নারী অবলা, শক্তিহীন। সে পুরুষের মুখাপেক্ষী হয়ে চলবে বা থাকবে- এটাই যেন বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট। একশনএইড বাংলাদেশ এই মানসিকতার বেড়াজাল ভেঙে নারীকে বের করে নিয়ে আসতে কাজ করছে ১৯৮৩ সাল থেকে। নারীকে অধিকার সচেতন করা, নেতৃত্ববিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে সাহায্য করার মতো কাজ করে নারীর ক্ষমতায়নকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সমান তালে। এরই ধারাবাহিকতায় আজ বাল্যবিয়ে, নারীর প্রতি সহিংসতাসহ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যার সমাধান ও অধিকার নিশ্চিতে নারীনেত্রীরা কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। তারা জড়িত হয়েছেন আয়মূলক কাজে, কৃষিতে এবং দুর্যোগপ্রবণ এলাকার ঝুঁকি কমাতে। এসব নারী আজ নিজ নিজ কমিউনিটিতে পরিবর্তনের ধারক হিসেবে সুপরিচিত, গ্রহণযোগ্য এবং নিজ নিজ স্থানে অপ্রতিরোধ্য। আজ নারী দিবসে এমনই কিছু অসাধারণ নারী নেতৃত্বের কথা তুলে ধরব-
নওগাঁর হাসিনা বেগম (৩৯)। তার পাঁচ মেয়েকে রেখে স্বামী নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন মাত্র ২৩ বছর বয়সে। স্বামীহারা অসহায় হাসিনা পাঁচ মেয়েকে নিয়ে কর্মসংস্থানের জন্য এখানে সেখানে ঘুরেছেন। ২০১২ সালে একশনএইড বাংলাদেশের স্থানীয় সহযোগী সংস্থা বিডিওর সঙ্গে যুক্ত হয়ে অচিরেই তিনি তার মতো অসহায় নারীদের উন্নয়নে কাজ শুরু করেন।
বাল্যবিয়ে এবং কিছুদিন অন্তর মেয়েদের স্বামীর বাড়ি থেকে তালাকপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে আসা এ এলাকার নিত্যদিনের চিত্র। এলাকার শিক্ষক, মেম্বার, নারী মেম্বার, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে বাল্যবিয়ের স্থায়ী সমাধানকল্পে উপজেলা, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটি গঠন করেছেন এবং এ পর্যন্ত ১৩৩টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছেন। করোনাকালীন নারীর ওপর নির্যাতন মোকাবিলায় ১১৬টি অভিযোগ রেজিস্টারে নথিভুক্ত করেন, যার মধ্যে ৩৬টি মামলার সমাধান হয়েছে ইতোমধ্যে।
ইউনিয়ন পরিষদের ভিজিডি ও ভিজিএফের চাল দেওয়ার সময় নারীদের রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। তিনি এর প্রতিবাদ করেন। ফলে ইউনিয়ন পরিষদের বিল্ডিংয়ের মধ্যে সম্মানের সঙ্গে বেঞ্চ ও চেয়ারে বসিয়ে চাল বিতরণ করা হয়। সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতায় ৯০০০ পরিবারে বন্যা ও শীতকালীন জরুরি সাড়া প্রদান কাজেও সহযোগিতা করেছেন তিনি।
এলাকার দখলকৃত আট একর খাসজমি উদ্ধার করে ২০১৪ সালে ৬০ পরিবারের বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা করেন এবং আরও ৯ একরের পাঁচটি পুকুর উদ্ধার করে ৩১৫ জন অসহায় নারীকে নিয়ে করেছেন মাছ চাষ, যা তাদের করেছে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। বঞ্চনা ও দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসকৃত মানুষ হাসিনা বেগমের হাত ধরে নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
জামালপুরের মিনি আক্তার (২১) ২০১৬ সালে একশনএইড বাংলাদেশ-এর স্থানীয় সহযোগী সংস্থা বেইস-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে নারী নির্যাতন প্রতিরোধমূলক প্রশিক্ষণ পেয়ে নিজেকে সাহসী বলে মনে করতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে তিনি স্কুলের গার্লস ক্লাবের সভাপতি হন। কাজ শুরু করেন বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে। পথনাটক করে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ শুরু করেন। মিনির প্রচেষ্টায় বন্ধ হয়েছে ছয়টি বাল্যবিয়ে এবং ৯টি পারিবারিক নির্যাতন।
২১ জন সদস্য নিয়ে তিনি তৈরি করেন উদ্ভাবন সমাজকল্যাণ সংস্থা নামে একটি যুব সংগঠন। সদস্যদের সঙ্গে মিলে মিনি স্কুল এবং কলেজের সামনে থেকে বখাটেদের উৎপাত বন্ধ করেছেন। ভিতু মেয়েদের স্কুল-কলেজে আসতে সাহায্য করেছেন, সাহস জুগিয়েছেন।
মিনিদের সাহসী কাজ দেখে সমাজসেবা অধিদপ্তর ২০১২ সালে নিবন্ধন দিয়েছে তাদের সংগঠনকে। ইউএনও এবং চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করে স্কুলে স্যানিটারি ন্যাপকিন কর্নার তৈরি করেছেন। এখন মেয়েদের স্কুলে এসে মাসিক হলে লজ্জায় পড়তে হয় না। মিনি তার দল নিয়ে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করার ফলে এখন সেখানে নিয়মিত সেবা পাওয়া যাচ্ছে। কভিড-১৯ এর সময় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে গ্রামের মানুষকে সচেতন করেছেন এবং ২০২১ সালে প্রায় ১০০ জন যুব নারী-পুরুষকে একত্র করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সচেতনমূলক র্যালি করেছেন তিনি। এত অল্প বয়সে চরাঞ্চলের অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের একটি মেয়ে হয়ে একটি সংগঠন তৈরি, নারীর প্রতি যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা রাখা, সাহসের সঙ্গে বখাটেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সত্যিকার অর্থেই প্রশংসার দাবিদার। 'অভাবের সংসারের বোঝা টানা খুবই কষ্টের। বাবা-মা গরিব হওয়ায় লেখাপড়া শিখতে পারিনি। স্বামী একা ভ্যান চালিয়ে যে আয় করেন, তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলে। আমরা এ রকম ভুল আর করতে চাই না। আমরা সচেতন হচ্ছি। নিজে কিছু আয় করা শুরু করেছি। স্বপ্টম্ন দেখি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখাব। তাহলে ওরা ভবিষ্যতে ভালোভাবে চলতে পারবে। সমাজের হাল ধরতে পারবে।'
কথাগুলো বলছিলেন ঘোড়াঘাটের কমেলা বেগম (৩২)। ২০১২ সালে তিনি যুক্ত হন একশনএইড বাংলাদেশ-এর সঙ্গে। জলবায়ুসহনশীল, স্থায়িত্বশীল কৃষির ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বাড়িতেই জৈব সার ও ভার্মি কম্পোস্টের উৎপাদন শুরু করেন তিনি। বাড়িতে উৎপাদিত সার দিয়েই তিনি ফসল ও সবজি চাষ করতে থাকেন। এতে তার ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ফলনও ভালো হয়। দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কৃষি অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতির ওপর (স্থায়িত্বশীল কৃষি, বোরো ও আমন ধান উৎপাদন পদ্ধতি) দলের অন্য সদস্যদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তার গ্রামের মানুষ এখন জলবায়ু সহনশীল, স্থায়িত্বশীল কৃষির ওপর পরামর্শ নিতে তার কাছে ভিড় করে।
কলাপাড়ার মরিয়ম বেগম (৩৫)। করোনা মহামারির কারণে যখন মানুষ দিশেহারা আর ভয়ে অস্থির তখন তিনি আর ঘরে বসে থাকতে পারেননি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কভিড-১৯ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবার্তা পৌঁছে দিতেন। ছোট শিশু থেকে শুরু করে ঘরের বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদেরও তা শিখিয়েছেন। যখন কেউ কেউ সচেতনতা বিধি মানছিল না, তখন তিনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সহায়তায় গ্রাম পুলিশ দিয়ে তাদের সচেতন করার চেষ্টা করেছেন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের কাছে ধরনা দিয়ে অন্তত ১৮৫ জনের নামে সরকারি খাদ্য সহায়তা পাইয়ে দিয়েছেন। তিনি তার এলাকায় ঘুরে ঘুরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অসহায়দের তালিকা তৈরি করে ছুটেছেন সবার দ্বারে দ্বারে। নারীদের শিখিয়েছেন কীভাবে কাপড়ের মাস্ক বানাতে হয়। তার পরামর্শে তার এলাকার ১১ জন নারী কাপড়ের মাস্ক তৈরি করে আয়ের পথ তৈরি করেছেন। এর পর সরকার যখন ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকা দেওয়ার ঘোষণা দেয়, তখন তিনি কমিউনিটির কাছে এই সংবাদ পৌঁছে দিয়েছেন। তাদের টিকা রেজিস্ট্রেশন করতে ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে গিয়ে টিকা দেওয়ায় সহায়তা করেছেন।
দুর্যোগ বাংলাদেশের নিত্যদিনের অভিশাপ, যাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারীরা। একশনএইড বাংলাদেশ-এর নারী নেতৃত্বে জরুরি সাড়া প্রদান কার্যক্রম তৃণমূল পর্যায়ে নারী নেতৃত্ব বিকাশের একটি কৌশল, যাতে নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা হয় সংকেত প্রচার, উদ্ধার ও স্থানান্তর কার্যক্রম, ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ প্রস্তুত, বাজেট তৈরি, ক্ষতিগ্রস্ত অংশগ্রহণকারী নির্বাচন, ত্রাণসামগ্রী ক্রয় ও বিতরণ, পুনর্বাসন, নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে। বর্তমানে ২৩৭ জন নারী এই সাড়াদান কার্যক্রমে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদান করছেন। মরিয়মও এমন একজন নেত্রী। তিনি এ পর্যন্ত ১০টি দুর্যোগের সাড়া প্রদান কার্যক্রমে কাজ করেছেন, যার মধ্যে আম্পান এবং সাইক্লোন ইয়াস উল্লেখযোগ্য। এতে উপকৃত হয়েছে প্রায় দুই হাজার মানুষ। বৈষম্যের শিকড় তুলে আরও অসংখ্য নারী সামনে এগিয়ে যাক তার বলিষ্ঠ নেতৃত্মে- নারী দিবসে এটাই প্রত্যাশা।
Publisher & Editor