বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ছাপাখানার ভূত

প্রকাশিত: ০৮:৩৪, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ২৬

বিলের পারে শেওড়া আর গাবগাছে বাস করত বেশ কয়েক ঘর ভূত-পেতনি। গ্রাম বেশ দূরে। দিনে এরা লুকিয়ে চুরিয়ে থাকে। আগের দিনে লোকজন ভূতকে ভয় পেত, কিন্তু এখন উল্টোটা।

ভূতই মানুষকে ভয় পায়। তাই রাতের বেলা সবাই মাছ, শামুক, গেঁড়ি ইত্যাদি খোঁজার জন্য বের হয়। গাবগাছের দক্ষিণমুখো একটা ডালে বাস করত খোকশা ভূত আর মুচু পেতনি। তারা যখন এই গাবগাছের ফ্ল্যাটে উঠে আসে তখন খোকশা ভূত তার অন্য প্রতিবেশীর সঙ্গে অনেকটা ঝগড়া করেই বিলের দিকে দক্ষিণের ডালটা দখল করে।

এখান থেকে বিলের বাতাস পাওয়া যায়। সেই বাতাসে মিশে থাকে বিল থেকে আসা মেছো গন্ধ। গন্ধ শুঁকে শুঁকেই ঘুম চলে আসে। ভূতেরা দিনে ঘুমায় রাত জাগে।
একদিন খোকশা ভূত আর মুচু পেতনির কোল অন্ধকার করে তাদের ঘরে জন্ম নিল ঘুটঘুটে এক সোনামণি ভূত। মুচু পেতনির বড় বোন কাঁটাকেশী আদর করে ভাগ্নের নাম রাখল পিঁচুটি। মুচু পেতনি রাগ করে বলল, পিঁচুটি আবার নাম হলো? না না, ওসব খারাপ নাম রাখব না। ভয় ধরানো নাম রাখব, যাতে আমার ছেলের নাম শুনেই লোকজন ভয় পায়। মুচু পেতনি পিঁচুটির কঙ্কালের ছোট্ট কপালে চুমু খেয়ে বলে, আমার ছেলের নাম নখবাবা।

সে লেখাপড়া করে ভূতের মতো ভূত হবে। এতে খোকশা ভূতও বেজায় খুশি। নখবাবার আদর আর ধরে না। নখবাবা মুচমুচ করে ছোট ছোট শামুকের বাচ্চা চিবায়। তার মা-বাবা অনেক দূর থেকে মৌমাছি ধরে এনে দেয়। নখবাবা চপচপ করে সেগুলো শুষে খায়। শেষে একদিন নখবাবার নতুন নাম রাখা উপলক্ষে বিরাট অনুষ্ঠান হলো। কত শত ভূত-পেতনি এলো সেই দুই গাছে। রাত্রিবেলা সবাই হা করে মুখ দিয়ে আগুন ছুড়ল। একসঙ্গে সবাই ভয়ানক নাঁকিসুরে গান গাইল, ভূঁতেঁর ঘঁরে ভূঁত এঁসেঁছে কঁরছিঁ হুঁটোঁপুটি.....
নখবাবা এক বছরের মধ্যেই বড় হয়ে গেল। এখন তার হাতে কলমের মতো বড় বড় নখ। মাথার হাড়ের ওপর খাড়া খাড়া চুল। এভাবে চলে না। নখবাবার মা ভাবল ছেলেটাকে পড়ালেখা করাতে হবে। মানুষের মতো ভূত করতে হবে। মা মুচু পেতনি বাবা খোকশা ভূতকে বলল, তোমার ছেলে এভাবে চললে তো ভূত সমাজে আর মুখ দেখাতে পারবে না। বাবা খোকশা বলল, কী হয়েছে?

—কেন, ইশকুলে ভর্তি করিয়ে দাও।

এ কথায় বাবা খোকশা খেপে উঠল, তুমি পাগল হয়েছ? ভূতেদের মধ্যে পড়ালেখার চল আছে? আমাদের গুষ্টিতে কেউ পড়ালেখা করেছে? আমার বাবা করেছে? তার বাবা?

—এখন সময় পাল্টেছে। পড়ালেখা ছাড়া ভূত কি মানুষ হতে পারবে? মানে ভূত-মানুষ হতে পারবে?

বাবা খোকশার সেই এক কথা, আরে কি সব অলুক্ষণে কথা, ছেলেকে ইশকুলে ভর্তি করালে আমার মানসম্মান কিছু থাকবে? পড়ালেখার কথা শুনলে ভূতেরা সর্ষের মধ্যে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। শোনোনি, সর্ষের মধ্যে ভূতের কথা?

মা মুচু পেতনি এবার একটু দমে যায়, ঠিকই বলেছ তুমি। আমিও শুনেছি সে কথা, সর্ষের মধ্যে ভূত। কিন্তু তাই বলে ছেলেকে পড়াশোনা করাবে না?

—কিভাবে করাই? আচ্ছা দেখি। বলে বাবা খোকশা ভূত তখনকার মতো চলে যায়। পরদিন বাবা খোকশা মা মুচু পেতনিকে নিয়ে বিল থেকে অনেক দূরের গাঁ ছাতিয়ানতলীর প্রাইমারি স্কুলে হাজির। কিন্তু স্কুলে ঢুকতে সাহস পায় না। তারা গিয়ে স্কুলের কাছে একটা আমগাছে গিয়ে ঝুলে রইল। শেষে দুপুরের পর স্কুল ছুটি হলে তারা হেডমাস্টার কাদের স্যারের পিছু পিছু চলল। একটা নীরব জায়গায় আসার পর খোকশা ভূত পেছন থেকে ডাকল, স্যাঁর..। কাদের স্যার পেছন ফিরে তাকান, দেখেন কেউ নেই। কাদের স্যার অবাক হন। তিনি আবার শুনতে পান, স্যাঁর আঁমার ছেলেকে পড়াঁলেখা কঁরাতে চাঁই।

এবার কাদের স্যার বেশ ভয় পান। তিনি বোঝেন তিনি ভূতের পাল্লায় পড়েছেন। সাহস করে বলেন, কি রে তুই নাঁকিসুরে কথা বলছিস কেন?

—স্যাঁর আঁমি তো মাঁনুষ না আঁমি ভূঁত।

শুনে কাদের স্যার কাঁপতে কাঁপতে বলেন, সে বুঝতে পেরেছি। আমাকে আবার ভয় দেখাতে যাস না যেন।

এবার মুচু পেতনি বলে ওঠে, আঁপনার ইশকুলে আঁমার ছেলেকে ভঁর্তি করিয়ে নেঁন স্যাঁর।

কাদের স্যার আরো ভয় পান। তার স্কুলে পড়বে ভূত! ভয়ে ভয়ে বলেন, তা বাপু বুঝেছি, কিন্তু এমনিতেই চাকরির অভাব। শোনো, ভূতেদের পড়ে কোনো লাভ নেই। কোথায় চাকরি করবে বলো? আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, যদি একটা জায়গা দেখাতে পারিস, তাহলে তোদের ছেলেকে ভর্তি করিয়ে নেব।

খোকশা ভেবে কূল পায় না। শেষে মুচু পেতনি বলল, ‘তুমি নখবাবাকে ফোন করো, ওই ঠিক বলতে পারবে ভূতেদের চাকরি কোথায় হয়, ছোট্ট হলেও বুদ্ধিমান ছেলে আমার।’

খোকশা ফোনের লাউডস্পিকার অন করে ছেলেকে ফোনে বলে, ভূতেদের কোথাও চাকরি হয় বাবা?

নখবাবার গলা শোনা গেল, হয়। এক শ বার হয়। ছাপাখানায় হয়। কেন শোনোনি, ছাপাখানার ভূত। শিক্ষিত ভূতেরা তো সব ছাপাখানায়ই চাকরি করে।

কাদের স্যার নিরুপায়! বাধ্য হয়ে ভূতের ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে নিলেন। এবং ভূতের ছেলেরা বড় হয়ে ছাপাখানায় চাকরি করে। এই যে বইয়ে যত উল্টাপাল্টা ভুলভাল হয় এগুলো সেই সব ভূতেদেরই কাজ!

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor