানে এক জনসভার আয়োজন করা হয়। সভায় শ্রীমৃণালকান্তি বসু, মাওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী, হেমন্তকুমার সরকার, অতুলচন্দ্র সেন, ড. সোহরাওয়ার্দি প্রমুখ নজরুল সাহিত্য ও সংগ্রামের প্রশংসা করে বক্তৃতা করেন। এই সভার কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ায় নজরুলের পক্ষে অনশন ভাঙা সহজ হয়।
১৯২৪ সালে চিত্তরঞ্জন তারকেশ্বরে অসচ্চরিত্র ধর্মব্যবসায় মোহান্তর বিরুদ্ধে আন্দোলন করলে নজরুল তাঁর সঙ্গে যোগ দেন; এবং ‘মোহান্তের মোহ অন্তের গান’ রচনা করেন। ১৯২৫ সালের মে মাসে ফরিদপুরে বঙ্গীয় রাষ্ট্রীয় সমিতির কনফারেন্সে সভাপতিত্ব করেন চিত্তরঞ্জন দাশ। কাজী নজরুল ইসলাম চিত্তরঞ্জন দাশ ও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে ফরিদপুরের সম্মেলন থেকে ফিরে আসার এক মাস পর ৫৪ বছর বয়সে দার্জিলিংয়ে মারা যান দেশবন্ধু। আকস্মিক মৃত্যু সংবাদে নজরুল শোকবিহ্বল হয়ে পড়েন। শ্রীপ্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায় লেখেন, “দেশবন্ধুর মৃত্যু সংবাদ শুনে কবি কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ থেকে দশ মিনিটের মধ্যে ‘অর্ঘ্য’ গানটি রচনা করেন।” এ সময় নজরুল আরো একটি অভিনব কাজ করেন। দেশবন্ধুর কনিষ্ঠা কন্যা এ কথা উল্লেখ করেন, “আমার আজও মনে আছে পিতৃদেব অন্তিম শয়ানে শায়িত—হঠাৎ কোথা থেকে অদ্ভুত প্রকৃতির এক যুবক অবিন্যস্ত তার কেশদাম, পরনে একটি বিচিত্র ধরনের পোশাক, ঝড়ের বেগের মতো ছুটে এলেন—হাতে এক টুকরা কাগজ। কাউকে কিছু না বলে সেই কাগজের টুকরাতে লিখে শবদেহের ওপর রাখলেন—‘হায় চিরভোলা হিমালয় হতে অমৃত আনিতে গিয়া/ ফিরিয়া এলে গো নীল কণ্ঠে মৃত্যু গরল পিয়া।’ ইনি সেই আমার ভ্রাতৃপ্রতিম কাজী নজরুল ইসলাম।”
শোকাহত নজরুল একের পর এক লিখলেন ‘অকাল সন্ধ্যা’, ‘ইন্দ্র-পতন’, ‘সান্ত্বনা’ ও ‘রাজ-ভিখারী’। ‘ইন্দ্র-পতন’ কবিতাটি দেশবন্ধুর মৃত্যুর ১২ দিন পর সাপ্তাহিক আত্মশক্তি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। কিন্তু কয়েকটি শব্দ ও চরণের প্রয়োগ নিয়ে আপত্তি ওঠে। বই প্রকাশের সময় সেগুলো বাদ দেওয়া হয়। প্রবাসীর তথ্য অনুসারে জানা যায়, ৪০ পাতার বইয়ের দাম ছিল এক টাকা।
১৯২৫ সালটি ছিল নজরুলজীবনের অত্যন্ত সৃজনশীল কাল। এই বছর কবি ‘চিত্তনামা’ ছাড়াও ‘ছায়ানট’, ‘সাম্যবাদী’ ও ‘পুবের হাওয়া’ কাব্যগ্রন্থ তিনটিও প্রকাশ করেন। দেশপ্রেম, স্বাধীনতাসংগ্রাম, অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং শোকের গভীর প্রকাশ হিসেবে ‘চিত্তনামা’ কাব্যগ্রন্থটি শতবর্ষেও সমান প্রাসঙ্গিক।
Publisher & Editor