মাত্র ৯টি পূর্ণাঙ্গ গল্প লিখেছিলেন ফ্রানৎস কাফকা। বাদবাকি কোনো গল্পই তিনি সম্পন্ন করেননি বা করতে পারেননি বা করতে চাননি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে তিনটি অসমাপ্ত উপন্যাস [মৃত্যুর পর বের হয় ১. ‘দ্য ট্রায়াল’ (১৯২৫), ২. ‘দ্য ক্যাসল’ (১৯২৬), ৩. ‘দি আমেরিকা’ (১৯২৭), কয়েকটি বড় গল্প, কিছু মুক্তগদ্য]। এ ছাড়া তাঁর রচনাসমগ্রের মধ্যে রয়েছে ডায়েরি ও কয়েক হাজার চিঠি।
জীবদ্দশায় সাতটি রচনা বই আকারে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এগুলো নিয়ে সংশয়ের অন্ত ছিল না তাঁর। তাইতো বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে চিঠি লিখলেন, ‘সবগুলো পাণ্ডুলিপি আর নোটখাতা তুমি পুড়িয়ে দিয়ো।’ শুধু চিঠি লিখেই ক্ষান্ত হলেন না।
অসুস্থ অবস্থায় শক্তিহীন শরীর নিয়ে আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যেসব পাণ্ডুলিপি ছিল, পুড়িয়ে দিলেন নিজেই। কিন্তু বন্ধু ম্যাক্স ব্রড কথা রাখলেন না। তাঁর মৃত্যুর পর যত্ন করে প্রকাশ করলেন সেসব অপ্রকাশিত লেখা। পৃথিবী পেল একজন বিস্ময়কর লেখককে, যাঁর লেখার সংখ্যা খুবই নগণ্য।
কিন্তু প্রভাব অসামান্য এবং শতবর্ষব্যাপী চলমান। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর এসব ক্ষুদ্রায়তনিক পাণ্ডুলিপি নিলামে তুলেছিল—মূল্য উঠেছিল ১০ কোটি পাউন্ড। কিন্তু তারা তা বেচেনি। এ পর্যন্ত সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী শতাধিক লেখকের মধ্যে প্রায় ৪০ জন লেখকই নিজেদের ওপরে কাফকার প্রভাবের কথা সরাসরি স্বীকার করেছেন। ২০১০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দি নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় কাফকা স্কলার এলিফ বাটুমান জানাচ্ছেন, ‘কাফকা গবেষণার সংখ্যা বেড়ে চলেছে তাঁর নিজের লেখার সংখ্যার উল্টো ধারায়; সাম্প্রতিক এক হিসাবমতে, গত ১৪ বছরে (অর্থাৎ ১৯৯৬ সাল থেকে) প্রতি ১০ দিনে তাঁকে নিয়ে বের হয়েছে একটি করে নতুন বই।
’ ইংরেজি ভাষার অভিধানে নতুন শব্দ যুক্ত হয়েছে তাঁর নামে—কাফকায়েস্ক। শব্দটির অর্থ করা হয়েছে এভাবে—১. অর্থহীন, বিভ্রান্তকর, প্রায়শই ভীতিকর ও বিপজ্জনক জটিলতা; উদাহরণ কাফকায়েস্ক আমলাতন্ত্র; ২. পরাবাস্তব বিকৃতিতে ভরা এবং প্রায়শই আগাম বিপদ ও নৈরাজ্যের বোধ জাগানো অনুভূতি; উদাহরণ কাফকায়েস্ক বিচারব্যবস্থা। ভাবা যায়!
এত সামান্য লিখে এ রকম অসামান্য প্রভাববিস্তারী যে লেখক, প্রশ্ন উঠতেই পারে, কী আছে তাঁর লেখায়? এককথায় যদি তাঁকে উপস্থাপন করতে চাই, বলব—তাঁর সমস্ত চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে যে চিন্তা বা চিন্তাসমষ্টি তা সমস্ত জগৎ থেকে ভিন্নতর এবং তা ছিল অন্য সবার চিন্তার অতীত। বিশ্ব পাঠকের কাছে তাঁর উপস্থাপিত জগৎ ছিল সম্পূর্ণ নতুন আর রোমাঞ্চ-রহস্যে ঘেরা। বিষয়টিকে যদি আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে চাই, বলব—উদ্ভটত্ব। অর্থাৎ তাঁর লেখায় এত বেশি উদ্ভটত্ব যে আর কারো বেলায় তা উদাহরণীয় নয়। কী রকম সে উদ্ভটত্ব? তাঁর সৃষ্টিকর্মের দিকে তাকিয়ে একনজরে দেখে নেওয়া যাক—‘রূপান্তর’ গল্পে গ্রেগর সামসা নামের এক সেলসম্যান এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে সে একটা অতিকায় পোকায় পরিণত হয়েছে। পোকায় পরিণত হলেও তার চিন্তা-সক্ষমতার কোনো পরিবর্তন বা বিবর্তন হয়নি। সে সবার কথা বুঝতে পারছে, বিচলিত হচ্ছে এই ভেবে যে অফিসে যাওয়ার সকালের ট্রেনটা মিস না হয়ে যায় তার। ‘বিচার’ উপন্যাসে জোসেফ কে নামের একজন নিরপরাধ ব্যাংকার একদিন সকালে অজ্ঞাত কারণে গ্রেপ্তার হয়ে যায়। বাড়িওয়ালির ঘরে তাঁর একটা বিচারও হয়ে যায়। তাকে বন্দি করা হয় না। সে মুক্তভাবে ঘোরাফেরা করার অনুমতি পায়। কিন্তু তাকে অপেক্ষা করতে বলা হয় পরবর্তী নির্দেশের জন্য। উপন্যাস ‘দূর্গ’-এ দেখা যায় কে নামের এক ভূমি জরিপকারী ভদ্রলোককে। সে সারা জীবন ব্যর্থ চেষ্টা করে যায় গ্রামের শাসকদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এক রহস্যময় দুর্গের ভেতরে প্রবেশের। ‘দণ্ড উপনিবেশ’ নামের গল্পে দেখা যায় এক মেশিন। দণ্ডিত আসামিদের গায়ে শত শত সুই দিয়ে নকশা করে লিখে দেয় তাদের অপরাধের কথা। ‘আইনের দরজায়’ নামের এক গল্পে দেখা যায় এক লোককে, যে সারা জীবন আইনের দরজার বাইরে অপেক্ষারত। এক পর্যায়ে সে যখন মারা যাচ্ছে, তাকে বলা হয় এই দরজাটা শুধু তার জন্যই বানানো হয়েছিল। ‘রায়’ গল্পে দেখা যায় বৃদ্ধ ক্ষমতা-উন্মাদ জীর্ণ নোংরা অন্তর্বাস পরা এক বাবাকে, যিনি তাঁর ছেলেকে পানিতে ডুবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দিয়ে বসেন। ছেলের অপরাধ সে বিয়ে করে স্বাধীনভাবে সংসার করতে চেয়েছিল। ‘এক গ্রাম্য ডাক্তার’ নামের এক গল্পে দেখা যায় রোগীকে সারিয়ে তুলতে না পারার জন্য শাস্তি দিতে। ডাক্তারকে শাস্তি হিসেবে রোগীর পাশে শুইয়ে দেওয়া হয়। রোগীর গায়ে জ্বলজ্বল করছে ফুলের মতো একটা ক্ষত, আর সেখানে কিলবিল করছে হাজার হাজার পোকা। ‘সম্রাটের কাছে একটি বার্তা’ নামীয় গল্পে দেখা যায় এক গোলকধাঁধার বৃত্তান্ত। সম্র্রাটের বার্তা নিয়ে এক বাহক কোনো দিনই পৌঁছাতে পারে না তাঁর গন্তব্যে। ‘এক অনশন শিল্পী’ নামের এক গল্পে দেখা যায় এমন একটি চরিত্রকে, যার পেশা হচ্ছে না খেয়ে থাকা। এভাবে না খেয়েই সে মারা যায়। মারা যাওয়ার আগে বলে যায়, তার খাওয়ার মতো কোনো খাবার এই পৃথিবীতে ছিল না। ‘গায়িকা জোসেফিন অথবা ইঁদুর-জাতি’ নামের এক গল্পে দেখা যায় জোসেফিন নামের এক মেয়ে ইঁদুরকে—যে মঞ্চে গান গায়। বিস্ময়-মুগ্ধ এক ব্যক্তি সন্দিহান হয় এই কারণে যে মঞ্চের বাইরের এই অতিসাধারণ মেয়ে ইঁদুরটি মঞ্চে কেন এত পূজনীয়!
বোঝা যাচ্ছে তাঁর উদ্ভটত্ব কোন পর্যায়ের। মানুষ পোকা হয়ে যাচ্ছে—মানছে না প্রকৃতির আইন। ডাক্তারকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে—সামাজিক রীতি মানা হচ্ছে না। বিয়ে করতে চাওয়ার অপরাধে ছেলেকে শাস্তি দিচ্ছেন বাবা—পারিবারিক নিয়ম মানা হচ্ছে না। এসব উদ্ভটত্ব আসলে প্রতীক ও রূপকের আড়ালমাত্র। এক ধরনের নেতিবাদ। ডায়েরিতে কাফকা লিখেছিলেন, ‘আমি প্রচণ্ডভাবে আত্মস্থ করে নিয়েছি আমার সময়ের নেতিবাচক বিষয়গুলো।’ সত্যি কথা বলতে কি তিনি তাঁর সময়ের নেতিবাচক বিষয়গুলো আত্মস্থ করলেও তাঁকে পাঠ বা আত্মস্থ করতে পারেনি তাঁর সময়। ফলে তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল মৃত্যুর পরও পঁচিশ বছর। যখন ধীরে ধীরে অনুধাবনীয় হচ্ছিল কাফকার দেওয়া নেতিগুলো। আর এখন মৃত্যুর ১০০ বছর পর একবিংশ শতাব্দীতে দেখছি তাঁর নেতিগুলোর চরম উপস্থিতি। ফলে তাঁর একদা আপাত উদ্ভটত্বই এখনকার চরম বাস্তবতা। এখানেই তিনি সফল।
শুধু তা-ই নয়. একদার আপাত উদ্ভটত্বগুলো এখন বিভিন্ন বাস্তবতার নিরিখে দেখা হচ্ছে। যেমন—মানুষ পোকা হয়ে যাওয়াকে ডাক্তারি শাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে ক্লিনিক্যাল ব্যাখা। শ্রেণিবৈষম্যের দৃষ্টিকোণ থেকে কাফকাকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। ব্যাখ্যা করা হচ্ছে ফ্রয়েডীয় মনসমীক্ষণের চোখ দিয়ে। শুধু তা-ই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কাফকা ব্যাখ্যার মোট ১৯ ধরনের মূলধারা রয়েছে। যেমন—অস্তিত্ববাদী ব্যাখ্যা, মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, সামন্ততান্ত্রিক ব্যাখ্যা, অ্যাবসার্ড সাহিত্যিক ব্যাখ্যা, এক্সপ্রেশনিস্ট ব্যাখ্যা, নন্দনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ইত্যাদি।
নারীসঙ্গ পছন্দ করতেন। পাঁচজন প্রেয়সীর কথা জানা যায়। প্রথম প্রেয়সী ফেলিস বাউয়ার। ১৯১৩ সালে পরিচয়ের পর তাঁকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন। চিঠিগুলো নিয়ে লেটার্স টু ফেলিস নামে কাফকার বই বের হয় পরবর্তী সময়ে। ১৯১৪ ও ১৯১৭ সালে দুবার বাগদান হলেও একবারও বিয়ে হয়নি। ফেলিসের সঙ্গে সম্পর্ক চলাকালে কাফকা গোপনে জড়িয়ে যান ফেলিসেরই প্রিয়তম বান্ধবী গ্রেটে ব্লখের সঙ্গে। ১৯২০ সালে অসুস্থ অবস্থায়ই কাফকা প্রেমে পড়েন চেক সাংবাদিক ও লেখক মিলেনা য়েসেন্সকার। মিলেনাকে লেখা তাঁর চিঠিগুলো ‘লেটার্স টু মিলেনা’ নামে বের হয় পরবর্তীকালে। মিলেনার সঙ্গে সম্পর্ক চলাকালেই অশিক্ষিত এক হোটেল পরিচারিকার প্রেমে পড়েন তিনি। তার নাম ইউলি ওরিেসকে। তাঁর শেষ প্রেম ডোরা ডিয়ামান্ট। এই প্রেম খুব সম্ভাবনাময় ছিল। পালিয়ে বর্তমান ফিলিস্তিনে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন তাঁরা। শুরু করতে চেয়েছিলেন হোটেল ব্যবসার। ডোরা হবে পাঁচক। কাফকা হবেন ওয়েটার। কিন্তু ঘাতক যক্ষ্মা তত দিনে তাঁকে কাবু করে ফেলেছে। বাধ্য হয়ে ফিরে আসেন নিজ আবাসভূম—প্রাগে।
‘রূপান্তর’ গল্পটির জন্য বিশ্বব্যাপী বেশি উল্লিখিত ও পরিচিত কাফকা, যা সব ধরনের পাঠককেই সংযুক্ত করেছে। কী আছে এই রূপান্তরে? আছে অবরুদ্ধ উত্তেজনাময় এক মেটাফর, যা পাঠককে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে নিয়ে যায়। পাঠক মনেপ্রাণে চায়— সামসা আবার রূপান্তরিত হবে আগের রূপে। অর্থাৎ মানুষে। কিন্তু কাফকা সব পাঠককে নিরাশ করে সামসাকে ঠেলে দেন মৃত্যুর দিকে। এটাকে কি অর্থহীন গোঁয়ার্তুমি বলা হবে? না। তিনি তো ইচ্ছাপূরণের গল্প বলতে চাননি। কী বলতে চেয়েছিলেন তা জানা যায় ১৯১৩ সালের ২১ জুন তাঁর ডায়েরিতে লেখা এক বাক্যে, ‘ভয়ংকর এক পৃথিবী আমি বয়ে চলেছি আমার মধ্যে।’ মনে হয় সেই ভয়ংকর পৃথিবীটাকে তিনি সামসার মধ্যে স্থাপন করে নিজেকে নিষ্ক্রান্ত করেছেন। আর আমরা সামসার করুণ পরিণতি দেখে মর্মাহত হয়েছি।
৩ জুন ১৯২৪। কাফকা তাঁর সেবক ক্লপস্টককে মিনতি করে বলেন, ‘আমাকে ছেড়ে যেয়ো না।’ ক্লপস্টক বলেন, ‘আমি যাচ্ছি না।’ কাফকা উত্তরে বলেন, ‘কিন্তু আমি যাচ্ছি।’ এরপর চোখ বন্ধ করেন। সে চোখ আর কোনো দিন খোলেননি।
কিন্তু তিনি খুলে দিয়েছিলেন অন্য এক চোখ। যে চোখ দিয়ে আমরা আজকে দেখছি আধুনিক পৃথিবীতে ব্যক্তির একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতা, স্বার্থপরতা ইত্যাদি। ১৯৪৭ সালের ১৮ এপ্রিল টাইম পত্রিকায় ম্যাক্স ব্রডের কাফকার জীবনী নিয়ে লেখার সমালোচনায় লেখা হয়, ‘মৃতের ঠোঁটের রং দেখেই বিশ শতকের সভ্যতার পরিমাপ হয়।’ তিনি যে চোখ দিয়ে দেখে দেখে আমাদের দেখিয়েছিলেন বর্তমান ও ভবিষ্যতের রূপ—তারই প্রতিফলন যেন উপরোক্ত বক্তব্য।
তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় লোক হয়েছিল মাত্র ১০০ জন। অথচ মৃত্যুর ১০০ বছর পরও তাঁকে স্মরণ করছে পৃথিবী। শুধু তা-ই নয়, এখন যদি তাঁর বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের সুরে আমরাও বলি, ‘একদিন বিংশ শতাব্দীকেই ডাকা হেবে কাফকা শতাব্দী নামে’ তাহলে কি বেশি বলা হবে? এর যথার্থ উত্তর, ‘না’।
Publisher & Editor