ফ্যাসিবাদ এমন একগুচ্ছ মতাদর্শ ও চর্চার সমষ্টি যা জাতিকে যা সাধারণত জাতিগত, সাংস্কৃতিক এবং/অথবা ঐতিহাসিক দিক থেকে একচেটিয়াভাবে সংজ্ঞায়িত করে; এগুলোকে অন্যান্য সব ধরনের আনুগত্যের উর্ধ্বে স্থান দিতে চায় এবং একটি সক্রিয় জাতীয় সম্প্রদায় গড়ে তুলতে চায়।
—কেভিন পাসমোর
আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলকে স্বৈরতন্ত্র, নির্বাচন করে আসা স্বৈরতন্ত্র, হাইব্রিড রেজিম—নানাভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে রাজনৈতিক পরিসরে এই রেজিমকে ‘ফ্যাসিবাদী’ বলে অভিহিত করাটাই বেশি পরিচিত।
৫ আগস্টের আগে ‘ফ্যাসিবাদী’ বলে শুধু আওয়ামী রেজিমকেই চিহ্নিত করা হতো। ৫ আগস্টের পরপর এই অভিধা হরেদরে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এখন তো আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকেই ‘ফ্যাসিবাদী’ বলা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও একে অপরের বিরুদ্ধে ‘ফ্যাসিবাদ’ কায়েমের অভিযোগ তোলা হচ্ছে হরদম। এমনকি আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ে ছিলেন—এমন ব্যক্তিরাও মতের মিল না হলে একে অপরকে ফ্যাসিবাদী বলে তকমা দিচ্ছেন।
১৯৪৪ সালে জর্জ অরওয়েল ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক বাকভঙ্গির মধ্যে একরকম অস্পষ্টতা আছে বলে মন্তব্য করেছিলেন—‘যদি ছাপা জিনিসপত্র ঘেঁটে দেখেন, তাহলে দেখবেন, এমন কোনো লোক পাওয়া যাবে না, এমন কোনো ধরনের রাজনৈতিক দল বা সংগঠন পাওয়া যাবে না, যাদের গত ১০ বছরে ফ্যাসিস্ট বলে খারিজ করা হয়নি।’
বাংলাদেশে বর্তমানে এ পরিস্থিতি হাজির রয়েছে। যাকে–তাকে ‘ফ্যাসিবাদী’ বা ‘ফ্যাসিস্ট’ তকমা দেওয়ার ফলে আওয়ামী রেজিমের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী হওয়ার যে অভিযোগ, সেটাই লঘু হয়ে যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করা নিয়ে যে আলাপ বা বাহাস চলছে, সেখানেও রেফারেন্স বিন্দু হিসেবে আছে ইউরোপের ফ্যাসিবাদ। ইউরোপে ফ্যাসিবাদকে নস্যাৎ করা হয়েছে, এর সব চিহ্নকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে, ফলে এখানেও করতে হবে একই তরিকায়—অনেকটা এ ধরনের যুক্তি।
ইউরোপের ফ্যাসিবাদ বা নাৎসিবাদকে রেফারেন্স বিন্দু হিসেবে হাজির করে বাংলাদেশের ইতিহাসের সহিংস ঘটনা ব্যাখ্যার প্রবণতা আসলে সমস্যাজনক। এতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির খণ্ডিত চিত্র হাজির হয়।
শুধু ইউরোপের সঙ্গে অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে এখানকার রাষ্ট্র ও সহিংসতার নানা মাত্রাকে লঘু করে ফেলা হয়। যেমন একাত্তরের জেনোসাইডকে কেবল নাৎসি জমানার জেনোসাইডের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে অনেক স্থানিক বিষয় বাদ পড়ে। ধারণ করে একটা খণ্ডিত চেহারা। এই খণ্ডিত চিত্র আওয়ামী জমানা তাদের মতাদর্শিক অবস্থান তৈরিতে ব্যবহার করেছিল।
আওয়ামী রেজিমকে কী নামে চিহ্নিত করব, তা জানা জরুরি। তার চেয়েও জরুরি হচ্ছে এই ফ্যাসিবাদের কালে যে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর ইনসাফ নিশ্চিত করা। ১৫ বছরের গুম–ক্রসফায়ার ও জুলাই মাসের গণহত্যার মতো ব্যাপক সহিংসতার বিচার ও ইনসাফ কেবল সাধারণ আইন-আদালত ও বিচারপ্রক্রিয়া দিয়েই সম্ভব হবে না। আমাদের ক্রান্তিকালীন ইনসাফ বিষয়েও আলাপ শুরু করতে হবে।
ফ্যাসিবাদ নিজে কোনো মতাদর্শ নয়। যেকোনো মতাদর্শের কাঁধে সওয়ার হয়ে ফ্যাসিবাদ কায়েম হতে পারে। জাতীয়তাবাদী চিন্তার কাঁধে সওয়ার হওয়াই সর্বাধিক সহজ প্রবণতা।
আওয়ামী লীগের শাসনামলকে আমরা যেভাবে ফ্যাসিবাদী বলে থাকি, তার সঙ্গে এই জমানার একাডেমির বহু লোক আসলে একমত হবেন না। তাঁরা বরং এই রেজিমকে ‘স্বৈরতন্ত্র’ বা ‘নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র’ বা ‘অটোক্র্যাসি’ বা ‘হাইব্রিড রেজিম’ ইত্যাদি বর্গ দিয়ে ব্যাখ্যা করবেন।
ইউরোপের উদাহরণ দিয়ে আওয়ামী শাসনকে ‘ফ্যাসিবাদ’ বর্গে ঢোকানোর চেষ্টা আদতে খুব একটা ফলপ্রসূ হবে না। হিটলারের নাৎসিবাদ বা স্তালিনের কমিউনবাদ বা মুসোলিনির ফ্যাসিবাদকে অনেক বেশি ‘টোটালিটারিয়ানিজম’ বর্গের আওতায় ব্যাখ্যা করার চল আছে। ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দের ব্যবহার নিয়েও সতর্কতামূলক অবস্থান নেওয়া উচিত বোধ হয়।
সম্প্রতি চিন্তক ও প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ আজমও এমন সতর্কতার পক্ষে। তাঁর মতে, আওয়ামী সরকারের অন্তত শেষ ১১ বছরের শাসনকে আসলে আধা ফ্যাসিস্ট, অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসন বলাই শ্রেয়। এর কারণও আছে। প্রথমত, ইতালি ও জার্মানির মতো ফ্যাসিস্ট শাসনে রাষ্ট্রের মতাদর্শে ওই দেশের জনগণের মোটামুটি ব্যাপক সমর্থন দেখা গেছে। বাংলাদেশে বাস্তবতা বিশেষভাবে আলাদা। আওয়ামী শাসন জনগণের মধ্যে মোটেই জনপ্রিয় ছিল না।
দ্বিতীয়ত, ফ্যাসিস্ট ও মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরের মতো কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে জনসম্মতির পাশাপাশি জাতীয়তাবাদী চেতনা, রাষ্ট্রের ও জনগণের উন্নতি—এসব নৈতিকতার প্রাবল্য দেখা গেছে। আওয়ামী আমলে এসবের কোনো বালাই লক্ষ করা যায়নি। দুর্নীতি ও লুটপাটই এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাই মোহাম্মদ আজমের মতে, একে ‘ফ্যাসিস্ট’ শাসন বলে সম্মানিত না করাই ভালো।
ফলে আওয়ামী শাসনামলকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিসরে যে ‘ফ্যাসিবাদ’ পরিভাষা ব্যবহার করছি, তাকে বুঝতে হবে আমাদের কাঠামো ও প্রবণতার আলোকে। ইউরোপের ইতিহাস দিয়ে বুঝতে গেলে ভুল হওয়ার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। মুখের কথা হিসেবে ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দ ব্যবহার এক কথা। কিন্তু এর বাইরে সরকারি সিদ্ধান্ত বা কোনো দল নিষিদ্ধের যুক্তি হিসেবে ইউরোপীয় অর্থে ‘ফ্যাসিবাদ’ ব্যবহার সরকারকে বিপদে ফেলবে। কেননা, এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক কোনো মানবাধিকার সংগঠনই ইউরোপের ফ্যাসিবাদের সঙ্গে আওয়ামী জমানার পরিস্থিতির তুলনামূলক আলাপ ও যুক্তিকে আমলে নেবে না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে ‘ফ্যাসিবাদ’–বিষয়ক আলোচনা চালু আছে। আওয়ামী শাসনামলকে ‘ফ্যাসিবাদ’ দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা আছে। এই বিষয়গুলোকে কেবল গত শতকের প্রথমার্ধের ইউরোপীয় অভিজ্ঞতা দিয়ে নয়, বরং বাংলাদেশের নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা ও ইতিহাসের আলোকে বোঝা দরকার।
আওয়ামী জমানার এই ফ্যাসিবাদকে ‘কাঠামো’র জায়গা থেকে বোঝার পাশাপাশি রাজনৈতিক সংস্কৃতির জায়গা থেকেও বোঝা দরকার। অর্থাৎ কেবল সর্বাত্মক রাষ্ট্রপ্রণালির জায়গা থেকে ‘ফ্যাসিবাদ’কে না বুঝে একে গণহিস্টিরিয়া হিসেবেও চিহ্নিত করা প্রয়োজন। এই গণহিস্টিরিয়ার ব্যাপ্তি একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত। এটা একধরনের উন্মাদনা। যে মানুষ সারা বছর যুক্তিশীল মানুষ হিসেবে পরিচিত, তিনিও স্রেফ কোনো গুজবের পাল্লায় পড়ে এমন উন্মাদনার জোয়ারে গা ভাসাতে পারেন।
এ ধরনের উন্মাদনা তথা ফ্যাসিবাদ সমাবেশ বা গণজোয়ারেও বটে। দুটি প্রবণতা থাকে এই জোয়ারের মধ্যে। একদিকে বিদ্রোহ, অন্যদিকে প্রতিপক্ষের ওপর রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন চালানোর প্রকট বাসনা। এই জায়গা থেকে ২০১৩ সালের দুটি আন্দোলন/সমাবেশ—শাহবাগ ও শাপলা চত্বরের মধ্যে আমরা ফ্যাসিবাদী প্রবণতা দেখতে পাই।
সহজ কথা হচ্ছে, রাজনৈতিক পরিসরে যে ‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দের হরদম ব্যবহার চলছে, তাকে এ দুই জায়গা থেকে বুঝতে পারা জরুরি। কেবল তখনই বোঝা যাবে যে ‘ফ্যাসিবাদী কাঠামোর বিলোপ চাই’ বলে কী বোঝানো হচ্ছে? যখন আমরা ফ্যাসিবাদী কাঠামোর বিলোপ চাই বলছি, তখন কেবল মতাদর্শিক অবস্থানের ‘স্থানান্তর’ চাই না। বরং পুরো কাঠামোর একধরনের রদবদল, সংস্কার বা বিলোপ চাই।
আওয়ামী রেজিমকে কী নামে চিহ্নিত করব, তা জানা জরুরি। তার চেয়েও জরুরি হচ্ছে এই ফ্যাসিবাদের কালে যে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর ইনসাফ নিশ্চিত করা। ১৫ বছরের গুম–ক্রসফায়ার ও জুলাই মাসের গণহত্যার মতো ব্যাপক সহিংসতার বিচার ও ইনসাফ কেবল সাধারণ আইন-আদালত ও বিচারপ্রক্রিয়া দিয়েই সম্ভব হবে না। আমাদের ক্রান্তিকালীন ইনসাফ বিষয়েও আলাপ শুরু করতে হবে।
বাংলাদেশে যে ধরনের সহিংসতা জুলাই-আগস্ট মাসে ঘটেছে, যে সামূহিক ট্রমার জন্ম নিয়েছে, তা লাঘব কেবল সাধারণ বিচার দিয়ে হবে না। বিচার যেমন লাগবে, তেমন ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ, স্মৃতি সংরক্ষণ, ট্রমা লাঘবকরণ, ট্রুথ কমিশন তৈরি করা ইত্যাদি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েও যেতে হবে। কারণ, এ ধরনের সহিংসতায় সমাজের এক বিরাট অংশ জড়িয়ে পড়ে। আর তা শুধু ‘শাস্তি’ দিয়ে বা ‘নিষিদ্ধ’ করে সমাধা করা যাবে না।
Publisher & Editor