অণুগল্পের সঙ্গে ছোটগল্পের মূল পার্থক্য হলো, ছোটগল্প তৈরি হয় কতগুলো মুহূর্ত নিয়ে; এখানে কতগুলো ঘটনার কতগুলো দৃশ্যকে আশ্রয় করে প্রকাশ ঘটে। আর একটি সার্থক অণুগল্পে একটি বিশেষ মুহূর্ত একক দৃশ্যপটের ভেতর দিয়ে উপস্থাপিত হয়। কিছু পরিষ্কার করে বলা হবে না, কেবল একটি ইঙ্গিত দিয়েই ছেড়ে দেওয়া হবে অণুগল্প বা ফ্ল্যাশ ফিকশন সম্প্রতি সাহিত্যের জনপ্রিয় শাখা হয়ে উঠেছে। পাঁচ বছর ধরে ব্রিটেনের সাহিত্যজগতে ‘ন্যাশনাল ফ্ল্যাশ ফিকশন ডে’ উদযাপিত হয়ে আসছে।
নিউজিল্যান্ডেও অনুরূপভাবে জাতীয় অণুগল্প দিবস পালিত হয়। স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলের বিপ্লব, ফেসবুক-টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর জনপ্রিয়তায় বর্তমানে গল্পের এই খুদে কাঠামো বা ফর্মটি নিয়ে হৈচৈ হলেও এটি একেবারে নতুন কিছু নয়, মুখে মুখে বলা গল্প-ঐতিহ্যে (ওরাল ট্র্যাডিশন) বহুযুগ থেকে চলে আসছে। রূপকথা (Fairy Tale) থেকে আমরা পেয়েছি অণুকাঠামোর গল্প উপকথা (Fable) এবং কথারূপক (Parable)। মোটাদাগে ফেবলের সঙ্গে প্যারাবলের পার্থক্য হলো, ফেবলে সরাসরি মানবচরিত্র থাকে না, কিন্তু প্যারাবলে থাকে।
জার্মানিতে গ্রিন ভাইদ্বয় (জ্যাকব গ্রিন ও উইলহেম গ্রিন), ফ্রান্সে পেরোল, ডেনমার্কে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন, ইতালিতে বেসিল, ইংল্যান্ডে কাইটলি ও ক্রোকার এসব রূপকথা বা ফোক-টেলস সংগ্রহ করে আদি গল্পের কাঠামো সম্পর্কে আমাদের অবগত করেছেন। ভারতবর্ষে বৌদ্ধ জাতকের (খ্রিস্টপূর্ব ৫৩০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ অব্দ) গল্প পঞ্চতন্ত্র, গোপাল ভাঁড়ের গল্প ও ইউরোপে ঈশপের (৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সংকলিত) গল্পও আকারে বেশ ছোট ছিল। তবে আধুনিক অণুগল্প বলতে আমরা যা বুঝি, সেগুলো তা নয়। আধুনিক অণুগল্পের প্রাথমিক কাঠামো সেখান থেকে এসেছে বলে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হতে পারি।
দুই.
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে অণুগল্পের প্রধানতম লেখক হলেন বনফুল (১৮৯৯-১৯৭৯)। বেশ কিছু ভালো উপন্যাস ও নাটক লিখলেও বনফুল আজ অণুগল্পের লেখক হিসেবে বেশি পরিচিত। অণুগল্প লিখে হালে পশ্চিমবঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিতি পেয়েছেন স্বপ্নময় চক্রবর্তী। বর্তমান বিশ্বে অণুগল্প লিখে ‘ম্যান অব বুকার’ পুরস্কার পেয়েছেন মার্কিন লেখক লিডিয়া ডেভিস (জ. ১৯৪৭)। ডেভিসের গল্পের দৈর্ঘ্য এক লাইন থেকে শুরু করে দু-তিন পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
তাঁর গল্পকে আদর্শ অণুগল্প বা ফ্ল্যাশ ফিকশন বলা যায়। ছোটগল্পের পাশাপাশি অণুগল্প লিখে পুলিত্জার পুরস্কার পেয়েছেন আরেক মার্কিন কথাসাহিত্যিক রবার্ট ওলেন বার্টলার (জ. ১৯৪৫)। তবে বার্টলার ও ডেভিসের অনেক আগে ছোটগল্পের পাশাপাশি অণুগল্প লিখে বিখ্যাত হয়েছেন জাপানের প্রথম নোবেলজয়ী লেখক ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা (১৮৯৯-১৯৭২)। অণুগল্প লিখেছেন কাফকা, হেমিংওয়ে, আর্থার সি ক্লাক, রে ব্রাডবুরি, নাগিব মাহফুজ, ডোনাল্ড বার্থলেম, অ্যামব্রুস বিয়ার্স, কেট শপা, শেখবের মতো প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিকরাও। উল্লেখ্য, অণুগল্প সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে আমেরিকায়। সেখানে অণুগল্প এখন ছোটগল্প থেকে কিছুটা সরে এসে সাহিত্যের স্বতন্ত্র বিভাগ বা জনরা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
তিন.
অণুগল্পে বেঁধে দেওয়া কোনো আকার না থাকলেও কেউ কেউ মনে করেন এটি ১০০ শব্দের মধ্যে শেষ হওয়া চাই; আবার কেউ কেউ এক হাজার শব্দের নিচের যেকোনো গল্পকে অণুগল্প বলে মনে করেন। যেমন—মার্কিন কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (১৮৯৯-১৯৬১) প্রায় ৯০০ শব্দে ‘ক্যাট ইন দ্য রেইন’ অণুগল্পটি লিখেছেন; আবার তিনি একটি অণুগল্প লিখেছেন মাত্র ছয় শব্দে : ‘For sale: baby shoes, never worn.’ অন্যদিকে হন্ডুরাসের লেখক Augusto Monterroso (১৯২১-২০০৩) ‘সাত শব্দের এপিক’ বলে বিখ্যাত ‘ডাইনোসর’ গল্পটি লিখেছেন : ‘When he awoke, the dinosaur was still there.’ প্রখ্যাত মেহিকান লেখক অ্যাডমান্ড ভালাদেস (১৯১৫-৯৪) ১২ শব্দে লিখলেন ‘দ্য সার্চ’ গল্পটি : Those maddened sirens that howl roaming the city in search of Ulysses. একটি অসমাপ্ত বাক্য, কিন্তু গল্প! তবে অণুগল্প নিয়ে যেন একটু বাড়াবাড়িই করে ফেললেন মেহিকোর লেখক Guillermo Samperio (জ. ১৯৪৮)। তিনি ‘Fantasma’ নামে একটি গল্প লিখলেন, যেখানে শিরোনামের পর একটিও শব্দ লেখা হয়নি। শিরোনাম আর একটি খালি পৃষ্ঠা!
অণুগল্পের এই শব্দসীমাকে চীনা সাহিত্যে বেঁধে দেওয়া হয়েছে ‘স্মোক লং’ ফিকশন বলে। অর্থাৎ একটি সিগারেট শেষ করতে যে সময় লাগবে তার ভেতর এই গল্প শেষ হয়ে যাবে। এটিকে মাইক্রো ফিকশন, পোস্টকার্ড ফিকশন, ন্যানো ফিকশন, সাডেন ফিকশন, সুপার শর্ট ফিকশন কিংবা শর্ট শর্ট স্টোরি নামেও ডাকা হয় বিভিন্ন দেশে।
চার.
অণুগল্পে অল্পকথনের ভেতর দিয়ে অনুভবের বিষয়টি উঠিয়ে আনা হয়। প্রখ্যাত ফরাসি কবি বোদলেয়ারের (১৮২১-৬৭) মতো অনেক কবি খুদে গদ্য-কবিতা (prose poetry) লিখেছেন, যেগুলোকে অণুগল্প হিসেবে চিহ্নিত করা চলে। অন্যদিকে হালের জনপ্রিয় মার্কিন কবি-গল্পকার স্টুয়ার্ট ডাইবেকের (জ. ১৯৪২) অনেক অণুগল্প গদ্য-কবিতা হিসেবে কবিতার কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। এতে বোঝা যায়, কবিতা ও ছোটগল্প দুয়ের বৈশিষ্ট্যই অণুগল্পে বিদ্যমান। যে কারণে মার্কিন লেখক জয়েস ক্যারল ওটস (জ. ১৯৩৮) বলছেন, অণুগল্প ‘...often more temperamentally akin to poetry than to conventional prose, which generally opens out to dramatize experience and evoke emotion; in the smallest, tightest spaces, experience can only be suggested.’ কবিতার মতো অণুগল্পকে নানা মাত্রিক অবস্থান থেকে বিশ্লেষণ করা যায়। একটি কাব্যিক দ্যোতনা বা ভাবমুদ্রা এখানে থাকে। ভাষা হয় ঘন, রূপকাশ্রিত। ফলে মার্কিন কবি-কথাসাহিত্যিক গ্রেস পালে (১৯২২-২০০৭) বলছেন, ‘অণুগল্প কবিতার মতোই ধীরে পড়া উচিত।’ অন্যদিকে অণুগল্প গল্পের মতোই সমাজবাস্তবতার কোনো সুপ্ত চেতনাকে ইঙ্গিত করে। চরিত্র থাকে, কথোপকথন (ডায়ালগ) থাকে। একটা চমৎকার সমাপ্তিও থাকে। কেবল বলাটা হয় দ্রুত—বিদ্যুৎ চমকের মতো ঝলক দিয়েই শেষ। একমুহূর্তে বর্ণিত বাস্তবতার এক ঝলক দেখে নেওয়া।
অণুগল্পের সঙ্গে ছোটগল্পের মূল পার্থক্য হলো, ছোটগল্প তৈরি হয় কতগুলো মুহূর্ত নিয়ে; এখানে কতগুলো ঘটনার কতগুলো দৃশ্যকে আশ্রয় করে প্রকাশ ঘটে। আর একটি সার্থক অণুগল্পে একটি বিশেষ মুহূর্ত একক দৃশ্যপটের ভেতর দিয়ে উপস্থাপিত হয়। কিছু পরিষ্কার করে বলা হবে না, কেবল একটি ইঙ্গিত দিয়েই ছেড়ে দেওয়া হবে। উপন্যাস ও ছোটগল্পের সঙ্গে তুলনা করে আর্জেন্টিনার কথাসাহিত্যিক লুইসা ভেলেনজুয়েলা (জ. ১৯৩৮) বলছেন : ‘I usually compare the novel to a mammal, be it wild as a tiger or tame as a cow; the short story to a bird or a fish; the micro story to an insect (Iridescent in the best cases).’
ফ্ল্যাশ ফিকশন শরীর গঠনে ‘পোকা’ সদৃশ হওয়ার কারণে শব্দচয়নের ক্ষেত্রে অতি মিতব্যয়ী হওয়া প্রয়োজন। এ ধরনের গল্পে টান টান উত্তেজনা থাকবে। শুরু হতেই শেষ হয়ে যাবে। ছোটগল্পের শেষে চমক (whip-crack end) থাকতেও পারে, নাও পারে; তবে অণুগল্পে সেটি মৃদুভাবে থাকলে ভালো হয়। যেমন—বনফুলের নিমগাছ গল্পে বনফুল নিমগাছের উপকারী দিকগুলো এবং মানুষের তার প্রতি যে নিষ্ঠুর আচরণ করে সেটি বলতে বলতে হঠাৎ করে থেমে গল্পকথক বলে দিলেন, পাশের বাড়ির বউটিরও একই দশা। গল্প শেষ। এটি মৃদু চমক। ধাক্কাটি আরো তীব্রভাবে এসেছে আর্জেন্টিনার কথাসাহিত্যিক হুলিও কোর্তাসার (১৯১৪-৮৪) ‘Continuity of the Parks’ গল্পে। এখানে এক ব্যস্ত ব্যবসায়ী একটি উপন্যাস পড়ছেন তন্ময় হয়ে। উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে নায়ক-নায়িকা উদ্যানে ঝোপের আড়ালে দেখা করছেন। আসার সময় গাছের ডালের আঁচড়ে নায়কের মুখে কেটে গেছে। নায়ক বলছে, এভাবে আর লুকিয়ে দেখা করতে পারবে না। এবার কিছু একটা করা উচিত। তখন তারা সিদ্ধান্ত নেয়, সেদিনই নায়িকার স্বামীকে তারা দুজনে মিলে খুন করবে। পরিকল্পনামতো নায়িকার বাড়ি গেল। দরজায় কুকুর ছিল তাদের দেখে ডাকল না। সামনে হলরুম, তারপর করিডর, তারপর একটি সিঁড়ি। চাকু হাতে প্রেমিক। প্রেমিকার স্বামী তখন চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে একটি উপন্যাস পড়ছে। গল্প শেষ। অর্থাৎ শুরুতে যে ব্যবসায়ী পাঠক গভীর মনোযোগের সঙ্গে উপন্যাস পড়া শুরু করেছিল, সে উপন্যাসটি শেষ করতে না করতেই স্ত্রীর পরকীয়া প্রেমের বলি হচ্ছে। বাস্তব আর ফিকশন মিশে এক হয়ে গেল। মজাটা এখানেই।
Publisher & Editor