বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৩

আখ্যানের যুবরাজ

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১১

মিলনের লেখার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক হচ্ছে সমকালের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা—যা আমাদের জনজীবনকে আন্দোলিত ও ক্ষুব্ধ করে, তার কোনো কিছুই কখনো তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। সেদিক থেকে তিনি দায়বদ্ধ একজন কথাসাহিত্যিক। ‘যাবজ্জীবন’ থেকে শুরু করে তাঁর সর্বশেষ আখ্যানধর্মী লেখায় এর নিদর্শন মিলবে সে ছিল একদিকে উদ্দীপ্ত আর অন্যদিকে কুণ্ডলায়িত জটিল এক সময়। গত শতকের সত্তরের মাঝামাঝি তখন। এ রকম সময়ে একদিন বাংলা একাডেমিতে দেখা হলো সুদর্শন আর কিছুটা অস্থির এক তরুণের সঙ্গে। বয়সটা মনে হলো আমারই কাছাকাছি। তখন বাংলা একাডেমির আড্ডাগুলো হতো রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী কিংবা রশীদ হায়দারের রুমে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে এই আড্ডা চলত।

রফিক আজাদ তখন বাংলা একাডেমির সাহিত্য পত্রিকা ‘উত্তরাধিকার’ সম্পাদনা করতেন। এই পত্রিকার সূত্রেই লেখকদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। ভিড় করতাম আমি আর আমার মতো বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া কিছু তরুণ, যারা কেবল লেখালেখি শুরু করেছি। কিন্তু ‘উত্তরাধিকার’-এ লেখা প্রকাশ করা সহজ ছিল না। সম্পাদক হিসেবে রফিক আজাদ ছিলেন অনেক উঁচু সাহিত্যরুচির সম্পাদক। এই রফিক আজাদের সঙ্গে দেখলাম ওই তরুণ, পরে যার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল, সেই ইমদাদুল হক মিলনের একটি উপন্যাস প্রকাশের ব্যবস্থা হয়ে গেল। উপন্যাসটির নাম ‘যাবজ্জীবন’। আমরা তো অবাক। মিলনের তখন একটি-দুটি গল্প কোথাও হয়তো বেরিয়েছে, কিন্তু একেবারে উপন্যাস, সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করা এক স্বল্প পরিচিত তরুণের? কিন্তু সেদিন তা-ই ঘটেছিল।

আমাদের সময়ে এত কম বয়সে কোনো তরুণের উপন্যাস এ রকম একটি বিখ্যাত পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের নজির নেই। সেই যে বিস্ময়, বিস্ময়ের চেয়েও বেশি মুগ্ধতা আজও মিলন সম্পর্কে আমার অক্ষুণ্ন রয়ে গেছে। কারণ মিলন এরপর একটির পর একটি উপন্যাস লিখে গেছে, লিখে গেছে গল্প। আমি ঠিক হিসাব করে বলতে পারব না, তবে দুই শতাধিক বা এর কাছাকাছি তো হবেই (আসল সংখ্যাটি মিলনের কাছে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে!)। এই যে নিরন্তর লিখে যাওয়া মিলনকে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে অবিসংবাদিত ঈর্ষণীয় প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। মিলনের কৃতিত্বের মুকুটে আরো একটি পালক সেই সময়েই যুক্ত হয়েছিল। সেটি সে করেছিল সজ্ঞানে, সচেতনভাবে। কথাসাহিত্য যেহেতু করবই, তাহলে জনপ্রিয় হতে হবে। আমাদের এখানে-ওখানে যেসব আড্ডা হতো, মিলন সেসব আড্ডাতেই সগর্বে বলত, ‘আমি চাই ঔপন্যাসিক হিসেবে আমাকে সবাই জানুক, চিনুক। আমি এমন লেখা লিখব, যাতে পাঠকের হৃদয়ে স্থায়ীভাবে ঠাঁই করে নিতে পারি। আবার এমন লেখাও আমি লিখব, যে লেখা সমকালকে ছাড়িয়ে চিরায়তের মহিমাকে স্পর্শ করবে।’ মিলনের কৃতিত্ব হচ্ছে, সে-ই আমাদের প্রথম জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। জনপ্রিয়তাকে অনেকেই সাহিত্যে গুরুত্ব দিতে কুণ্ঠা বোধ করেন। জনপ্রিয় মানেই বুঝি তরল, সহজপাচ্য কিছু। কিন্তু জনপ্রিয় রচনাও যে চিরায়তের মর্যাদা পেতে পারে, এ রকম দৃষ্টান্ত বাংলা সাহিত্য থেকে বিশ্বসাহিত্য পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। মিলনই একটি সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা বলেছেন। শরত্চন্দ্র একই সঙ্গে নন্দিত ও জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক। বিশ্বসাহিত্যেও এ রকম দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। মিলনের সিদ্ধান্তটা তাই যথার্থই ছিল নিঃসন্দেহে। আদর্শ হিসেবে মিলন গ্রহণ করেছিল সমরেশ বসুকে। সেই সময়ে, আমার মনে আছে, সমরেশ বসু ছিলেন খুবই জনপ্রিয় একজন ঔপন্যাসিক।

মিলনের এভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে আরো একটি কারণ ছিল। আখ্যানপিপাসু বাংলাদেশের পাঠকরা তখন পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত বাংলা উপন্যাস পড়ত, বাংলাদেশের কথাসাহিত্য সম্পর্কে তাদের তেমন আগ্রহ ছিল না। এই পাঠকদের বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের দিকে টেনে আনার জন্যই মিলন জনপ্রিয় ঘরানার লেখালেখির দিকে ঝুঁকেছিল। মিলনের এই সিদ্ধান্তটাও ছিল সময়োপযোগী। সেই প্রথম আমরা দেখলাম, পাঠকরা, বিশেষ করে তরুণ পাঠকরা মিলনের লেখালেখি সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠছে। সেই সময়ে যেসব তরুণ উপন্যাস ও গল্প লিখছিল, তারাও মিলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জনপ্রিয় ধরনের লেখা লিখতে শুরু করে।

মিলন এই ভাবনার কথাটি একটি সাক্ষাৎকারে নিজেই বলেছে এভাবে, “আমি স্বচ্ছ সুন্দর ভাষায় প্রেমের গল্প, তরুণদের দৈনন্দিন জীবনের গল্প লিখতে শুরু করলাম। পাশাপাশি গভীর জীবনবোধের লেখাও লিখতে চেষ্টা করলাম। যেমন—আমার প্রথম উপন্যাস ‘যাবজ্জীবন’, প্রথম গল্পগ্রন্থের নাম ‘ভালোবাসার গল্প’। দুটো দুরকম।” এখানে বলা প্রয়োজন, তখনো হুমায়ূন আহমেদ জনপ্রিয় হননি। বরং তাঁর প্রথম দুটি উপন্যাস শৈল্পিক উৎকর্ষের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য হলেও বৃহত্তর পাঠক পরিমণ্ডলে স্থান করে নিতে পারেনি। এই অচলায়তনটি ভেঙে দেয় মিলন। আমরা এরপর লক্ষ করলাম, মিলনের পথ ধরেই হুমায়ূন আহমেদ জনপ্রিয়, অর্থাৎ পাঠক পরিসর বৃদ্ধির জন্য জনপ্রিয় লেখালেখির দিকে ঝুঁকলেন। হুমায়ূনের পরবর্তী লেখালেখিটা তো আজ ইতিহাস। কিন্তু এই ইতিহাসের স্রষ্টা বা পথিকৃৎ মিলনই। হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে আমি একটি লেখায় যে কথাগুলো বলেছিলাম, আজ মিলনের লেখা সম্পর্কে সেই কথাগুলো বলতে পারি।

জনপ্রিয় এই কথাটির সাধারণ অর্থ হচ্ছে জননন্দিত হওয়া। অসংখ্য মানুষের হৃদয়কে যা ছুঁয়ে যায়, সমাদর পায়, তাকেই আমরা জনপ্রিয় আখ্যা দিয়ে থাকি। এই প্রেক্ষাপটে উপন্যাসকে দুইভাবে দেখা হয় : ‘সাহিত্যিক উপন্যাস’ (লিটের‌্যারি ফিকশন) আর ‘জনপ্রিয় উপন্যাস’ (পপুলার ফিকশন)। প্রথম শ্রেণির উপন্যাস মানুষকে নির্মল আনন্দ দেওয়ার জন্য লেখা হয় আর দ্বিতীয় শ্রেণির উপন্যাসে থাকে জটিল জীবনের কথা। কিন্তু অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন যে পাঠক যদি কোনো উপন্যাসকে গ্রহণ না করে, তাহলে সেই উপন্যাস রচনার সার্থকতা কোথায়? ফলে অনেক সময় দেখা গেছে পাঠকের কাছে গ্রাহ্য না হওয়ার কারণে অনেক শিল্পসফল উপন্যাসও উপন্যাসের জগৎ থেকে হারিয়ে গেছে। ঔপন্যাসিকও লেখক হিসেবে বেশিদূর এগোতে পারেননি। জনপ্রিয় হলেও যে তিনি ভালো লেখক নন, তা-ও তো নয়। আগেই মার্কেসের কথা বলেছি, সেই সঙ্গে আরো উল্লেখ করা যায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সালমান রুশদি, ডি এইচ লরেন্স, এমনকি তলস্তয়ের কথা।    

জনপ্রিয় হলে সেই রচনাকে যে অপাঙক্তেয় ভাবা যাবে না, সে কথা বলছেন কোনো কোনো সাহিত্য সমালোচক। এই খ্যাতিমান সমালোচকদেরই একজন হচ্ছেন মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। তিনি লিখছেন, ‘অনেক সময় বাজারসফল ও জনপ্রিয় বইয়ের মধ্য দিয়ে সমাজ ও সংস্কৃতিকে বোঝার কিছু সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়, যা সিরিয়াস সাহিত্যকৃতি থেকে লভ্য নয়। সচরাচর শাশ্বত সাহিত্য পদবাচ্য বইয়ের যিনি লেখক তিনি সৃজনশীল, একক এবং ব্যক্তি হিসেবে অনন্য। তিনি ব্যাপকভাবে জনগণের প্রতিভূ নন। কিন্তু যিনি সাধারণ পাঠকের মন জয় করেছেন, তিনি জনসাধারণের রুচি ও প্রবৃত্তির খবর রাখেন। সাহিত্য সমালোচনা যদি সমাজচিন্তার অঙ্গ হয়, তবে বহুল পঠিত লোকপ্রিয় উপন্যাসের বিশ্লেষণ করারও একটা তাৎপর্য আছে, সে কথা মনে রাখা দরকার।’ বোঝাই যাচ্ছে, জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকই ব্যাপক জনগণের আবেগ-অনুভূতির কম্পনটি তাঁর রচনায় তুলে ধরেন। ফলে সাধারণ মানুষের কথা বুঝতে হলে জনপ্রিয় উপন্যাসের কাছে আমাদের যেতেই হবে। লেখালেখির শুরুতেই মিলন এই সাধারণ মানুষের কথাই উপন্যাসের আখ্যানরীতির মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করে এবং সফলও হয়।

এই প্রেক্ষাপটেই মিলনের উপন্যাসের আরেকটি সূত্র আমরা লক্ষ করব। সেটি হলো সমকালের দৈনন্দিন যাপিত জীবনকেই মিলন তার উপন্যাস ও গল্পে উপজীব্য করেছে। সমকালের অনন্য ভাষ্যকার সে। তারুণ্যের জীবনস্পন্দনটি তার লেখায় বেশ স্পষ্ট। আমাদের চারপাশে যা ঘটছে, মিলন তার তীক্ষ পর্যবেক্ষক আর আখ্যানসীমার মধ্য থেকেই বিশ্লেষণ করে থাকে। এখানে হুমায়ূন আহমেদের লেখার সঙ্গে তাঁর লেখার একটা চকিত তুলনা করা যায়।

হুমায়ূন, লক্ষ করলে দেখা যাবে তারুণ্যের অনির্দিষ্ট বোহেমীয় কোমল দীর্ঘশ্বাস ও শুভবোধকে প্রাধান্য দিয়েছেন। পক্ষান্তরে মিলন এই তারুণ্যের যাপিত জীবনকেই তার উপন্যাসে তুলে ধরেছে। হুমায়ূন যেখানে কিছুটা মরমি, ফ্যান্টাসির ওপর ভর করে চরিত্রসৃষ্টি ও ঘটনাপ্রবাহকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, মিলন সেখানে নিরেট বাস্তবতা ও রোমান্টিকতাকে উপন্যাস ও গল্পে প্রাধান্য দিয়েছে। হুমায়ূন যেখানে মরমিবাদে আস্থা স্থাপন করেছেন, মিলন সেখানে বাস্তববাদী এক কথাকার। কেউ যদি এই দুই জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকের লেখালেখি নিয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেন, তাহলে আরো চমকপ্রদ কিছু তুলনাসূত্র খুঁজে পাবেন।

মিলনের লেখার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হচ্ছে সমকালের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা আমাদের জনজীবনকে আন্দোলিত ও ক্ষুব্ধ করে, এর কোনো কিছুই কখনো তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। সেদিক থেকে সে দায়বদ্ধ একজন কথাসাহিত্যিক। ‘যাবজ্জীবন’ থেকে শুরু করে তার সর্বশেষ আখ্যানধর্মী লেখায় এর নিদর্শন মিলবে।

সমকালের যাপিতজীবনে যেহেতু নানা ঘটনা ঘটতে থাকে, একটি ঘটনাকে সরিয়ে দিয়ে নতুন কোনো ঘটনা সামনে চলে আসে, মিলনের আখ্যানেও তাই বৈচিত্র্য উল্লেখ করার মতো। মিলনের জীবনযাপনের মধ্যেই এই বৈচিত্র্যকে খুঁজে পাওয়া যায়।

মিলনের জীবন, লক্ষণীয়, দুই ভুবনে প্রসারিত। এর একদিকে তার শৈশব-কৈশোরের মেদিনীমণ্ডল, অন্যদিকে যৌবনের করুণরঙিন পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়া। মেদিনীমণ্ডলে যেমন দেখা যাবে গ্রামীণ বিচিত্র মানুষের বসবাস, তেমনি পুরান ঢাকায়ও দেখা মিলবে বিচিত্র নাগরিক মানুষের। ফলে মিলনের অভিজ্ঞতা ভীষণ সমৃদ্ধ। আমাদের সমকালে এ রকম আর একজন কথাসাহিত্যিককেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই লেখাটি যাঁরা পড়ছেন তাঁদের আমি আরো একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। মিলনের ছেলেবেলা কেটেছে স্বাধীনতা-পূর্ব কালে আর যৌবনের দিনগুলো স্বাধীনতা-উত্তর কালে। ফলে সময়ের দিক থেকেও তার জীবনাভিজ্ঞতা দুদিকেই প্রসারিত হয়ে আছে। এসব কারণেই আমার মনে হয়েছে, মিলনের লেখার স্থানিক ও কালগত বৈচিত্র্য অনেক বেশি, বিষয়-আশয় অনেক ঋদ্ধ। সমকালের অন্য কোনো লেখকের মধ্যে এই বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়া যাবে না।

এখানে তার শৈশবের কথা আরেকটু বলি। মেদিনীমণ্ডলে তার বেড়ে ওঠা নানির কাছে। সেখানে সে পেয়েছে অবাধ স্বাধীনতা। প্রকৃতি, পরিপার্শ্ব ও মানুষকে দেখার অভিজ্ঞতা। গেণ্ডারিয়ায় এসেও তার একই অভিজ্ঞতা হয়েছে, শুধু স্থান, পরিপার্শ্ব ও মানুষজন ছিল ভিন্ন। একজন লেখকের যত ধরনের অভিজ্ঞতা থাকতে পারে, মিলন তার সবই পেয়েছে।

আমি বলব, লেখক হিসেবে খুবই সৌভাগ্যবান মিলন। আমার সঙ্গে সেই মধ্য-সত্তরে যখন প্রথম দেখা হয়, এরপর বন্ধুতা, মিলনের মনোভূমি তখনই নানা অভিজ্ঞতায় উর্বর, শুধু রচনার সোনালি শস্যে উদ্ভাসিত হওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ ছিল। সেই লেখালেখির আজ পঞ্চাশ বছর পূর্তি হচ্ছে। বন্ধুর এই কৃতিত্বে আমি নিজেও আনন্দিত।

উপন্যাসের একটা একাডেমিক সংজ্ঞার্থ আছে। সেটা এখানে একটু স্মরণ করি। তাত্ত্বিকরা বলছেন, ঔপন্যাসিকের জীবনার্থের রূপান্বিত রূপক হচ্ছে উপন্যাস। অর্থাৎ ঔপন্যাসিকের নিজস্ব ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গির গল্প হচ্ছে উপন্যাস। মিলনের এই দৃষ্টিভঙ্গিটা কেমন, অর্থাৎ জীবনকে মিলন কোন মূল্যবোধ ও ভাবনার আলোকে দেখে থাকে? নিঃসন্দেহে মিলনের দৃষ্টিভঙ্গি মানবিক। তার আখ্যানে থাকে সামাজিক বৈষম্য ও সংকটের ছবি, রাজনীতি মানবমুক্তি আনে আর ইতিহাস হচ্ছে মানুষের সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের ইতিবৃত্ত। সামগ্রিকভাবে অন্তস্যূত থাকে মানুষের জন্য মমত্ববোধ ও ভালোবাসা। এই ছোট্ট লেখায় মিলনের আখ্যানসমূহে কিভাবে এসব প্রতিফলিত হয়েছে, অল্প কথায় সেসব ব্যাখ্যা করে বোঝানো যাবে না। আমি তাই শুধু দু-একটি আখ্যানের কথা বলব। ‘নূরজাহান’ উপন্যাসটির কথা ভাবা যাক। এটি কাঠামো ও আখ্যান বিস্তৃতির দিক থেকে একটি এপিকতুল্য উপন্যাস। নূরজাহানের মধ্য দিয়ে মিলন আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সামগ্রিক ছবিটি তুলে ধরেছে। আরেকটি কাহিনির কথা মনে করা যেতে পারে—‘একাত্তর ও একজন মা’। এই উপন্যাসের পটভূমি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। একজন বিধবা মায়ের জীবনযুদ্ধের কাহিনি। সামগ্রিকভাবে মানবিক সংকটই হচ্ছে এই উপন্যাসের বিষয়। মিলন বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। বঙ্গবন্ধু তার আদর্শ। প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতিও তার ঝোঁক লক্ষ করা যায়। মিলান কুন্ডেরা তাঁর উপন্যাস নিয়ে লেখা ‘দি আর্ট অফ দি নভেল’ বইয়ে উপন্যাস সম্পর্কে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তাঁর ভাবনায় উপন্যাস হচ্ছে সত্তার রহস্যপূর্ণ দিকগুলোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা। খুব অভিনিবেশ সহকারে দেখলে দেখা যাবে, সত্তানুসন্ধানই পরিশেষে মিলনের সব আখ্যানের লক্ষ হয়ে ওঠে।

এসব ছাড়িয়ে উপন্যাস কিন্তু শেষাবধি একধরনের নির্মাণ। ভাষা ও বর্ণনার সৌন্দর্যে পাঠকের কাছে সমাদৃত হওয়ার মধ্য দিয়েই এর সার্থকতা। মিলন কথাসাহিত্য রচনার শুরু থেকেই এই দিকটিকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছে। আসলে জনপ্রিয় হতে গেলে এটা মনে করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। জনপ্রিয় হয়ে ওঠার যে সূত্র, অর্থাৎ আকর্ষণীয় গল্প, ভাষা, আঙ্গিক, হৃদয়স্পর্শী দৃষ্টিভঙ্গি সবই মিলনের আছে। উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা থাকবে, কিন্তু গাম্ভীর্যই উপন্যাস নয়। ঔপন্যাসিককে আসলে বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করার ক্ষমতা থাকতে হবে। মিলন ঠিক এ রকমই একজন লেখক। রিজিয়া রহমান মিলনের লেখার মধ্যে তাই খুঁজে পেয়েছেন ‘বৈদগ্ধ্য’। আমি এর সঙ্গে যুক্ত করতে চাই আবেগকে। আবেগ আর বৈদগ্ধ্যের মিশেলেই উপন্যাস পাঠককে ছুঁয়ে যায়। মিলন নিজেও এই আবেগের প্রয়োজনীয়তার কথা একটা সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছে। তবে এত কিছুর পরও নিরন্তর লিখে যাওয়া, এই পরিশ্রম ও নিষ্ঠার পরিচয় পাওয়া যায় মিলনের বিপুল রচনাসম্ভারের দিকটি লক্ষ করলে। মিলন সেই সূত্রেই নিরন্তর নিরীক্ষাপ্রবণ, বাস্তবের কোনো গল্প আর চরিত্র তার চোখ এড়িয়ে যায়নি। ‘যে জীবন আমার ছিল’ বইটি পড়লেই বোঝা যায় মিলন যেসব মানুষ আর ঘটনার ভেতর দিয়ে গেছে, তার প্রায় সবই কোনো না কোনো উপন্যাসে অথবা গল্পে স্থান করে নিয়েছে। তবে তার শক্তি নিঃসন্দেহে গল্প বলার শক্তি, বর্ণনার শক্তি। উপন্যাস শেষ অবধি যথোপযুক্ত চিত্তাকর্ষক বর্ণনা ও গল্পের নির্মাণ, পামুকের এ রকম একটি কথা সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন তাঁর ‘দি নাইভ অ্যান্ড দি সেন্টিমেন্টাল নভেলিস্ট’ বইয়ে। এই বইয়ের শুরুর বাক্যটি এ রকম : ‘উপন্যাস হচ্ছে দ্বিতীয় জীবন।’ বাস্তবের প্রতিভাস। ঔপন্যাসিক আমাদের চেনা পরিচিত নানা দেখাকে আনন্দে পরিপূর্ণ করে তোলেন। মিলনের জনপ্রিয় গল্পগুলো স্বচ্ছন্দে পড়ে যাওয়া যায়। কিন্তু শিল্পসম্মত আখ্যানগুলো জটিল হয়েও ভাষা ও বর্ণনার গুণে সহজ গতিময়। রচনার বিপুলতা, কাহিনির বৈচিত্র্য ও বর্ণনার ঐশ্বর্যে মিলন তাই নিঃসন্দেহে সমকালের অন্যতম শীর্ষ কথাসাহিত্যিক। আজ তার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন, বন্ধু।

Mahfuzur Rahman

Publisher & Editor