গাছেরা কী খেয়ে বাঁচে বলো তো? শুধু শরবত! হা হা হা, হাসতে শুরু করলে বুঝি? কথাটা মিথ্যা না। গাছেরা আদতে শরবত খেয়েই বাঁচে। ওদের তো আর দাঁত নেই যে কুটুরমুটুর করে ভাত-মাছ খাবে। ওরা রোজ মাটির রস খায়।
সেই রস পাতায় নিয়ে রোদের আলোয় রান্নাবান্না করে। চিনির খাবার হয়। তাই খায় আর বাড়ে। তবে কিছু কিছু গাছের শুধু ওসব রোচে না মুখে।
ওদের মাংস লাগে! এ জন্য ওরা হরহামেশাই শিকার করে। পেতে রাখে নানা রকম ফাঁদ। ওদের তাই বলা হয় মাংসাশী উদ্ভিদ।
মাথার ওপর পড়ল কী!
দক্ষিণ আমেরিকার এক পাইন।
মানুষ তাকে খুব গালমন্দ করে। সে নাকি মেয়েদের বিধবা বানায়। কী কঠিন অভিযোগ রে বাবা! এই পাইনের ওজন হয় কমসে কম পাঁচ কেজি। ওদিকে গাছটিও হয় ২০০ মিটার উঁচু। অত উঁচু থেকে পাইন যার মাথায় পড়ে, তাকে নির্ঘাত হাসপাতালে যেতে হয়।
মরে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়! তাহলে তোমরাই বলো, পাইনটাকে যে মানুষ গালমন্দ করে, সে কি আর সাধে!
আমাদের দেশের তালটাও কিন্তু এমনই দুষ্টু। সেও দেখবে এমনিতে চুপচাপ। যেই কেউ তলায় যাবে, অমনি পড়বে ধপাস করে। অবশ্য, এখানে তাল বেচারার চেয়ে কাকের দোষটাই বেশি। সেই নাকি মানুষ দেখে পাকা তালের ওপর বসে। আর বেচারা তাল টাল সামলাতে না পেরে বন বন নিচে নেমে আসে।
ফাঁদের ওপর ফাঁদ
জানোই তো, গাছের হাত নেই। নেই আমাদের মতো মুখ, পেট আর মাথা। তাহলে কিভাবে তারা শিকার করে?
মাংসাশী গাছের শরীরটাই আদতে একটা ফাঁদ! কিভাবে? মাংসাশী গাছ আর উদ্ভিদরা হরেক রকমের হয়। কোনো কোনোটার শরীর ভরা থাকে মানুষের চুলের মতো রোয়া। ওসব রোয়া এমনিতে কমই চোখে ধরা পড়ে। তবে ছোট ছোট পোকামাকড় ওতে পড়লেই আটকে যায়। রোয়ার ঘন জঙ্গলে মরে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে শরীর গলে মিশে যায় উদ্ভিদের শরীরে। এভাবেই কিছু উদ্ভিদ পোকা আর মাছি থেকে পুষ্টি গিলে খায়।
কিছু উদ্ভিদের কাণ্ড আরো অদ্ভুত। পাতার খানিকটা তাদের মোড়ানো। সেখানে আবার গর্ত। ঠিক কলসির মতো। ভেতরে জমাট পানি। কখনোসখনো মিষ্টি স্বাদের রস। তাই খেতে পোকামাকড় কলসির মুখে আসে। আর সুরুত...পিছলে পড়ে একদম কলসির তলে। ওদিকে কলসির মুখে থাকে আরেকটি হালকা পাতা। পোকা পড়তেই সেই পাতা লেগে যায় খাপে খাপ! এবার পোকাটাকে হজম করে আর খেয়ে নেয় চট করে। এদের বলে কলসি উদ্ভিদ।
কোনো কোনো পাতার তো দাঁতও আছে। একদম দাঁত না হলেও তা দাঁতের মতোই বলতে পারো। তাদের পাতাগুলোও হয় দুটো চাকতির মতো। পোকামাকড় যেই পাতার ভেতর আসে, চাকতি দুটো বুজে যায়। তাতে পোকাটাও হয় চিড়াচ্যাপ্টা! এমন এক উদ্ভিদের নাম ‘বুনো কীটকল।’
অনেক জাতের মাংসাশী উদ্ভিত আছে। ‘বুনো কীটকল’ সবচেয়ে চালু মাংসাশী উদ্ভিদ। তারা মাংস খেতে ভালোবাসে। তাই নিয়ম করে তাদের শিকার ধরতে হয়। তাদের পাতাগুলো হয় ভারি অদ্ভুত। দুটো চাকতি মিলে একটি পাতা। চাকতিগুলোর চারপাশে নরম কাঁটা। পাতার ভেতরটা লাল। সেখানে ছড়ানোছিটানো রোয়া। তার ফাঁকতলটা মধুজলে ভেজা। সুগন্ধে ম ম করা।
শুধু তা-ই নয়। পুরো পাতাটা আবার আস্ত একটা পেট। ওটাই আবার মুখ। ওটাই আবার দাঁত। ভারি মজার না? হ্যাঁ, মাংসাশী উদ্ভিদগুলোর যেখানে দাঁত, সেখানেই পেট। সেখানেই মুখ।
বুনো কীটকলের আরেক নাম ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ। তো ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ যখন মুখ হাঁ করে তার পাতাকে খুলে রাখে, তখন ভারি সুগন্ধ ছড়ায়। লাল টকটকে রং ফোটে পাতার ভেতর থেকে। পোকামাকড় তাই দেখে ধেয়ে আসে। আর হামলে পড়ে পাতার ভেতরে। মধু খেতে বসে যায় চুপটি করে।
যেই না মধু খেতে বসে, রোয়ায় নাড়া লাগে। সেই নাড়া পেয়ে চমকে ওঠে বুনো কীটকলের স্নায়ু। ২০ সেকেন্ডের ভেতর আরেকটি নাড়া পড়লেই হলো। পাতার চাকতি দুটো লেগে যায় খপ করে। দুই পাশে কঁঁটাও লেগে যায় আড়াআড়িভাবে। তাতেই আস্ত একটা জেলখানায় বন্দি হয়ে যায় পোকাটি। পোকা যত নড়ে, পাতাও এটে যায় শক্ত করে!
তারপর ঘটে মজার কাণ্ডটা। পাতাটিই আস্ত একটা পেট হয়ে যায়। নানা রকম হজমিরস বেরোতে থাকে। তাতে পোকাটি একদম হজম হয়ে যায়। ভেঙে যায় প্রথমে। তারপর যায় গলে। তখন বুনো কীটকল পুরো পোকাটাকে চুষে নেয় টুক করে।
হেমলক গাছের ফুল
হেমলক গাছের ফুল
গাছের আছে লাঠিসোঁটা
মানুষের মতো গাছেরও কিছু শত্রু আছে। আর তাদের শায়েস্তা করার জন্য গাছের আছে নানা রকম উপায়। ওসবই হচ্ছে তাদের লাঠিসোঁটা।
কিছু কিছু গাছের পাতা খেতে ভারি মজার হয়। ভাবছ, তাতে গাছের লাভটা কী শুনি? আরে, পাতা মজার হয় বলেই তো পোকামাকড় ফলের দিকে নজর দেয় না। তাতে বীজ বেঁচে যায়। বীজ না হলে যে গাছেরা বংশ বাড়াতে পারে না, সে তো আর তোমাদের বলে দিতে হবে না।
আবার কিছু গাছ ভারি চালাক। তারা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে জানে। এক ধরনের তামাক আছে। ওদের পাতায় যখন ছোট ছোট পোকার লার্ভাতে ছেয়ে যায়, তখন ওরা এক ধরনের গন্ধ ছড়িয়ে দেয় বাতাসে। তাতে বড় পোকারা টের পেয়ে যায়, পাতার ওপর লার্ভা আছে। ওমনি তারা হুমড়ি খেয়ে পড়ে সেসব লার্ভার ওপর। আর চেটেপুটে খেয়ে গাছকে বাঁচায় প্রাণে।
কিছু কিছু গাছের আবার বিষকুঠুরি থাকে। শত্রু এলেই তারা ডাঁটি থেকে পিচকিরির মতো বিষ ছুড়ে দেয়। তবে পোকামাকড়ও কম যায় না! তারাও জানে কী করে বিষ থেকে বাঁচতে হয়। তারা বুদ্ধি করে ডাঁটি কামড়ে ধরে। বোকা উদ্ভিদগুলো পিচকিরির মতো বিষ ছুড়তেই থাকে। একসময় বিষ শেষ হয়। পোকারা চাকুমচুকুম করে পাতা খেতে বসে যায়। তবে কিছু গাছ হয় খুবই বিষাক্ত। গাজর বা মুলার মতো দেখতে একটি উদ্ভিদ। নাম তার হেমলক। সে এমনই বিষ ধরে যে তা খেলে মানুষও মারা যায়!
পাইসোনিয়া গাছ
পাইসোনিয়া গাছ
পাখির বিপদ
কিছু কিছু গাছ হয় খুবই পরিপাটি। ঘন চিকন ডালে ভরা। পাখিরা সহজেই বাসা বানাতে চায় ওসব গাছে। পাইসোনিয়া গাছও তেমন। গাছটিতে পাখিরা বাসা বানাতে ভালোবাসে। আর সেই সুযোগে গাছটি যা করে, শুনলে আঁতকে উঠবে। পাইসোনিয়াগাছের বীজে আংটা লাগানো থাকে। তাই পাখি যতবার তার বাসায় যায় আর আসে, ঝুপঝাপ শুকনা বীজগুলো লেগে যায় পাখায়, ঘাড়ে আর মাথায়। বাদ যায় না লেজও। খুব বেশি বীজ লেগে গেলে পাখিটি আর উড়তে পারে না। ধপ করে পড়ে যায় মাটিতে। তারপর আর কী? না খেতে পেয়ে শেষমেশ মারা যায়। জানো, এমন একটি দুষ্টু উদ্ভিদ আমাদের দেশেও আছে। তার নাম আগরা বা জামাইনাড়ু। আগরার ফলগুলো নাড়ুর মতোই হয়, তবে পাখির পালক বা পশুর লোমে লাগলেই একদম এঁটে যায়। কিছুতেই ছাড়ে না!
পাইসোনিয়া গাছ
ডাইনি লতা
গাছের গায়ে চকচকে হলুদ লতা। জটাপাকানো বুড়ির মতো। নাম স্বর্ণলতা। একটা দুটো লতা কোনো গাছের গায়ে পড়লেই হয়, আর তার রক্ষা নেই। রাক্ষুসে লতাটি শেকড় গেঁথে দেবে গাছের বাকল ফুঁড়ে। তারপর সেই গাছটির যত রস আর ভিটামিন, সব চুষে নেবে। দিনকে দিন শুকাতে থাকবে গাছ, আর জটা বড় হবে স্বর্ণলতার।
স্বর্ণলতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বরইগাছে। অনেকেই এই লতা এক গাছ থেকে নিয়ে দিয়ে দেয় অন্য গাছে। ভাবে তাতে গাছের সাজগোজ হবে। ভুলেও তোমরা এ কাজ কোরো না কিন্তু। বুঝতেই তো পারছ, স্বর্ণলতা ভারি দুষ্টু এক পরগাছা। সে এমনকি অন্য গাছটিকে মেরেও ফেলতে পারে!
তথ্যসূত্র : হোয়াট অন আর্থ, আস্ক.কম
ছবি : সংগৃহীত
Publisher & Editor