বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪

আমেরিকানরা যুদ্ধ জিততে ভুলে গেছে

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ০২ জুন ২০২৪ | ৭১

গত ৫০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে হারতে সিদ্ধহস্ত হয়ে গেছে। ১৯৭৫ সালে অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে আমরা সায়গন থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। ১৯৮৪ সালে বৈরুত থেকে, ১৯৯৩ সালে মোগাদিসু থেকে এবং ২০২১ সালে ইরাক থেকে—সেই একই অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে আমরা আমাদের সেনাদের ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিলাম। 

যুক্তরাষ্ট্রের এই কৌশলগত যুদ্ধে কেবল ১৯৯১ সালে সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে এবং মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে আমরা সীমিত আকারে জয় পেয়েছি। এর বাইরে আর কি যুদ্ধ আছে? গ্রানাডা, পানামা, কসোভো—ছোট তিনটি যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের হতাহতের সংখ্যা খুবই সামান্য। এ কারণে এ যুদ্ধ খুব সামান্যই মানুষের স্মৃতিতে রয়েছে।

তুমি যদি বামপন্থী শিবিরের হও, তাহলে সম্ভবত তুমি বলবে, সব কটি না হলেও বেশির ভাগ যুদ্ধ ছিল অপ্রয়োজনীয়। সেগুলো জয়ের মতো যুদ্ধ ছিল না। কিংবা মূল্যহীন যুদ্ধ ছিল। তুমি যদি ডানপন্থী শিবিরের হও, তাহলে হয়তো তুমি বলবে, যুদ্ধে জেতার জন্য যথেষ্ট সেনা ছিল না। আর সেনারা যুদ্ধটাও খুব বাজেভাবে করেছে। তাঁদের সামনে অনেকগুলো প্রতিবন্ধকতা ছিল। মিশন শেষ হওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।

যেভাবেই বলি না কেন, এসব যুদ্ধের কোনোটাই আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত যুদ্ধ ছিল না। কসোভো যদি এখনো সার্বিয়ার অংশ থাকত—তাহলে কি আমেরিকানদের জীবন বস্তুগতভাবে বদলে যেত? কিন্তু যেসব যুদ্ধের সঙ্গে আমেরিকানদের অস্তিত্বের বিষয়টি জড়িত, তা নিয়ে আমরা কী বলব? আমরা জানি, আমেরিকানরা তাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত যুদ্ধগুলো কীভাবে লড়াই করেছিল। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীর যুদ্ধবিমান থেকে ফেলা বোমায় নেদারল্যান্ডসে ১০ হাজার, ফ্রান্সে ৬০ হাজার, ইতালিতে ৬০ হাজার ও জার্মানিতে লাখের বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয় অ্যাংলো-আমেরিকান নীতির ওপর ভিত্তি করে। নীতিটা ছিল ‘সশস্ত্র প্রতিরোধ সক্ষমতাকে গুরুতরভাবে দুর্বল করার মাধ্যমে জার্মান জনগণের নৈতিক মনোবল ভেঙে দেওয়া।’ জাপানের বিরুদ্ধে আমরা আমাদের অস্তিত্বের এই নীতিই ব্যবহার করেছিলাম, বোমায় ১০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিলেন।

আজকে ইউক্রেন ও ইসরায়েল একই ধরনের যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। তারা সেটা বলছে বলেই আমরা সেটা জানতে পারছি এমনটা নয়, তাদের শত্রুরা যা করছে, তা দেখেই তাতেই আমরা জানছি। ভ্লাদিমির পুতিন বিশ্বাস করেন, ইউক্রেন রাষ্ট্রটির অস্তিত্বই একটা কল্পকাহিনি। হামাস, হিজবুল্লাহ ও তাদের পৃষ্ঠপোষক ইরান তো খোলাখুলি বলেছে, মানচিত্র থেকে ইসরায়েলকে মুছে ফেলা হোক। এর প্রতিক্রিয়ায় ইউক্রেন আর ইসরায়েল আগ্রাসীভাবে যুদ্ধ করতে চাইছে। তারা মনে করছে, শত্রুদের সক্ষমতা আর যুদ্ধ করার আকাঙ্ক্ষা গুঁড়িয়ে দিতে পারলেই তারা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে।

বিষয়টি অনেক সময় দুঃখজনক পরিণতি ডেকে আনে। সেটাই আমরা দেখতে পেলাম রাফায়। হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে চালানো বিমান হামলায় রাফায় কমপক্ষে ৪৫ জন বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়।  

ইউক্রেনের মতো মিত্রকে আমরা কেবল রাশিয়ানদের হামলা প্রতিহত করতে যেটুকু অস্ত্র প্রয়োজন, ততটুকুই দিচ্ছি। এ কারণে রাশিয়া তাদের দিক থেকে আক্রমণ বাড়ানোর সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধ তো খিচুড়ি রান্নার মতো কোনো ব্যাপার নয়, যুদ্ধের জন্য কখনোই একটা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণযোগ্য নয়। হয় তুমি বিজয়ের পথে থাকবে, না হয় পরাজয়ের পথে।

এখন আমরা দেখছি, বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলের লাগাম টেনে ধরা এবং ইউক্রেনকে সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দুই দেশকেই তারা বিভ্রমের মধ্যে রেখেছে। গত কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে নিজেরা যুদ্ধ করেছে, সেই একই রকম যুদ্ধ করার জন্য ইসরায়েল ও ইউক্রেনকে বলছে তারা। চিন্তা করে দেখুন তো, আকাশসীমা প্রতিরক্ষা দেওয়ার জন্য ইউক্রেনের কাছে একটিও এফ-১৬এস যুদ্ধবিমান দেওয়া হয়নি।

ট্র্যাজেডি হলো সাম্প্রতিক যুদ্ধের ইতিহাস বলছে, হাজার হাজার সৈন্য এমন সব যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন, যেখানে আসলে জেতার আকাঙ্ক্ষার ঘাটতি ছিল। এসব সেনার মৃত্যুর কারণ হলো, বাইডেন ও পূর্বসূরি প্রেসিডেন্টরা দেরি করেছেন তাঁদের অগ্রাধিকার কী হবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতে।
অল্প মেয়াদে বাইডেনের এ পদক্ষেপ মানবিক সংকটের কিছুটা লাঘব করছে, ভোটারদের ক্ষোভের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে, বড় ধরনের যুদ্ধের আশঙ্কা থেকে রক্ষা করছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের মিত্রদের পরাজয় নিশ্চিত করছে।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আর্লিংটন জাতীয় সমাধিস্থলে মেমোরিয়াল ডে উপলক্ষে দেওয়া বক্তৃতায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যেসব সেনা ‘স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে গণতন্ত্রের যুদ্ধে’ লড়াই করেছেন ও শহীদ হয়েছেন, তাঁদের প্রতি সম্মান জানিয়েছেন। কিন্তু ট্র্যাজেডি হলো সাম্প্রতিক যুদ্ধের ইতিহাস বলছে, হাজার হাজার সৈন্য এমন সব যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন, যেখানে আসলে জেতার আকাঙ্ক্ষার ঘাটতি ছিল। এসব সেনার মৃত্যুর কারণ হলো, বাইডেন ও পূর্বসূরি প্রেসিডেন্টরা দেরি করেছেন তাঁদের অগ্রাধিকার কী হবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতে।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor